
ছাগলকান্দা ঝরনা চট্টগ্রাম বিভাগের সীতাকুণ্ড উপজেলার এক মনোরম ও অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত প্রাকৃতিক জলপ্রপাত। এটি মূলত সীতাকুণ্ডের কমলদহ ট্রেইলে অবস্থিত এবং কমলদহ ঝরনার ধারাবাহিকতায় উপরের দিকে অবস্থিত হওয়ায় অনেকেই একে ‘কমলদহ-২’ বলেও ডাকেন। ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে এটি এক অপার বিস্ময়ের নাম হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
এই ঝরনাটি একটি ক্যাসকেড (ধাপে ধাপে গঠিত) টাইপের ঝরনা, যার তিনটি ধাপ রয়েছে। নিচ থেকে সাধারণত প্রথম ধাপটিই সহজে দেখা যায়। বাকি দুটি ধাপে পৌঁছাতে হলে আপনাকে উঁচু পাহাড়ি পথে আরোহণ করতে হবে, যা একদিকে যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনই ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে। বর্ষাকালে ঝরনার পানি প্রবাহ সবচেয়ে বেশি থাকে এবং তখন ঝরনার সৌন্দর্য প্রকৃত অর্থে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
ছাগলকান্দা ঝরনায় পৌঁছানোর জন্য প্রথমে ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহর থেকে সীতাকুণ্ড উপজেলার বড় দারোগারহাট বাজারে যেতে হবে। এই বাজার থেকে মহাসড়কের পাশে একটি মাটির পথ ধরে ২৫-৩০ মিনিট হেঁটে ঝিরিপথে পৌঁছাতে হয়। এই ঝিরিপথ ধরে হাঁটলে প্রথমে দেখা যায় কমলদহ ঝরনা, এরপর পাহাড়ি পথে উঠে ছাগলকান্দা ঝরনায় পৌঁছাতে হয়। যাত্রাপথটি কষ্টসাধ্য হলেও প্রাকৃতিক দৃশ্য, ঝিরিপথে হাঁটার অভিজ্ঞতা, পাখির কুজন এবং পানির শব্দ- সব মিলিয়ে এটি এক চমৎকার অভিজ্ঞতা।
ঝরনা দর্শনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো বর্ষাকাল (জুন থেকে সেপ্টেম্বর)। তবে এই সময় পথ অনেকটাই পিচ্ছিল ও দুর্গম হয়ে পড়ে, তাই সাবধানে চলাফেরা করা অত্যন্ত জরুরি। গ্রুপে গিয়ে গাইডের সহায়তা নেওয়া বাঞ্ছনীয়। নিরাপত্তার স্বার্থে ঝরনার উঁচু ধাপে না উঠাই ভালো, বিশেষ করে যদি আপনার অভিজ্ঞতা কম থাকে।
সব মিলিয়ে ছাগলকান্দা ঝরনা হলো এক নিখুঁত গন্তব্য- যেখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আপনি পেতে পারেন মানসিক প্রশান্তি, রোমাঞ্চকর অভিযান এবং অপার সৌন্দর্যের ছোঁয়া। এটি এমন একটি স্থান, যা একবার গেলে স্মৃতির পাতায় আজীবন জায়গা করে নেবে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ছাগলকান্দা ঝরনায় যেতে চাইলে প্রথমে চট্টগ্রামগামী বাসে চরে জনপ্রতি ৪০০-১২০০ টাকা ভাড়ায় সীতাকুণ্ডের বড় দারোগারহাট বাজারে চলে আসুন। আর ট্রেনে করে যেতে চাইলে সবচেয়ে ভালো হয় ফেনী রেলওয়ে স্টেশন নেমে গেলে। ট্রেনের টিকিটের ভাড়া জনপ্রতি ২৬৫-৯০৯ টাকা। ফেনী রেলওয়ে স্টেশন থেকে লোকাল বাসে করে বড় দারোগারহাট বাজারে চলে আসতে পারবেন।
বড় দারোগারহাট বাজার থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে গেলে একটা ইটখোলা পাবেন। এই ইটখোলা পার হয়ে ডানের মাটির রাস্তা ধরে কিছুদূর গেলে ঝিরি পথ দেখা যাবে। মূলত এই ঝিরি পথ ধরেই কমলদহ ঝরনার দেখা পাওয়া যাবে। কমলদহ ঝরনা পার হয়ে ঝিরি পথ ধরে ওপরের দিকে গেলে ছাগলকান্দা ঝরনা পৌঁছে যাবেন।
কমলদহ ঝরনার ওপরে ওঠে ছোট একটি ক্যাসকেড পার হয়ে ঝিরি পথে কিছুটা এগিয়ে গেলে সামনে দেখতে পাবেন ঝিরি পথ দুই ভাগ হয়ে ডান ও বাম দিকে চলে গেছে। প্রথমে হাতের বাম দিকের ঝিরি পথ ধরে এগিয়ে যান। এই ঝিরি পথে গেলে কিছুটা দূর গেলে আবারও হাতের ডান দিকে আরেকটি ঝিরি পথ পাবেন। সোজা ঝিরি পথে একটু এগোলেই ছাগলকান্দা ঝরনা দেখতে পাবেন।
কোথায় থাকবেন
মিরসরাইতে রাত্রি যাপন করার মতো তেমন কোনো আবাসিক হোটেল নেই। সেজন্য আপনাকে থাকতে হবে সীতাকুণ্ডে। সীতাকুণ্ডে বাজারের মধ্যে কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সাইমুন হোটেল। এর ভাড়া পড়বে প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে।
খুব বেশি উন্নত মানের রেস্তোরাঁ বা হোটেল পাওয়া যাবে না এখানে। তা ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের ডাকবাংলোও রয়েছে। আবার আরও কিছুটা ভালো মানের হোটেল পাওয়া যাবে বারৈয়ারহাট বা ভাটিয়ারীতে। এগুলোর সিঙ্গেল রুম নন-এসির ভাড়া ৬০০ টাকা এবং দুই বিছানার এসি রুমের ভাড়া পড়বে ১২০০ টাকা।
সতর্কতা
পাহাড়ি ঝরনা দেখতে যাওয়া এক দারুণ অভিজ্ঞতা হলেও এর সঙ্গে কিছু ঝুঁকিও জড়িত থাকে। নিরাপদ ও আনন্দদায়ক ভ্রমণের জন্য নিচের সতর্কতাগুলো মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-
◉ সঠিক পোশাক ও জুতা পরুন। পাহাড়ি পথে হাঁটার জন্য গ্রিপযুক্ত, স্লিপরোধী জুতা পরা ভালো।
◉ হালকা ও দ্রুত শুকায় এমন কাপড় পরা ভালো; সুতির কাপড় পানিতে ভিজলে ভারী হয়ে যায়।
◉ মৌসুম বুঝে যান। বর্ষাকালে ঝরনায় পানি বেশি থাকে, ঝুঁকিও বেশি থাকে। এ সময় পথ পিচ্ছিল হয়ে পড়ে।
◉ শুষ্ক মৌসুমে পানি কম থাকতে পারে, তবে পথ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।
◉ ঝরনার আশপাশের পাথরগুলো ভেজা ও পিচ্ছিল থাকে, সেখানে পা রাখার সময় খুব সাবধানে চলুন।
◉ ঝরনার নিচে সাঁতার বা ঝাঁপ না দেওয়া। পানির গভীরতা বোঝা কঠিন, নিচে পাথরও থাকতে পারে। অজানা জায়গায় ঝাঁপ দিলে গুরুতর আঘাত পেতে পারেন।
◉ পাহাড়ি পথে একা না গিয়ে দলবদ্ধভাবে যান। একজন বিপদে পড়লে অন্যরা সহায়তা করতে পারে।
◉ পথ না চেনা থাকলে স্থানীয় গাইড নিতে পারেন। এতে পথ হারানোর বা বিপদে পড়ার আশঙ্কা কমে।
◉ পর্যাপ্ত খাবার ও পানি সঙ্গে রাখুন। পাহাড়ি পথে দোকান না-ও থাকতে পারে, তাই শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্গে নিন।
◉ পাওয়ার ব্যাংক বা অতিরিক্ত চার্জড মোবাইল রাখুন। দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় যোগাযোগের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।
◉ ছোটখাটো আঘাত, কেটে যাওয়া বা মশার কামড়ের জন্য ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক, ওষুধ রাখুন।
◉ এখানে সেখানে কোনো ধরনের পলিথিন, বোতল বা খাবারের প্যাকেট না ফেলে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করুন।
◉ পানির স্রোত বা আকস্মিক বন্যা সম্পর্কে সচেতন থাকুন। ঝরনার উৎসে হঠাৎ পানি বাড়লে আকস্মিক বন্যা হতে পারে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে ভ্রমণ করুন।
এই সাবধানতাগুলো মেনে চললে পাহাড়ি ঝরনা ভ্রমণ হয়ে উঠবে নিরাপদ, উপভোগ্য ও স্মরণীয়।
চট্টগ্রামের আরও কিছু দর্শনীয় স্থান
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এখানে পাহাড়, সমুদ্র, ঝরনা ও ধর্মীয় স্থাপনাসহ অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, ফয়’স লেক, বাটালি হিল, সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন, চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মন্দির, মহামায়া লেক, গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত, কর্ণফুলী নদী, সুবর্ণদ্বীপের পাশে নতুন পর্যটন স্পট, কমলদহ ঝরনা-১, হাটহাজারী বড় মাদরাসা ও মসজিদ, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, বায়েজিদ বোস্তামী দরগাহ ও কচ্ছপ পুকুর, ডুমুরিয়া ঝরনা, আলি কদমের নাফাখুম জলপ্রপাতের মতো পাহাড়ি দৃশ্য, মিনি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম জাদুঘর, শাহ আমানত সেতু ও কর্ণফুলী টানেল এলাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও তার পাহাড়ি ট্রেইল ও লেকে ভ্রমণ। এগুলোর অনেকগুলোই পাহাড়, সমুদ্র ও ঝরনার মিশেলে গঠিত হওয়ায় চট্টগ্রাম প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক স্বর্গভূমি।