
জেলায় মেঘ-পাহাড়ের খেলা দেখার পাশাপাশি প্রকৃতির সঙ্গে পর্যটকদের অনাবিল আনন্দ দিতে চিরসবুজ সাজে সেজেছে বান্দরবানের লামার মিরিঞ্জা ভ্যালি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এবং বান্দরবান শহর থেকে ৮৬ কিলোমিটার ও চকরিয়া হতে আলীকদম সড়কে ২৭ কিলোমিটার দূরে লামা উপজেলায় অবস্থিত এই মিরিঞ্জা ভ্যালি পর্যটনকেন্দ্র। এখানে সুউচ্চ সবুজ পাহাড়-বনানী ঘেরা আঁকাবাঁকা পথ, আকাশ, মেঘগুলো পর্যটনকেন্দ্রটিকে দিয়েছে নয়নাভিরাম নৈসর্গিক সৌন্দর্য। নির্মল আনন্দের রাজ্যে নগরের যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি দূর করতে গড়ে উঠেছে প্রকৃতির বুক চিরে আকাশছোঁয়া চিরসবুজ এক শান্তিধাম।
মিরিঞ্জা ভ্যালির আকাশ-মেঘ ভ্রমণপিপাসু মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। এখানে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো, পাহাড় আর মেঘের খেলা উপভোগ করা। অবারিত সবুজ প্রান্তর, যেখানে মিশে যায় মেঘের ভেলা। এখানে মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের যেন আজন্ম বন্ধুত্ব। প্রকৃতি এলাকাটিকে সাজিয়েছে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। এখানে ইচ্ছে করলেই ছোঁয়া যায় মেঘ, আকাশকেও মনে হয় বেশ কাছে। রাতে শহরের আলোতে যেন সৌন্দর্য আরও বৈচিত্র্যময়।
মিরিঞ্জা ভ্যালি পর্যটনকেন্দ্রটি পাহাড়ে দুই একর জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে। লামা শহর থেকে আঁকাবাঁকা সড়ক বেয়ে যেতে হয় এই কেন্দ্রটিতে। লামা শহর থেকে মিরিঞ্জা ভ্যালির দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। পাহাড়ের উঁচুতে পরিবেশবান্ধব ইকো রিসোর্ট হিসেবে তৈরি করা হয়েছে বাঁশের দুটি মাচাং ঘর। এ ছাড়া পর্যটকদের সুবিধার্থে রাখা হয়েছে খোলা আকাশের নিচে কয়েকটি তাঁবুঘর। এসবের পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে রাতে চিকেন ফ্রাই, বিরিয়ানিসহ নানা পদের খাবার। কেন্দ্রটির চারপাশে নিরাপত্তা রয়েছে বেশ মোটামুটি। ২০২১ সালে গড়ে তোলার পরিকল্পনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়েছে ২০২২ সালে।
যেভাবে যাবেন
ট্রেনে: ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে রাতে ১১টা ৩০ মিনিটে টুর্না ট্রেনে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে নামতে হবে। টিকিট পড়বে জনপ্রতি ৩৪৫ টাকা। সকাল ৫টা ৩০ মিনিটে বা ৬টার সময় চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে নামতে হবে। তারপর অটোরিকশা করে নতুন ব্রিজে আসতে হবে। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১৫ টাকা। নতুন ব্রিজ থেকে বাসে করে চকরিয়া আসতে হবে। বাস ভাড়া ১৫০-২০০ টাকার মধ্যে আসা যাবে। সময় লাগবে মোটামুটি ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট থেকে ৩ ঘণ্টা। নামতে হবে চকরিয়া বাসস্ট্যান্ডে। চকরিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে চান্দের গাড়িতে করে মুরুমপাড়া আসতে হবে। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৮০ টাকা। এখান থেকে পাহাড়ে ২০ মিনিট ট্রেকিং করে এলেই মিরিঞ্জা ভ্যালি।
বাসে: ঢাকা থেকে লামায় দুটি বাস ছাড়ে। শ্যামলী ও হানিফ যেকোনো বাসে উঠে গেলেই হলো। মিরিঞ্জাপাড়ায় নেমে গেলে মেইন রোড থেকে মাত্র ১০ মিনিট হাঁটার রাস্তা। তার পরই পেয়ে যাবেন মিরিঞ্জা ভ্যালি।
অথবা কক্সবাজারের যেকোনো বাসে উঠে চকরিয়া নেমে লামার চান্দের গাড়িতে উঠে মিরিঞ্জাপাড়ায় নেমে যাবেন।

কোথায় থাকবেন
মিরিঞ্জা ভ্যালিতে রাতে ক্যাম্পিং করে থাকতে পারেন বা জুমঘরে থাকতে পারবেন। জুমঘরে শুধু ভাড়া ২০০০ টাকা। খাবার আলাদা নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। যদি ১০ জন বা তারও বেশি গিয়ে থাকেন, তা হলে জুমঘর নিতে পারেন। অথবা দুপুরের খাবার, সন্ধ্যায় নাশতা, রাতে বারবিকিউ, পরদিন সকালের নাশতা, পানি, তাঁবুতে রাতে থাকা- সব মিলিয়ে একটা প্যাকেজ নিতে পারেন, জনপ্রতি ৮৫০ টাকা।
ভ্রমণে কী কী দেখবেন
পাহাড়ি রাস্তা বা ঝিরিপথ পেরিয়ে চূড়ায় আরোহণের পর দূরে দেখা যায় মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স এবং সাঙ্গু নদীসহ বিশাল পাহাড়জুড়ে বিস্তীর্ণ সবুজ বনভূমি। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য এই চূড়া উপযুক্ত একটি স্থান। এখান থেকে দিগন্তরেখায় কক্সবাজার অংশের বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলরাশি চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে দৃশ্যমান হয় লাইট হাউস, যার ক্ষীণ আলোয় সরু রেখায় আলোকিত হয়ে ওঠে পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত।
মুগ্ধতার পরিসর আরও একটু বাড়িয়ে দিয়ে কখনো কখনো সেই রেখায় ভেসে ওঠে একটি-দুটি জাহাজ। পাহাড়ের দক্ষিণ প্রান্তের টাইটানিক জাহাজের কাঠামোটিও এখানকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। পর্যটনকেন্দ্রের কাছেই উপজেলা শহরে ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমাসহ ১১ জনগোষ্ঠীর বসবাস।
ভ্রমণের সেরা সময়
বর্ষাকালের শেষ থেকে শরৎকাল পর্যন্ত প্রায় সারা দিনই পরিষ্কার আকাশে শুভ্র মেঘের খেলা দেখা যায়। পাহাড়ের চূড়া থেকে এই দৃশ্য দেখার অনুভূতির কোনো বিকল্প হয় না। তবে এ সময়টাতে পাহাড়ি পথ বেশ পিচ্ছিল থাকে। ট্রেকিং পথ খুব একটা দুর্গম না হলেও উষ্ণ মৌসুমের ফলে পুরো যাত্রাটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই এখানে আসার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হচ্ছে শীতের সময়- তথা নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস। এ সময় পাহাড়ের ওপরে মেঘ-কুয়াশার খেলা ভালোভাবে দেখা যায়।
ভ্রমণকালীন সতর্কতা
এই ভ্যালিতে ঘুরতে গেলে অবশ্যই দল বেঁধে যাওয়া উত্তম। সার্বিক নিরাপত্তার প্রয়োজনে কিছু জায়গায় চেকিং হতে পারে। তাই সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র, পেশাগত বা ইউনিভার্সিটির পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখা উচিত।
পাহাড়ের ওপর নির্বিঘ্নে চলাফেরা করার জন্য ভালো গ্রিপসহ মজবুত জুতা পরে যাওয়া জরুরি। খাবার পানি, শুকনো খাবার, টর্চলাইট ও প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম সঙ্গে নিতে হবে। তবে খেয়াল রাখা উচিত যে, কাঁধের ব্যাগ যেন খুব বেশি ভারী হয়ে না যায়।
নিকটস্থ পুলিশ স্টেশন ও হাসপাতালের যোগাযোগের নম্বর সংগ্রহে রাখতে হবে। পরিবেশ ময়লা বা দূষিত করা এড়িয়ে চলতে হবে। সঙ্গে খাবার নিয়ে গেলে সমস্ত উচ্ছিষ্ট এবং মোড়ক যেখানে-সেখানে না ফেলে যথাস্থানে ফেলা উচিত।
আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, কোনো অবস্থাতেই যেন তাদের সংস্কৃতির প্রতি কোনো অবহেলা বা অশ্রদ্ধার মনোভাব প্রদর্শন না হয়।
পরিশিষ্ট
বান্দরবানের মিরিঞ্জা ভ্যালির মেঘ ও পাহাড়ের নিবিড় আলিঙ্গন ভ্রমণপিপাসুদের বারবার মনে করিয়ে দেয় সাজেকের কথা। এখানকার জুমঘরগুলোর যেকোনোটিতে এক রাত কাটানো সারা জীবনের জন্য অবিস্মরণীয় এক স্মৃতি হয়ে থাকবে। সবুজ বনে আচ্ছাদিত সুবিশাল পাহাড় আর সীমান্তরেখায় সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি ট্রেকিংয়ের ক্লান্তিকে নিমেষে ভুলিয়ে দেয়। এই অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে এবং সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য বড় দল নিয়ে ভ্রমণ করা আবশ্যক। সেই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের যোগাযোগের নাম্বার সংগ্রহে রাখা জরুরি।