
অনেক দিন থেকেই হ্যাংআউটে বের হওয়া হচ্ছিল না। একটা রিফ্রেশমেন্টের খুব প্রয়োজন ছিল। তাই হঠাৎ করেই তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, পরীক্ষা শেষ হতেই নিঝুম দ্বীপ ট্যুরে যাব এবং রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চার করব।
নিঝুম দ্বীপ সম্পর্কে একটু প্রাথমিক ধারণা দিয়ে রাখি। এটা বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝে নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত উপজেলা হাতিয়া দ্বীপের পাশে (হাতিয়া থেকে ৬০ কি.মি. দক্ষিণে) অবস্থিত ৬৩ বর্গমাইল আয়তনের একটি ছোট দ্বীপ।
তো পরীক্ষা শেষ হতেই আমরা রওনা হয়ে গেলাম। বাসে করে চলে এলাম সদরঘাট। উঠলাম এমভি ফারহান ৩-এ। বিশাল লঞ্চ, ডোবার আশঙ্কা কম। ঠিক সাড়ে ৫টায় লঞ্চ ছেড়ে দিল। লঞ্চের সর্বশেষ গন্তব্য হাতিয়া দ্বীপের তমরুদ্দিন ঘাট। আমরা ওখানেই যাব। জার্নিটা ছিল মোট ১৭ ঘণ্টার। রাতে চাঁদের আলোতে লঞ্চের ছাদে উঠেছিলাম। ছাদের সে আড্ডায় আমাদের খাঁচা-ছাড়া মনের কথাগুলো জোছনার মতো ঝরছিল।
সকালে মনপুরায় মালামাল নামাতে লঞ্চ থামল প্রায় ১ ঘণ্টা। আমরাও টুপ করে নেমে গেলাম মনপুরা দ্বীপে। সকালের নাশতাটা সেখানেই সেরে ফেললাম। ৯টার দিকে পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে- হাতিয়া দ্বীপের তমরুদ্দিন ঘাটে।
নিঝুম দ্বীপ যেতে হলে হাতিয়া দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে হয়। যাওয়ার উপায় দুটি। সরাসরি বাইকে, সেক্ষেত্রে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০-৩০০ টাকা। অথবা তমরুদ্দিন ঘাট থেকে জাহাজমারা ঘাট পর্যন্ত বেবিট্যাক্সিতে। ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা। এরপর জাহাজমারা থেকে মোক্তারিয়া ঘাট/নিঝুম দ্বীপ ঘাট পর্যন্ত বাইকে জনপ্রতি ১০০ টাকা। বলে রাখি- তমরুদ্দিন ঘাট থেকে সরাসরি বেবিট্যাক্সি নেবেন না। কেননা জাহাজমারারও কিছুদূর পর পর্যন্ত পাকা রাস্তা, কিন্তু এরপরের রাস্তা এতটাই খারাপ যে, বেবিট্যাক্সি প্রায় সময়ই উল্টে যায়। মোক্তারিয়া ঘাটে এলেই আপনি প্রথম দেখতে পাবেন ওপারের নিঝুম দ্বীপ।
মোক্তারিয়া ঘাট থেকে নদী পার হতে হবে ইঞ্জিন নৌকায়। সময় লাগে ৫ মিনিট, ভাড়া জনপ্রতি ১৫ টাকা। নদী পার হলেই চলে আসবেন স্বপ্নের সেই নিঝুম দ্বীপে!
আমরা নিঝুম দ্বীপে নেমেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম। আসল গন্তব্য কিন্তু নিঝুম দ্বীপের অপর প্রান্তের নামাবাজার। এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তের ১৪ কি.মি. পাকা রাস্তা আছে। আমরা সাথে দ্বীপের সব ধরনের ম্যাপ নিয়েছিলাম। সাথে ছিল কম্পাস। প্ল্যান ছিল এ ট্যুরে সর্বোচ্চ মাত্রায় পরিশ্রম করব, অ্যাডভেঞ্চার করব। কম্পাস আর ম্যাপ দেখে দিক বুঝে নিজেরাই ঘোরাঘুরি করব এবং সে হিসেবে দ্বীপে নামার পর ও-প্রান্তে হেঁটেই চলে যাব।
কিন্তু দ্বীপ যে নেহায়েতই ছোটও নয়, রাস্তা যে ১৪ কি.মি., সে ধারণা ছিল না। বন্দরটিলা বাজার পার হয়ে অনেক দূর আসার পর যখন শুনলাম নামাবাজার আরও ১১ কি.মি. দূরে, তখন আমরা পাথর বহনকারী একটা লরিভ্যানে উঠলাম। লরিটি আমাদের পাকা রাস্তা শেষের প্রায় কাছাকাছিতে নামিয়ে দিল এবং আমাদের থেকে কোনো ভাড়াই নিল না।
মাঝের কিছু অংশ রাস্তা বনের ভেতর দিয়ে গেলেও বাকি রাস্তার ডানপাশে ছিল বন আর বামপাশে ছিল সমুদ্র। এরপরের ৩ কি.মি. রাস্তা এখনো কাঁচা, তবে রাস্তা পাকাকরণের কাজ চলছে দেখে এসেছি। বাকি রাস্তা আমরা হেঁটেই চলে এলাম। অবশেষে লঞ্চ ছাড়ার ২১ ঘণ্টা পর দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রকৃত গন্তব্য নিঝুম দ্বীপের নামাবাজারে এসে পৌঁছলাম।
সেখানে দুপুরের লাঞ্চ সেরে বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম পাশের পুলিশ ফাঁড়িতে। কারণ বনে ঘোরার এবং রাতে সমুদ্রের পাড়ে ক্যাম্প করার ব্যাপারে অনুমতি নিতে হবে। শুনেছিলাম পুলিশের অনুমতি পেতে অনেক ঝামেলা হয়। স্টুডেন্টশিপের প্রমাণ দিতে হয়... হেন-তেন। কিন্তু সেখানে সম্পূর্ণই ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। দ্রুতই অনুমতি পেয়ে গেলাম।
হরিণ থাকে বনের একদম ভেতরে। ওরা বের হয় বনের ডানপাশের নদীর দিকে। আরও একটা কথা, হরিণ বের হয় শুধু আসরের পর। অর্থাৎ হরিণ দেখার সময় আসর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। প্ল্যান করলাম, হেঁটে বনের ভেতর দিয়ে ওপাশে চলে যাব। বনে ঢুকতেই টের পেলাম, একা একা বনে যাওয়া সহজ কথা নয়। যতই ম্যাপ আর কম্পাস থাক, শ্বাসমূল ভরা বনে প্রচুর রাস্তা। ঠিক কোন রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন তা মনে রাখা দুষ্কর তো বটেই, এর থেকেও বড় সমস্যা বনের মাঝের খালগুলো। যেগুলো পারাপারের কোনো সাঁকো নেই। একমাত্র উপায় ট্রলার অথবা নৌকা।
অবশেষে একটা নৌকা ভাড়া করলাম ৭০০ টাকা দিয়ে। নদী হয়ে ঘুরে বনের ওপাশে চৌধুরীর খাল দিয়ে বনে ঢুকলাম। ঢুকতেই একদম কাছ দিয়ে এক পাল বন্য মহিষ খাল পার হয়ে গেল। বনের ভেতরে একটু ঢুকতেই দেখা পেয়ে গেলাম সোনার হরিণের। আস্তে আস্তে ওদের কাছে যেতে লাগলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, সমস্ত বনে শুকনা পাতা বিছানো। চলতে গেলে এগুলোয় পাড়া পড়বেই। আর শব্দ হলেই হরিণ চলে যাবে। হরিণ অনেক দূর থেকে শুনতে পায়, তাই আস্তে কথা বলাও নিষেধ। সম্পূর্ণ ইশারায় আমরা তিনজন ও মাঝি দুজন তিন দিক থেকে ৩টি ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে ঢুকতে লাগলাম। বিশ্বাস করেন, প্রেমিকার কাছে প্রেম নিবেদনের সময় যেমন হার্টবিট বেড়ে যায়, তেমনি হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল। হয়তো একটু অসতর্কতায় পাতার ওপর দিয়ে চলার শব্দে হরিণ চলে যাবে। আমার ভুলে অন্য তিনজনেরও হরিণের ফটো তোলা হবে না। গেরিলা হয়ে মাটি ঘেঁষে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, হার্টবিটের শব্দেই বুঝি হরিণ চলে যাবে!
কিন্তু না, হরিণ চলে গেল পাখির শব্দে। হঠাৎ গাছের ডালে বসা পাখিরা এমন কিচির-মিচির শব্দ করা শুরু করল, সে শব্দেই হরিণ ভাইয়া সিগনাল পেয়ে গেল। দিল দৌড়। আমরা কিছুক্ষণ গাছের আড়ালে মাটিতে গামছা বিছিয়ে শুয়েও ছিলাম। মনে আশা, আধঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পর হরিণ আবার আসবে। তখন কাছ থেকে দেখা যাবে। কিন্তু বুঝতে পারলাম এদিকে যেহেতু ঝামেলা হয়েছে, সেহেতু এদিকে হরিণ আর আসবে না।
বনের ভেতরে ঢোকা শুরু করলাম। বেশ খানিক যাওয়ার পর দেখলাম এক পাল হরিণ হেঁটে যাচ্ছে। পাশে হরিণ শাবকও লাফাতে লাফাতে চলে গেল। ফেরার পথে বন থেকে শুকনো কাঠ নিয়ে এলাম, যাতে রাতে ক্যাম্পে ফায়ারিং করতে পারি।
সৈকতে লাকড়ি ফেলে কাছের বাজারে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে এলাম। ফিরে এসে প্রথমেই ক্যাম্প করে ফেললাম। ক্যাম্প বানাতে স্বেচ্ছায় সাহায্য করলেন গ্রামের এক চাচা। এমনকি কেরোসিন দেওয়ার পরও যখন লাকড়িতে আগুন ধরছিল না, তখন চাচা পাশের এক খেজুর গাছে উঠে শুকনো ডাল পেড়ে আনলেন। আগুন জ্বলল।
ইচ্ছা ছিল পূর্ণিমার রাতে একই সাথে জোছনাস্নান ও সমুদ্রস্নান করব। কিন্তু খেয়ালই ছিল না, রাতে ভাটা থাকে। সে সময় সমুদ্রে নামা যায় না। আমরাও পরিশ্রমে ক্লান্ত ছিলাম। তাই এক সময় আগুন নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। মাঝরাতের পর হঠাৎ প্রচণ্ড আলোতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি চাঁদের আলো এত তীব্র, এত তীব্র হয়েছে যে, আমাদের ক্যাম্পের ত্রিপল ভেদ করে চোখে পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আর থাকতে পারলাম না, তাঁবু থেকে বের হয়ে এলাম। দেখি চাঁদের আলোর সত্যিই বাঁধ ভেঙেছে। চারপাশ একদম দিনের মতোই পরিষ্কার। সে আলোয় আমরা সমুদ্র পাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। সমুদ্রপাড় থেকে ফিরে আসতেই পূর্ব আকাশে সূর্য দেখা দিল। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাজারে এলাম সকালের নাশতার জন্য।
নাশতার পর হোটেলে উঠেই দিলাম ঘুম। এক ঘুমেই দুপুর। ঘুম থেকে উঠেই চলে এলাম সৈকতে। সমুদ্রস্নানের পর পাড়ে বসে বিশ্রাম নিলাম। ঘুড়ি বানিয়ে ওড়ালাম অনেকক্ষণ। হরিণ দেখা তো হয়েছেই, শুধু ফটো তোলা হয়নি।
কিন্তু ক্যামেরায় তো চার্জ নেই। তাই আর বনে না গিয়ে দ্বীপটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। রাতে ফানুশ ওড়ালাম। এরপর উঠলাম সৈকত থেকে বের হওয়া খালে থাকা মাঝধরা ট্রলারে, তাদের সাথে গল্পগুজব করলাম।
হাতিয়া থেকে ঢাকার লঞ্চ ছাড়ে সাড়ে ১২টায়। তাই পরদিন ভোরে উঠে নাশতা সেরেই রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশে। ভালোমতো ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। বারবার চেক করে নিলাম সবকিছু ঠিকঠাক মতন নিয়েছি কি না। কিন্তু তারপরও নিঝুম দ্বীপ ছেড়ে আসার সময় থেকে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, কি যেন নিয়ে আসিনি, কি যেন ফেলে এসেছি, কি যেন রেখে এসেছি!
জাহ্নবী