
চট্টগ্রামের একটি উপজেলা বাঁশখালী। এখানে অবস্থিত প্রাকৃতিক ইকোপার্ক। প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত উঁচু-নিচু পাহাড়, লেকের স্বচ্ছ পানি, বনাঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত তটরেখা নিয়ে গঠিত হয়েছে ইকোপার্কটি। ২০০৩ সালে ১ হাজার হেক্টর বনভূমি নিয়ে বাঁশখালী ইকোপার্ক গঠন করা হয়। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৫০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় শীলকূপ ইউনিয়নে বামেরছড়া ও ডানেরছড়া এলাকার সমন্বয়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি জলদি অভয়ারণ্য রেঞ্জের জলদি ব্লকে অবস্থিত।
যাই হোক অফিস শেষে আমরা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রওনা দিই। সবাই প্রথমে কর্ণফুলী ব্রিজে এসে এক হলাম। সেখান থেকে জনপ্রতি ১০ টাকা দিয়ে ব্রিজ পার হয়ে মইজ্জারটেক আসি। মইজ্জারটেক থেকে অটোরিকশায় উঠলাম। এখান থেকে জলদি পর্যন্ত জনপ্রতি ১২০ টাকা। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাই বাঁশখালীর জলদিতে। জলদিতে আমার খালার বাড়ি। সেখানেই হবে আমাদের রাত যাপন।
সবাই খালার বাড়িতে উঠে গ্রামের শাকসবজি আর তাজা মাছ দিয়ে রাতের খাবার খেলাম। পরদিন শুক্রবার সকালে আমাদের গন্তব্য হচ্ছে ইকোপার্ক। সকাল ৮টায় ঘুম থেকে উঠে খেজুরের রস দিয়ে খেলাম ভাপা পিঠা। এরপর রওনা দিলাম ইকোপার্কের উদ্দেশে।
এর মাঝে এ ইকোপার্কের ইতিহাসটাও জেনে রাখা ভালো। বাংলাদেশ সরকার বন্যপ্রাণী ও বনজসম্পদ রক্ষার্থে ১৯৮৬ সালে প্রায় ৭ হাজার ৭৬৪ হেক্টর বনভূমি নিয়ে ‘চুনতি অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করে। পরে বামেরছড়া ও ডানেরছড়া প্রকল্প দুটিও চুনতি অভয়ারণ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ অভয়ারণ্যে ছোট-বড় অনেক পাহাড়, খাল ছড়া রয়েছে। ১৯৯৩ সালে এলজিইডির প্রকৌশল বিভাগ কৃষি জমিতে সেচ প্রকল্পের জন্য পাহাড়ের ঢালুতে বাঁধ নির্মাণ করে ডানের ও বামেরছড়ায় ৮০ হেক্টর নিম্নাঞ্চলের ধানি জমি চাষ উপযোগী করে। বাংলাদেশ সরকার ওই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়ন, শিক্ষা, গবেষণা, ইকো ট্যুরিজম ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বাঁশখালী ইকোপার্ক গড়ে তোলে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিনোদনপ্রেমীদের কথা চিন্তা করে ২০০৩ সালে এ ইকোপার্কটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আমরা জলদি থেকে অটোরিকশার মাধ্যমে সরাসরি ইকোপার্কের গেটে এসে নামি। অটোরিকশার ভাড়া ছিল ৫০ টাকা। এরপর ৩০ টাকা করে আমরা টিকিট কেটে ইকোপার্কের ভেতর প্রবেশ করি। ইকোপার্কে প্রবেশ করেই আমাদের সবার ভেতর এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব হলো। শহরের কাছাকাছি এত সুন্দর একটা প্রাকৃতিক ইকোপার্ক আছে অনেকেই জানে না।
সম্প্রতি করা এক জরিপ মতে, এ ইকোপার্কে ৩১০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। ধীরে ধীরে যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ১৮ প্রজাতির দীর্ঘ বৃক্ষ, ১২ প্রজাতির মাঝারি বৃক্ষ, ১৬ প্রজাতির বেতসহ অসংখ্য অর্কিড, ইপিফাইট ও ঘাসজাতীয় গাছ। এ এলাকা গর্জন, গুটগুটিয়া, বৈলাম, সিভিট, চম্পাফুল এবং বিবিধ লতাগুল্মসমৃদ্ধ চিরসবুজ বনাঞ্চলে ভরপুর ছিল। পার্ক এলাকার ৬৭৪ হেক্টর বনভূমিতে বিভিন্ন ধরনের (বাফার, ভেষজ, দীর্ঘমেয়াদি) মনোমুগ্ধকর বাগান তৈরি করা হয়েছে। আছে সুন্দর একটি লেক। এ লেকে নৌকায় করে পর্যটকরা ভ্রমণ করতে পারেন।
ইকোপার্কে বিচরণ করে কয়েক হাজার বন্য প্রাণী। ইকোপার্কের চারপাশেই পাহাড় আর পাহাড়। তবে এখানে আরও একটি বিষয় পর্যটকদের বেশ আকর্ষণীয় করে তুলে। সেটা হচ্ছে ঝুলন্ত ব্রিজ। ইকোপার্কে এলেন অথচ ঝুলন্ত ব্রিজে উঠে ছবি তুললেন না তা হয় না। একই সঙ্গে এ ঝুলন্ত ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করবেন। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য এখানেই খুঁজে পাবেন।
পার্কের উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছে পিকনিক স্পট, দ্বিতল রেস্ট হাউজ, হিলটপ কটেজ, রিফ্রেশমেন্ট কর্নার, দীর্ঘতম ঝুলন্ত ব্রিজ, ওয়াচ টাওয়ার এবং মিনি চিড়িয়াখানা। পার্কের দুটি সুবিশাল লেকে রয়েছে মাছ ধরার যাবতীয় সুব্যবস্থা। বাঁশখালী ইকোপার্কে বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের তথ্য সংবলিত একটি তথ্য ও শিক্ষা কেন্দ্র আছে।
এ ছাড়া এখানে মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, চিত্রা বিড়াল, বাঘ, মেছো বাঘ ও পাখির প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে। শীতকালে অতিথি পাখির কলরবে সরব হয়ে উঠে এই ইকোপার্কের সবুজ প্রকৃতি। ইকোপার্কের সুউচ্চ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের অথই জলরাশি, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা ঝর্ণাধারা আর বিকাল বেলায় সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য পর্যটকদের মোহিত করে।
বিকেল হতেই আমাদের ফেরার প্রস্তুতি শুরু হলো। যেভাবে এসেছিলাম ঠিক সেভাবেই ফিরলাম। ফেরার সময় মনে হলো প্রকৃতির খুব কাছ থেকে যেন আমরা ফিরে যাচ্ছি আবারও কোলাহলপূর্ণ শহরে। যেখানে বিশুদ্ধ বাতাসের বড় অভাব।
শিক্ষাকেন্দ্র
ইকোপার্কে বিচরণরত কয়েক হাজার বন্যপ্রাণী ও বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ সম্পর্কে পর্যটকরা যাতে খুব সহজেই জানতে পারেন সেজন্য ২০১১ সালের ২১ আগস্ট নির্মিত হয় তথ্য ও শিক্ষাকেন্দ্র।
কীভাবে যাবেন
বাঁশখালী ইকোপার্কে যেতে হলে প্রথমে চট্টগ্রাম শহরে আসতে হবে। বাঁশখালী থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাঁশখালী ইকোপার্ক অবস্থিত। চট্টগ্রাম থেকে বাস বা সিএনজিতে বাঁশখালী যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মতো সময় লাগে।
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল বা আকাশপথে চট্টগ্রাম যাওয়া যায়। সড়কপথে ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে সৌদিয়া, ইউনিক, টিআর ট্রাভেলস, গ্রিনলাইন ও হানিফ এন্টারপ্রাইজের বিভিন্ন বাস চট্টগ্রামের পথে যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সুবর্ণ, তূর্ণা-নিশিথা, মহানগর কিংবা চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনে চট্টগ্রাম যেতে পারবেন। আর কম সময়ে যেতে চাইলে শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ডোমেস্টিক এয়ারলাইন্সে মাত্র ৪৫ মিনিটে ঢাকা থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন
চট্টগ্রামের স্টেশন রোড, জেএসসি মোড় বা আগ্রাবাদ এলাকায় বিভিন্ন মানের হোটেল খুঁজে পাবেন। আবাসিক হোটেলের মধ্যে হোটেল স্টার পার্ক, হোটেল ডায়মন্ড পার্ক, হোটেল মিসখা, হোটেল হিল টন সিটি, এশিয়ান এসআর হোটেল, হোটেল প্যারামাউন্ট, হোটেল সাফিনা ও হোটেল সিলমন উল্লেখযোগ্য।
কোথায় খাবেন
বাঁশখালীতে সাধারণ মানের বেশ কিছু হোটেল ও মনছুড়িয়া বাজারে খুচরা চা-নাশতার দোকান আছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম শহরে বাঙালি, চাইনিজ বা ফাস্টফুডের বেশ কিছু ভালো মানের রেস্টুরেন্ট আছে। আর সুযোগ থাকলে অবশ্যই চট্টগ্রামের জনপ্রিয় মেজবানি খাবার ও কালা ভুনা খেয়ে দেখবেন।
চট্টগ্রামের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
চট্টগ্রামের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে ওয়ার সিমেট্রি, ফয়’স লেক, মহামায়া লেক, জাম্বুরি পার্ক, চন্দ্রনাথ পাহাড়, হাজারিখিল অভয়ারণ্য ছাড়াও বেশকিছু আকর্ষণীয় ঝরনা রয়েছে।
ভ্রমণ পরামর্শ
সমুদ্রসৈকতে দোকানপাট তেমন নেই, তাই শুকনো খাবার ও পানি সঙ্গে রাখুন। ফেরার সময় যানবাহনের সংকট হতে পারে, সিএনজিচালিত অটোরিকশা রিজার্ভ করে নিতে পারেন। সমুদ্রে নামার সময় সতর্ক থাকুন এবং স্থানীয় লোকজনের পরামর্শ নিন।