
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান চলমান পরিস্থিতিতে পর্যটকশূন্য। সংরক্ষিত এই বনে পর্যটকের আনাগোনা না থাকা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে বন্যপ্রাণীরা। উল্লুকের চেঁচামেচি, বানরের লাফালাফি, পাখির কিচিরমিচিরে নতুন রূপে ফিরতে শুরু করেছে লাউয়াছড়া।
সরেজমিনে লাউয়াছড়া বনের গাছে গাছে বন্যপ্রাণীদের লাফালাফি, খাবারের সন্ধানে তাদের অবাধ বিচরণ দেখা যায়।
বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকসহ বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ ও বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। কয়েক দশকে এই প্রাকৃতিক বনের গভীরতা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। পুরনো বহু গাছগাছালি চুরি হওয়া, বনের ভেতর দিয়ে উচ্চ শব্দে ট্রেন চলাচল, সড়কে যানবাহনের অযথা হর্ণ, অত্যধিক দর্শনার্থীর বিচরণ, হইহুল্লোড়, পার্শ্ববর্তী টিলাভূমিতে হোটেল-কটেজ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অস্থিত্ব সংকটে পড়েছে বন ও বন্যপ্রাণী।
স্থানীয়রা জানান, চলমান পরিস্থিতিতে প্রতিনিয়ত উৎফুল্ল প্রাণীদের লাফালাফি, অবাধ বিচরণ ও খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানোর চিত্র চোখে পড়ে।
লাউয়াছড়া পুঞ্জির বাসিন্দা সাজু মারছিয়াং বলেন, এই বনে প্রতিনিয়ত পর্যটকদের ভিড় দেখা যেত, তবে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে লাউয়াছড়া বনে এখন পর্যটক নেই। এতে বনে ফিরে এসেছে নতুন রূপ। সকাল থেকে উল্লুকের আওয়াজ, বিভিন্ন প্রজাতির বানরের লাফালাফি, পাখির কিচিরমিচির শব্দ, সন্ধ্যায় বন মোরগের ডাকে বনটিতে ফিরে এসেছে হারানো প্রাণ।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের দায়িত্বরত ব্যবস্থাপক শাহিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে এই সময়ে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ থেকে সাতশত দেশি-বিদেশি পর্যটক আসতেন। তখন টিকিট বিক্রি করে সরকারের রাজস্ব আয় হতো ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এখন গড়ে ৭ থেকে ৮ জন পর্যটক আসছেন।’
স্থানীয় পরিবেশকর্মী সৈয়দ মহসিন পারভেজ বলেন, ‘এখন পর্যটক নেই, নেই মানুষের হইহুল্লোড়। ট্রেনের ঝনঝনানি শব্দও নেই। নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে রয়েছে বন্যপ্রাণীরা। এটি বন্যপ্রাণীর জন্য স্বস্তির পরিবেশ।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার জাতীয় পরিষদ সদস্য আ স ম সালেহ সোহেল খবরের কাগজকে বলেন, ‘লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটিতে পুরনো প্রাকৃতিক গাছগুলো ক্রমান্বয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কাঠ চোরদের অপতৎপরতাসহ নানাবিদ কারণে এই বনের অবস্থা সংকটাপন্ন। বন ফাঁকা হওয়ায় হুমকির মুখে পড়ছে এখনকার বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জনমানবশূন্য ও যানবাহনের চলাচল কম থাকায় বনটি নতুন রূপ ধারণ করছে। আসলে দিনে মানুষের চলাচলের কারণে প্রাণীরা অবাধ চলাচলে ভয় পেত। এখন মানুষের চলাচল না থাকায় স্বাচ্ছন্দে রয়েছে বন্যপ্রাণীরা।’
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের লাউয়াছড়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে লাউয়াছড়া উদ্যানের গেট বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি পর্যটকদেরও আসতে দেখা যায়নি। পর্যটকশূন্য, ট্রেন চলাচল বন্ধ ও যানবাহন চলাচল কম থাকার কারণে বন্যপ্রাণীর মধ্যে স্বস্তিবোধ হওয়া স্বাভাবিক।’
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে এক হাজার ২৫০ হেক্টর জায়গা নিয়ে লাউয়াছড়া বনকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর থেকে সেখানে পর্যটক বেড়েছে। দেশের ৭টি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল লাউয়াছড়া অন্যতম। ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে এই বনে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য বনটি বিখ্যাত। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদ।
পুলক পুরকায়স্থ/ইসরাত চৈতী/অমিয়/