সুন্দরবনের সুন্দর কথাটি বলতে হলে সুন্দরবন ঘুরে আসা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বহু দর্শনীয় স্থান ঘুরলেও সুন্দরবন দেখার সুযোগ বা সৌভাগ্য সেভাবে কখনো হয়ে ওঠেনি। সেই আফসোস মেটাতে পেরেছি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের আমার বিভাগ পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ফিল্ড ট্রিপের মাধ্যমে। বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ মোট ৭০ জন ঘুরে এলাম রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল, বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বাহারি গাছপালা, বন্য পশুপাখি ও জীবজন্তু ঘেরা গা ছমছম করা সুন্দরবনে।
সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। ১৯৯৭ সালে এটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার, যার বাংলাদেশের অংশে আছে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়েই বাংলাদেশের সুন্দরবন।
জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সুন্দরবনের ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা ও বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। সুন্দরবনে রয়েছে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ এবং ৮টি উভচর প্রাণী। সুন্দরী বৃক্ষের নামানুসারে এই বনের নাম সুন্দরবন রাখা হয়।
গহিন অরণ্যে ঘেরা সুন্দরবন ভ্রমণ ছিল খুবই রোমাঞ্চকর এবং আকর্ষণীয়। ভ্রমণকাহিনি নিয়ে দারুণ একটি অ্যাডভেঞ্জার গল্পের বই লিখে ফেলা সম্ভব, সেখানে অল্প কথায় সুন্দরবন নিয়ে কিছু লেখা আমার কাছে কষ্টসাধ্য বটে।
ঢাকা থেকে বাসে করে রাতে ৭০ জনের দলবল নিয়ে যাত্রা শুরু করি। বাসের ভেতর হই-চই, গান-বাজনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে শেষে ভোরবেলায় পৌঁছে গেলাম খুলনায়।
খুলনা ৪নং বিআইডব্লিউটিএ নদীবন্দরে আমাদের জন্য অপেক্ষারত ছিল পূর্বনির্ধারিত এজেন্সির জাহাজ। জাহাজে উঠে যার যার অবস্থান বুঝে নিলাম। জাহাজে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা খুব ভালো ছিল। সবাই দলবদ্ধভাবে সুন্দরবন ঘুরে দেখা আর প্রতিদিনই প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত জাহাজের ডেকে বসে খোলা আকাশের নিচে গান ও জম্পেশ আড্ডায় মেতে থাকতাম। সকালে ঘুম ভাঙত বনের পাখির কলরবে। আমরা সবাই যেন আমাদের হারিয়ে যাওয়া শৈশব আবারও ফিরে পেয়েছিলাম।
এজেন্সির ব্যবস্থাপনায় আমাদের টিমের সঙ্গে যুক্ত হয় দুইজন গাইড ও একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বন্দুকধারী নিরাপত্তাকর্মী। তাদের দিকনির্দেশনা ও সার্বিক সহযোগিতায় আমরা নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে সুন্দরবন পরিদর্শন করি। পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে দেখার জন্য বন বিভাগের যাবতীয় ফরমালিটিজ এজেন্সির মাধ্যমে আগেই সম্পন্ন করে রাখা হয়েছিল।
সুবিশাল বন সুন্দরবন পুরোটা ভ্রমণ করতে না পারলেও আমরা হাড়বাড়িয়া, করমজল, কটকা, জামতলি বিচ, কচিখালি, শরণখোলা, টাইগার পয়েন্ট, ডিমেরচরে যেতে পেরেছি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় মুহূর্ত ছিল যখন জাহাজ সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা করে, আমাদের সবার সে কী উচ্ছ্বাস! যেন কোনো এক অজানা গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেছিলাম সবাই।
প্রথম দিন সকালের নাশতা করে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল হাড়বাড়িয়া। সুন্দরবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও একই সঙ্গে বিপজ্জনক স্থান হচ্ছে হাড়বাড়িয়া। এই হাড়বাড়িয়া বাঘের বাড়ি নামেও পরিচিত। দীর্ঘ কাঠের সাঁকো দিয়ে বনের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে সুন্দরী, গোলপাতা, জাম, কেওড়াসহ নানা রকম বৃক্ষ। যদিও সুন্দরী গাছ এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। বনের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় হরিণ, বানর ও বন্য শূকরসহ নানা বৈচিত্র্যময় প্রাণী ও পাখি চোখে পড়বে। সচরাচর বাঘ দেখা না গেলেও হাড়বাড়িয়া ট্যুরিজম স্পটে টাটকা বাঘের পায়ের ছাপও খুব সহজে দেখতে পাওয়া যায়।
হাড়বাড়িয়া ভ্রমণ শেষে আমরা চলে আসি জাহাজে, দুপুরের খাওয়া শেষ হলেই শুরু হয় শিলা নদী ধরে আন্ধারমানিকের উদ্দেশে রওনা। আন্ধারমানিক সুন্দরবনের নতুন একটি ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র। আন্ধারমানিক গিয়ে নামতেই চোখে পড়ে হরিণের প্রজনন কেন্দ্র। সেখানেও চোখে পড়ে সুন্দরী গাছসহ নানান প্রজাতির গাছ। তারপর লম্বা একটি ফুট ট্রেইলের ওপর দিয়ে পাখির কলরব শুনতে শুনতে হেঁটে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।
সন্ধ্যা নামার আগেই আমরা আবার ফিরে যাই জাহাজে। এবার যাত্রা কটকার উদ্দেশে। কটকা সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জে অবস্থিত। সুন্দরবনের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে কটকা অন্যতম। আমরা রাতে পৌঁছে যাই কটকা ফরেস্ট অফিসের পাশেই। গাইডের কাছ থেকে জানতে পারি কটকা আসার সময় অনেকটুকু পথ সমুদ্রের ওপর দিয়ে আসতে হয়। যদিও আড্ডা, গল্পের ভিড়ে সেটা কেউই টের পাইনি।
দ্বিতীয় দিন খুব ভোরে আমরা ঘুম থেকে উঠে সবাই ঘুম ঘুম চোখে হালকা চা-বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়ি কটকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্রের পথে। প্রথমে কিছুদূর হাঁটতেই চোখে পড়ে ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে আশপাশে অনেকটুকু অঞ্চলই খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়। ওয়াচ টাওয়ার পিছু ফেলে সোজা উত্তরে তিন কিলোমিটার হেঁটে আমরা পৌঁছালাম জামতলা সমুদ্রসৈকতে। পথে পথে নানা আকারের জামগাছের জন্যই সমুদ্রসৈকতের নামকরণ করা হয়। সৈকতে যেতেই দেখলাম প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেটসহ নানা রকম প্লাস্টিক বর্জ্য। যা আমাদের পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। আমরা ৭০ জনের টিম নিয়ে বিচ ক্লিনিং কর্মসূচি পালন করি। কর্মসূচি শেষে একই পথ ধরে রওনা করি জাহাজের উদ্দেশে। পথের মধ্যে দেখতে পাই বিশাল একটি চিত্রা হরিণের দল। বনের ভেতর দক্ষিণ দিকে হাঁটলেই পরপর তিনটি টাইগার টিলা খুঁজে পাওয়া যায়। কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্র ঘুরে দেখার পর আমরা চলে আসি জাহাজে। পরবর্তী গন্তব্য ডিমেরচর।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছালাম ডিমেরচরে। জানতে পারি ডিমের মতো আকৃতি হওয়ায় এই চরের নাম ডিমেরচর। লাইফ জ্যাকেট পরে সবাই নেমে পড়লাম পানিতে। ডিমেরচর সৈকতটি নির্জন এবং পরিচ্ছন্ন। ডিমেরচরের হই-হুল্লোড়ের পর আমরা চলে যাই কচিখালিতে। কচিখালি সুন্দরবনের আরেকটি আকর্ষণীয় স্পট।
ভ্রমণের শেষ দিন আমরা গেলাম করমজলে। করমজল পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। কারণ সুন্দরবনের প্রবেশপথে ও মোংলা বন্দরের সবচেয়ে কাছে করমজল অবস্থিত। করমজলে নামতেই চোখে পড়বে ছোট-বড় নানা সাইজের বানর। মানুষের কাছ থেকে ব্যাগ-মোবাইল ছিনিয়ে নিতে পারলেই তাদের শান্তি মেলে। করমজলে ডলফিন, হরিণ ও কুমিরের প্রজনন কেন্দ্রও চোখে পড়েছে। এ ছাড়া এখানে লবণাক্ত পানির কুমির, ডুবহাঁস, বানর, সাপ, শিয়াল, নদীর ডলফিন চোখে পড়ার মতো। পাখিপ্রেমীদের জন্য এটি চমৎকার একটি জায়গা। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিমুগ্ধ হওয়ার মতো।
সুন্দরবন এতটাই সুন্দর যে বনের অপরূপ সৌন্দর্যের কথা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। কিন্তু দিন দিন সুন্দরবন নানা রকম ক্ষতির মুখে পড়ছে। এইভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ হারাতে বসবে প্রাকৃতির এই অপার সৌন্দর্যকে, হারাবে জৈববৈচিত্র্য। সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস হয়ে যেমন আমাদের রক্ষা করছে, তেমনি করে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সৃষ্ট হওয়া নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও আমাদের রক্ষা করছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন একটি। এই বনকে রক্ষা করতে দ্রুত আমাদের উদ্যোগী হওয়া দরকার। সবার সুন্দর মনই পারে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে। পরিশেষে বলা যায়, অনেকগুলো সুন্দর মন, বাঁচাতে পারে সুন্দরবন।
জাহ্নবী