
রাতের গাড়িতে ছুটলাম শ্রীমঙ্গল। সঙ্গে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের কয়েকজন ভ্রমণ পাগলু। ঈদের ছুটিতে রাস্তা ফাঁকা। পৌঁছে দেখি ঘড়ির কাঁটায় মাত্র রাত আড়াইটা। বাস থেকে নামতেই শরীরে খেলল হিম হিম ঠাণ্ডা। এ তো দেখছি শরৎকালেই শীতের আমেজ। সময় ও আবহাওয়া এই দুয়ের জাঁতাকলে, রাস্তার চৌকিদার নিয়ে আবাসিক হোটেলগুলোর প্রধান ফটকে কড়া নাড়লাম। রাতের বেলা রুম দিতে রাজি হলো না কেউ। কী আর করা। শ্রীমঙ্গল শহরের রাতটা এলোমেলোভাবে হেঁটেই কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয় ৮২ বছরের এক চৌকিদারের সঙ্গে। তার দেখানো মতে একটি যাত্রী ছাউনিতে বসার পরেই, জমে গেল তুমুল আড্ডা। যেখানে অংশ নিলেন লোকাল ড্রাইভার ও চৌকিদাররা। নানান গল্পগুজব করতে করতে রাত পোহাল। ভোরের আলো ফুটতেই ভাড়ায় খাটা জিপ গাড়ি নিয়ে হাজির হলো স্থানীয় সমাজসেবক শ্যামল দেব বর্মা। হাই হ্যালো পর্ব শেষ করতেই, দাদার সঙ্গে ছুটলাম লাসুবন।
শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে নাহার খাসিয়া পুঞ্জির পাদদেশে প্রাচীন গিরিখাত লাসুবন। মাঝখানে ব্রেক দিয়ে বাজার করে নিলাম। যেতে যেতে টিপরাছড়া রাবার বাগানের সামনে, বিরাট এক টিলা ধসের কারণে গাড়ি আটকে যায়। হইলোনি কারবার! অগত্যা গাড়ি ছেড়ে হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে নাহার টি গার্ডেনের দেখা পাই। ওয়াও! পাহাড়, টিলার ঢালুতে চমৎকার একটি চা বাগান। দৃষ্টিনন্দন বাগানের সৌন্দর্যে খুব সহজেই চোখ জুড়িয়ে যায়। বেশ একটা ভালো লাগার রেশ নিয়ে এগোতে থাকি। যেতে যেতে সদ্য পেড়ে আনা কাঁঠালের ওপর হামলে পড়ি। জাতীয় ফলের গাছ পাকা স্বাদ শক্তিতে রূপান্তর হতে হতেই, চোখে ধরা পড়ল খাসিয়াদের গ্রাম নাহার পুঞ্জির রঙিন ঘরগুলো। পাহাড় ডিঙিয়ে পুঞ্জিতে উঠার পর সেখানে বসবাস করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী খাসিয়া নেতা ডিবার মিন খাসিয়া ও সেল খাসিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। আমাদের আসার খবর তারা আগেই জানতেন। তাই প্রবেশের অনুমোদন পেতে সময় লাগেনি। সঙ্গে নেওয়া বাজার গাইড অর্কিডের পরিবারকে বুঝিয়ে দিয়ে পুঞ্জি ঘুরতে বের হই। ছবির মতো সুন্দর নাহার খাসিয়া পুঞ্জি। প্রতিটি ঘরের সামনে নানান ধরনের ফুল গাছ। সেসব গাছে ফুটে থাকা ফুলের ওপর বাহারি রঙের প্রজাপতিরা উড়ে বেড়ায়। পুঞ্জির গাছতলায় দেশীয় হারিয়ে যাওয়া টসটসে পাকা কাউ ফল, ঝড়ে মাটিতে বিছিয়ে রয়েছে। গাছে গাছে ঝুলে রয়েছে চাম কাঁঠালসহ বিভিন্ন অচেনা ফল। কিন্তু খাওয়ার মানুষ যেন নেই। আমরা তো কাউফল দেখে দ্রুত অনুমতি সাপেক্ষে তা গুপ্তধনের মতো লুফে নিয়েছি। আহ কী স্বাদ। শুকনো মরিচের লবণ হলে মন্দ হতো না। হা হা হা। বর্তমান প্রজন্ম অনেকেই এখন আর কাউ ফল চিনেই না।
পুঞ্জির খাসিয়া তরুণীরা খুবই সুন্দর ও স্মার্ট। প্রথম দেখাতেই নজর কাড়ে। বিদ্রোহী কবি সেসময় এখানে এলে হয়তো তার প্রেমিক হৃদয় কারও জন্য উজাড় করে দিতেন। কাউফল চাখতে চাখতে সামনে আগাই। তা না হলে আমার হৃদয় আবার কার জন্য উজাড় হয়ে যাবে কে জানে। হা হা হা। প্রেমে পড়ার কোনো জাতপাত কিংবা বয়স নেই। বাধা হতে পারে না কোনো সীমান্তরেখা। নজর ফিরিয়ে বরং প্রকৃতির দান সারি সারি কাঁঠালগাছের ফাঁক গলে যেতে যেতে, একেবারে সীমান্ত পিলারের সামনে দাঁড়াই। ওই পাড়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। নোম্যান্সল্যান্ডের সামনে মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর- আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার, ঐতিহাসিক সেই মহান উক্তিটি মনে পড়ে যায়। আমার আমার কিন্তু এখন তো আমাদের হলো না। তাই দূর থেকেই ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পাহাড়মালা দেখে আবারও খাসিয়া নেতাদের ঘরে ফিরে যাই। এবার গিরিখাতে প্রবেশের উপযোগী পোশাক পরার প্রস্তুতি। এই ফাঁকে খাসিয়া রমণীদের তৈরি অসাধারণ দুধ চা পরিবেশন করা হলো। অপ্রত্যাশিতভাবে আপ্যায়িত হয়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, খাসিয়া তরুণ ফেন্সীকে পথপ্রদর্শক হিসেবে সঙ্গে নিয়ে গিরিখাতের দিকে রওনা হই।
পাহাড় থেকে প্রায় ৫০০ ফিট নিচে নামতে হবে। ইলশেগুড়ি বৃষ্টির কারণে পথ বেশ পিছলে। যতদূর চোখ যায় শুধু আদিম জঙ্গলে ঘেরা। হালের হাইপ রাসেল ভাইপার, সেটা না হয় থোরাই কেয়ার! কিন্তু জোঁকের যন্ত্রণার ব্যাপার তো মাথায় রাখতেই হয়। বেশ সতর্কতার সঙ্গে যেতে যেতে ঝিরির দেখা পাই। চারপাশ নৈঃশব্দ। গা ছমছম পরিবেশ। শুধু আমরা ছাড়া আর কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই। এবার ঝিরিপথে হাঁটা। পানির গতিবিধি বেশি সুবিধাজনক না। কখনো বাড়ছে আবার কখনো কমছে। হরকা বানের (ফ্ল্যাশ ফ্লাড) আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ঝিরির নাম লাংগুলিয়া। এর উৎস ত্রিপুরা রাজ্য। পানির নিচের পাথরগুলো প্রচণ্ড ধারালো। সামনে আগানো বেশ কষ্ট। তবু অদেখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে যেতেই হবে। মাঝে মধ্যে হাস্যরস ও নুডলস খাওয়ার ছলে জিরিয়ে নিচ্ছি। প্রকৃতির নেশায় বুঁদ হয়ে পড়লে, কোনো বাধাই আর কঠিন মনে হয় না। গিরিখাতের স্থান সিন্দুরখান ইউনিয়ন এখনো কিছুটা দূরে। সবুজের ঝাঁপি দিয়ে ঘেরা ট্রেইলটা অসাধারণ। এক কথায় চমৎকার একটা হাইকিং ট্রেইল। তাই ভালো লাগার অনুভূতিটাও আকাশছোঁয়া। সেখানে ক্রেম কেরি, ক্রেম উল্কা ও ক্রেম ক্লু নামে তিনটি পাহাড়ি গিরিখাত রয়েছে। এগুলো খাসিয়া ভাষা। যেমনটা লাসুবন অর্থ জংলি ফুল। যেতে যেতে চোখে ধরা দিল সেই কাঙ্ক্ষিত গিরিখাত। আমরা অন্য দুটোর চেয়ে তুলনামূলক অধিক রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ পেতে, ক্রেম উল্কাতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিই।
দুই পাহাড়ের মাঝে সরু পথ। কোনো ঝরনার অস্তিত্ব নেই। তবু পাহাড় চুইয়ে অবিরাম ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। গিরিখাতটির কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও বুক সমান, কোথাওবা আবার সাঁতরে পার হতে থাকি। ঘন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা জংলি পরিবেশটা ধীরে ধীরে দিনের আলো হটিয়ে, নিকষ অন্ধকার ভেতরটা গ্রাস করে নিল। এতটাই অন্ধকার হয়ে পড়ল যে, মাত্র দেড়-দুই ফুট দূরত্বেও ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না। কিছু কিছু জায়গায় শরীর পুরোটা কাত করার পরও আটকে যাচ্ছিল। গিরিখাতের মাঝামাঝি এমন সরু একটা জায়গা রয়েছে, যেখানে দুই পা ছড়িয়ে পাহাড়ের গায়ে পা ফেলে এগিয়ে যেতে হয়। পুরাই ভূতুড়ে অনুভূতি। পরিস্থিতি এমনই জটিল ছিল, হঠাৎ হরকাবান হলে হয়তো নির্ঘাত মৃত্যু। দৌড়ে কোথাও দাঁড়ানোর মতো অবস্থা নেই। পাহাড়ের দুইপাশ খাড়া হয়ে ওপর দিকে উঠে গেছে। এমতাবস্থায় রহস্যময় প্রাচীন গিরিখাতটির ভেতর প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মনে হয়েছে, এটা জীবনের অন্যতম সেরা একটি ভ্রমণের সময় আমাদের। এ পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিল, শেষের অংশে এসে ভারী শরীরের কারণে ফাঁদে আটকে যাই। সেটাও এক রোমাঞ্চকর মজার অভিজ্ঞতা। অতঃপর ভ্রমণবন্ধুদের হইহই রইরই ধ্বনির সঙ্গে ঠেলা ধাক্কায়, দেহটা সূর্যের আলোয় বড় গাঙ নামক ঝিরিতে ফিরে। হাইকিং ট্র্যাকিং অ্যাডভেঞ্জার সবকিছু মিলিয়ে ইদানীং বান্দরবানের গহীনে যেতে না পারার কষ্ট কিছুটা হলেও কমিয়েছে। নয়নাভিরাম প্রকৃতি ঘেরা ভয়ংকর সৌন্দর্যের লাসুবন গিরিখাত অভিযানটি, ভ্রমণ ঝুলির স্মৃতির আয়নায় থাকবে অমলিন।
যাবেন কীভাবে: ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল বাস কিংবা ট্রেনে। সেখান থেকে সুবিধামতো বাহনে নাহার টি গার্ডেন-সংলগ্ন নাহার খাসিয়া পুঞ্জি। পুঞ্জির প্রধানদের কাছ থেকে অনুমতি সাপেক্ষে, খাসিয়া সম্প্রদায়ের গাইড নিয়ে যাওয়া যাবে।
থাকবেন-খাবেন কোথায়: রাতের গাড়িতে গিয়ে সারা দিন ঘুরে ফিরে আসা যাবে। অভিযানের সময় সঙ্গে শুকনো খাবার, পানি ও চকলেট রাখবেন। রাতে থাকতে চাইলে শহরে প্রচুর হোটেল/মোটেল, কটেজ ও রিসোর্ট রয়েছে।
সতর্কতা: ভ্রমণসঙ্গী মনমতো হওয়া চাই। দুঃসাহসী ও রোমাঞ্চপ্রিয় ভ্রমণ পাগলুদের জন্য লাসুবন গিরিখাত অভিযান। যাদের দৈহিক ওজন অতিরিক্ত, তারা ভেবেচিন্তে যাবেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে নেবেন।
মেহেদী