নয়নাভিরাম প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র্য টানে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। আর জায়গাটি যদি হয় পাহাড়, ঝরনা, জলাধার এবং অরণ্যে ঘেরা বান্দরবান, তা হলে তো কথাই নেই। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বেরিয়ে পড়লাম বান্দরবান ভ্রমণের উদ্দেশে। টিমে আমি ছাড়াও ছিল তাইজুল, রাফিদ, ইয়ানাথ এবং সিফাত। সকাল ৮টার দিকে আমরা বান্দরবান শহরে পৌঁছালাম। প্রথমেই পরের দিন ঢাকা ফেরার টিকিট কাটলাম। তার পর বেরিয়ে পড়লাম হোটেল খুঁজতে। একটু খোঁজাখুঁজির পর আমাদের পছন্দমতো হোটেল পেয়ে গেলাম।
দেবতাখুম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
হোটেলে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা করে বেরিয়ে পড়লাম দেবতাখুমের উদ্দেশে। গাড়ি চলছে উঁচু-নিচু সরু পাহাড়ি পথ দিয়ে। যেখানেই চোখ যায় কেবল উঁচু-উঁচু পাহাড়। আমাদের গাড়ি যখন যাচ্ছিল, শিশুরা হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল। আমরাও তাদের দিকে হাত নাড়ালাম। দেখলাম পাহাড়িরা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস।
গাড়ি এগিয়ে চলছে আর আমরা চারদিকের সবুজ প্রকৃতি দেখছি। পাহাড়ের গায়ে জন্মেছে আমগাছ, কলাগাছ, শালগাছ, বাঁশ আর নানা প্রজাতির বৃক্ষ। প্রায় দুই ঘণ্টার পথ পেরিয়ে ১২টার আগে আমরা চলে এলাম কচ্ছপতলিতে। সেখানে গাইড ঠিক করলাম। প্রত্যেকের এনআইডির দুই কপি করে জমা দিতে হলো। পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার জন্য বাঁশের লাঠি নিলাম। আমরা পাঁচজন হওয়ায় আমাদের দলে আরও পাঁচজনকে যুক্ত করলাম। গাইডসহ আমরা মোট ১১ জনের একটি দল। দেবতাখুম ঘুরে এসে খাওয়ার জন্য স্থানীয় মারমা হোটেলে অগ্রিম অর্ডার করে গেলাম। হোটেলের ক্যাশ কাউন্টারে বসা মারমা মেয়ের শুদ্ধ বাংলা শুনে আমরা মুগ্ধ হলাম। বেলা বেশি হওয়ায় সেখান থেকে দেবতাখুমের উদ্দেশে আমরা চান্দের গাড়ি নিলাম। ১০ মিনিট পর গাড়ি থেকে নামলাম। এর পর প্রায় ৩০ মিনিট উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ পেরিয়ে চলে এলাম দেবতাখুমে। বেলা তখন দুপুর ২টা। প্রথমে একটা ছোট্ট নৌকায় আমাদের পার করা হলো। গাইড সিরিয়াল নিলেন। ভেলা দিয়ে খুমের ভেতরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। নৌকার সিরিয়াল আগে পাওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ ভ্রমণকারীই ভেলায় করে খুম ঘুরতে চান। পর্যটকদের তুলনায় ভেলার সংখ্যা কম হওয়ায় সিরিয়াল পেতে দীর্ঘ সময় লাগল। যখন পৌঁছালাম তখন সিরিয়াল ছিল ৪২। আমাদের সিরিয়াল পড়ল ৯১। পাথরের ওপর বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কেউ কেউ পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে লাগল।
দুই পাশে বিশাল উঁচু পাহাড়। মাটি নেই, পাথর। পাথরের ফাঁকে ফাঁকেই গাছ জন্মেছে। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম- এসব পাহাড় কীভাবে তৈরি হলো? এদিকে ভেলার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বেশ বিরক্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল এত কষ্ট করে আসা যৌক্তিক কি না। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমরা ভেলার সিরিয়াল পেলাম। রাফিদ আর আমি একই ভেলায় চড়লাম। বাঁশ দিয়ে পানি বেয়ে বেয়ে ভেতরে যাচ্ছি। খুমের ভেতরে ঢুকতেই আমাদের শরীর যেন হিমশীতল হয়ে উঠল। দুই পাশে খাড়া পাহাড়ের মাঝখানে স্বচ্ছ পানির জলাধার। এটাকেই খুম বলে। মাঝপথে বড় পাথরের কারণে সেখানে পানি কম। একজন লোক দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছেন যাতে কেউ পাথরের ওপর নামতে না পারে। এর একটু সামনে যেতেই দেখলাম পথ আরও সরু হয়ে গেছে। পথ সরু হওয়ায় সেখানে অনেকে ভেলা নিয়ে অপেক্ষা করছে। এর পর সরু পথ পেরিয়ে আরও সামনে গেলাম।
খুমের ভেতরে ঠাণ্ডা আর ভূতুরে পরিবেশ। যত ভেতরে যাই ততই মুগ্ধ হই। শেষ প্রান্তে গিয়ে পাথরের ওপর নামতে চাইলাম কিন্তু সেখানেও একজন লোক বসে আছেন। আমরা নামতে চাইলে তিনি বারণ করলেন। কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করলাম আর প্রকৃতি উপভোগ করতে লাগলাম। ঠাণ্ডা পানিতে পা ভেজালাম। কিছুক্ষণ থাকার পর আমরা ধীরে ধীরে ফিরতে লাগলাম। আমরাই সবশেষে খুম থেকে ডাঙ্গায় উঠলাম। সুয্যিমামা ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে মুখ লুকিয়েছে। পশ্চিম আকাশে একটিমাত্র তারা জ্বলজ্বল করছে।
চিম্বুক পাহাড় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
বেলা সাড়ে ১১টায় হোটেল থেকে বের হলাম শৈলপ্রপাত, চিম্বুক পাহাড় এবং নীলগিরি যাওয়ার জন্য। ৩০০০ টাকায় একটি মাহিন্দ্রা ঠিক করলাম। শুরু হলো ভ্রমণ। যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশের পাহাড় দেখলাম। দেখলাম পাহাড়ি নারীরা কাঁধে বয়ে কী যেন নিয়ে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর শৈলপ্রপাত ঝরনায় গাড়ি থামল।
সেখানে কিছুক্ষণ থেকে চলে এলাম চিম্বুক পাহাড়ে। টিকিট কেটে আমরা পাহাড়ের চূড়ায় গেলাম। সেখানে পর্যটকদের বসার ব্যবস্থা আছে। আছে থাকা ও খাওয়ার হোটেলও। যখন চিম্বুক পাহাড়ে উঠলাম, তখন আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫০০ ফুট উঁচুতে। দূরে দেখলাম পাহাড়। চারপাশের চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য মনকে প্রশান্ত করল। সেখানে পাথরের চেয়ার ও টেবিলে বসে বন্ধুরা মিলে মজা করলাম। তার পর ফিরে এলাম গাড়িতে।
নীলগিরি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
আবার চলতে শুরু করল আমাদের গাড়ি। শেষ গন্তব্য নীলগিরি। গাড়ি এগিয়ে চলছে আর আমরা দুই দিকের পাহাড় দেখে বিস্মিত হচ্ছি। নিচের দিকে যখন তাকাই তখন ভয় করে। গাড়ি যখন নীলগিরি গিয়ে থামল, তখন বিকেল ৫টা বাজে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তখন আমরা ২২০০ ফুট উঁচুতে। শীতল বাতাস শরীর, মন ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে। চারপাশে হালকা হালকা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আমরা মেঘের ওপরে আর মেঘ আমাদের নিচ দিয়ে যাচ্ছে। এজন্যই বুঝি নীলগিরিকে বাংলার দার্জিলিং বলা হয়।
দূরে সবুজ পাহাড় যেন মিশে গেছে আকাশের সঙ্গে। চারপাশের হালকা মেঘ আর দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ দেখে মুগ্ধ হলাম। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। সিফাত, রাফিদ আর তাইজুল সূর্য খাচ্ছে আর আমি ওদের সূর্য খাওয়ার ছবি তুলছি। ভাবলাম আমিও সূর্য খাওয়ার একটা ছবি তুলি। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সুয্যিমামা কোথায় যেন চলে গেল- তার আর দেখা পেলাম না! এত তাড়াতাড়ি সূর্য অস্ত যায়, আগে দেখিনি। নীলগিরিতে রিসোর্টের পর্যটক বাদে সবাইকে ৬টার মধ্যে চলে আসতে হয়। তাই এবার ফেরার পালা। আমরা গাড়িতে উঠলে বান্দরবান শহরের দিকে চলতে শুরু করল।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সৌদিয়া, সেন্টমার্টিন, এস আলম, হানিফ, ইউনিক, শ্যামলী ইত্যাদি পরিবহনের বাস বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। জনপ্রতি ভাড়া নন-এসি ৯০০ টাকা ও এসি ১৫০০-১৮০০ টাকা। ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে বাসে বান্দরবান যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে প্রতিদিনই পর্যটক এক্সপ্রেস, কক্সবাজার এক্সপ্রেস, সোনার বাংলা, সুবর্ণ, মহানগর ইত্যাদি ট্রেন চট্টগ্রাম যায়। শ্রেণিভেদে ট্রেনের টিকিটের মূল্য ৪০৫-১৪০০ টাকা পর্যন্ত।
এ ছাড়া চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাসস্টেশন থেকে বান্দরবানে যাওয়া যায়। পূর্বাণী, পূবালী নামের বাস বান্দরবান যায়। এসব বাসে জনপ্রতি ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা ভাড়া লাগে।
কোথায় থাকবেন
বান্দরবানে থাকার জন্য অনেক হোটেল আছে। এর মধ্যে হোটেল প্লাজা, হোটেল হিল ভিউ, রিভার ভিউ, পর্যটন, নাইট হ্যাভেন, হোটেল স্কাই ব্লু ইত্যাদি। এসব হোটেলে ১৫০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে রুম ভাড়া পাবেন। যেখানে ৪/৫ জন এক রুমে থাকতে পারবেন।
খাওয়া-দাওয়া
দেবতাখুম যাওয়ার পথে কচ্ছপতলিতে খাবার অর্ডার করে যেতে পারেন। কারণ খুম ভ্রমণ করে এসে হয়তো আপনি খাবার পাবেন না বা অনেক দেরি হবে। কী কী খাবেন, কতজন খাবেন তা আগে থেকে বলে গেলে তারা আপনার জন্য রান্না করে রাখবে। ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যেই আপনি খেতে পারবেন। আর শৈলপ্রপাত, চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরির পথে যখন যাবেন, তখন সঙ্গে করে শুকনো খাবার নিয়ে যেতে পারেন। তবে সেখানেও খাবারের ব্যবস্থা আছে।
সতর্কতা
দেবতাখুমে যেতে হলে অবশ্যই দুপুর ১২টার মধ্যে কচ্ছপতলিতে থাকতে হবে। কারণ ১২টার পর আর্মি দেবতাখুমে যাওয়ার অনুমতি দেয় না। আর বিকেল ৪টার পর দেবতাখুমে কোনো পর্যটক থাকেন না। এ ছাড়া শৈলপ্রপাত, চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরি এই পথে বিকেল ৪টার পর আর কোনো গাড়ি যায় না। নীলগিরিতে রিসোর্টে যদি না থাকেন, তা হলে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ফিরে আসতে হবে। পাহাড়ি এসব
উঁচু-নিচু রাস্তা বৃষ্টির দিনে বিপজ্জনক। তাই এসব বিষয়ে সতর্ক থাকুন।
প্রয়োজনীয় ভ্রমণ পরামর্শ
পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথে হাঁটতে হাঁটতে ডিহাইড্রেট (পানিশূন্যতা) হয়ে যেতে পারেন। তাই এসব পাহাড়ি পথে ভ্রমণের সময় অবশ্যই পর্যাপ্ত পানি সঙ্গে নেবেন। সঙ্গে শুকনো খাবার নিয়ে যেতে পারেন। দেবতাখুম যেতে হলে গাইডকে এক হাজার টাকা দিতে হয়। একজন গাইডের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১০ জন যেতে পারবেন। তাই লোক বেশি হলে খরচ কমবে। গাইড ঠিক হয়ে গেলে ৫০ টাকা দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। এর পর আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ২ কপি জমা দিতে হবে। তাই সঙ্গে করে এনআইডির ফটোকপি নিয়ে নিবেন।
নীলগিরি যেতে আর্মির চেকপোস্ট আপনার এনআইডি দেখতে চাইবে। এসব স্থান ভ্রমণের সময় মোবাইলে পর্যাপ্ত চার্জ দিয়ে নিয়ে যান। যদিও সব জায়গায় আপনি নেটওয়ার্ক পাবেন না। ট্রেকিংয়ের জন্য বুট, প্লাস্টিক বা রাবারের স্যান্ডেল ব্যবহার করতে পারেন। দেবতাখুমে বাঁশের ভেলার সিরিয়াল আগে পেতে হলে আগে যেতে হবে। ভেলা বা নৌকা যেটাতেই চড়েন না কেন, অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরে যাবেন। পাহাড়ে বসবাসরত মানুষের সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন। অনুমতি না নিয়ে কারও ছবি তুলবেন না।