
সমসাময়িক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর তালিকায় নজর দিলে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়, তা হলো প্রায় প্রত্যেকটি দেশেরই সামরিক শক্তি অভাবনীয়। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে অথবা কথিত সেই দুঃস্বপ্নের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখতে পাওয়া যায়, বিশ্বমোড়লরা কীভাবে তাদের সামরিক শক্তির ঝুলি দিনদিন আরও ভারী করছে। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় অদৃশ্য এক কোণে বসে বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের দিকে কিছুটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি রাখার প্রচেষ্টাই ‘সামরিক শক্তির আদ্যোপান্ত’ সিরিজ। এই সিরিজের প্রথম লেখা রাশিয়ার সামরিক শক্তি নিয়ে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর গোড়াপত্তন করেন পিটার দ্য গ্রেট আলেক্সিয়েভিচ। ’১৮ শতকের সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ায় বসে দেশের প্রতিরক্ষা খাতকে শক্তিশালী করে সীমানা বাড়ানোর লক্ষ্যেই তিনি সামরিক শক্তির আধুনিকায়নের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার এই দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফসল কয়েক শতক ধরে পেয়ে আসছে রাশিয়া। ১৮১২ সালে নেপোলিয়নকে হারানোর পাশাপাশি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয় কাটিয়ে ওঠার পেছনে এক দৃঢ় সামরিক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে ‘রেড আর্মি’ নামক শক্তিশালী গণবাহিনী গঠন করে দেশটি। বিপ্লবের স্পৃহা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে এই বাহিনীতে মূলত সাধারণ মানুষ, কৃষক, কর্মচারীরা যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে হারানোর পেছনে রেড আর্মির আত্মত্যাগের কথা এখনো দেশটিতে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর নবগঠিত রাশিয়ার সামরিক বাহিনী বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হয়। অর্থ বরাদ্দের ঘাটতি, প্রায় অকেজো হয়ে পড়া অস্ত্রের পাশাপাশি আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়ে যখন দেশটির সামরিকক্ষেত্র পর্যুদস্ত ঠিক তখন হাল ধরেন ভ্লাদিমির পুতিন।
২০০০ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাশিয়ার সামরিক শক্তির এক আশ্চর্য পুনরুত্থান দেখেছে বিশ্ব। ২০০৮ সালে জর্জিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্ব, হালের সিরিয়া ও ইউক্রেনে সামরিক অভিযান - এসব ঘটনা থেকে রাশিয়ার সামরিক পেশাদারিত্ব, অস্ত্রের বহরে আধুনিকায়ন এবং বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনার পরিচয় পাওয়া যায়।
সামরিক গঠন ও মানবশক্তি:
রাশিয়ার সামরিক গঠন বেশ সুসংগত। সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনীর পাশাপাশি তাদের রয়েছে স্ট্র্যাটেজিক মিসাইল ট্রুপসের মতো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে দক্ষ বাহিনী। এ ছাড়া ন্যাশনাল গার্ডের মতো আধাসামরিক বাহিনীও রয়েছে।
বর্তমানে দেশটির সামরিক বাহিনীগুলোতে মোট ৩ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন বা ৩৫ লাখ ৭০ হাজার সদস্য কর্মরত। এর মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ সেনাসদস্য সরাসরি দায়িত্বে আছেন। বাকিদের সংকটাপন্ন অবস্থার জন্য রাখা হয়েছে।
রাশিয়ার সামরিকবাহিনীর অস্ত্রবহর বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ১২ হাজারেরও বেশি ট্যাঙ্কের পাশাপাশি তাদের রয়েছে প্রায় চার হাজার ২৫৫টি যুদ্ধবিমান। নৌবাবাহিনীতে সাধারণ জাহাজের পাশাপাশি কিছু জাহাজ পারমাণবিক শক্তিচালিত হওয়ায় নৌপথেও বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ রাশিয়া।
পারমাণবিক শক্তি:
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পারমাণবিক কাঁচামালের মজুদ রাশিয়ার দখলে। মোট পাঁচ হাজার ৮৮৯টি পারমাণিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে রেখেছে দেশটি। এর মধ্যে এক হাজার ৬৭৪টি তাক করা আছে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের দিকে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পারমাণবিক অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- ল্যান্ড-বেইজড আইসিবিএমএস, সাবমেরিন-লঞ্চড ব্যালিস্টিক মিসাইল (এসএলবিএমএস) এবং স্ট্র্যাটেজিক বম্বার্স। প্রত্যেকটি ক্ষেপণাস্ত্রই ব্যাপক শক্তিশালী।
যুদ্ধ-পরস্থিতিতে সীমানা বাড়ানোর লক্ষ্যে ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পারমাণবিক নীতিতে বিশ্বাস করে ক্রেমলিন। সম্প্রতি ইউক্রেনে নিক্ষেপিত দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের উদাহরণ থেকেই রাশিয়ার যুদ্ধনীতি আন্দাজ করা সম্ভব।
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও আধুনিকায়ন:
২০০৮ সালে প্রতিরক্ষা খাত সংস্কারের সময় থেকেই সামরিক শক্তির আধুনিকায়নে জোর দিচ্ছে মস্কো। সোভিয়েত যুগের ট্যাঙ্কগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি প্রতিস্থাপনের পাশাপাশি সমসাময়িক আরমাটা টি-১৪ ট্যাঙ্কও রয়েছে রাশিয়ার অস্ত্রবহরে।
এ ছাড়া প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার ট্যাঙ্ক এবং তিন হাজার সাঁজোয়া যান তৈরি করে দেশটি।
তবে বেশিরভাগ সময় পুরোনো ধাঁচের ট্যাঙ্কগুলো সারাতে প্রচুর ব্যয় হওয়ায় আরও আধুনিক অস্ত্রের দিকে আগাতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তারা। একই চিত্র ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনকেন্দ্রগুলোতেও। বিপুল পরিমানে বার্ষিক উৎপাদন সম্ভব হলেও আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্রের আমদানীব্যয়ের চাপে কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছে।
চলমান সামরিক বিপত্তি:
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা ও দুর্বলতা উভয়ই প্রকাশ পায়। দীর্ঘমেয়াদি আক্রমণের ক্ষেত্রে রাশিয়ার সংগঠিত আক্রমণ কার্যকর বিবেচিত হচ্ছে। তবে নির্দেশনার সমন্বয়ের বিষয়ে দেশটি কিছুটা দুর্বল প্রতিপন্ন হয়েছে বলা যায়। এই যুদ্ধে রাশিয়া কয়েক হাজার ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান হারানোয় পুরোনো মজুদ অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া নতুন করে সামরিক সদস্যগ্রহণের চেষ্টা চললেও সব মিলিয়ে রাশিয়ার বর্তমান সামরিক মনোবল তুলনামুলক কম বললে ভুল হবে না।
এদিকে প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়া উল্লেখযোগ্য উন্নতি করলেও গোলাবারুদ ও আধুনিক অস্ত্রসংকটের মুখে মস্কো। রাশিয়া যে ধারায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে তার বিপরীতে অস্ত্রের যথেষ্ট যোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন:
বাধা সত্ত্বেও ইউরোপ, মধ্য-এশিয়া এবং আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়া নিজের প্রতিপত্তি বজায় রেখেছে। গতানুগতিক দুর্বলতা যে খামতি সৃষ্টি করছে, বিভিন্ন ‘গুপ্ত কৌশল’ কাজে লাগিয়ে সেটা পূরণ করে ফেলছে তারা। সাইবার যুদ্ধ, গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার মতো পদ্ধতিতে দেশটি নিজের ক্ষমতায় নূন্যতম ফাটলও তৎক্ষণাৎ সারিয়ে ফেলে।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার অস্ত্রের বহরে সংকট দেখা দিয়েছে। ফলস্বরূপ এই মুহুর্তে তৃতীয় কোনো দেশ সরাসরি যুদ্ধক্ষত্রে রাশিয়াকে আক্রমণ করলে বেশ বিপাকেই পড়তে হবে তাদের। তবুও পারমাণবিক ক্ষেত্রে বিপুল বরাদ্দ ও বিশাল সামরিক বাহিনীর ওপর ভর করে বিশ্বমোড়লের তালিকায় নিজেদের শক্ত অবস্থান টিকিয়ে রাখতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে না।
ভবিষ্যত:
যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকর অস্ত্র সরবরাহের পাশাপাশি আধুনিক যুদ্ধনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার দ্বিমুখী বাধার মুখে দাঁড়িয়ে রাশিয়া। ভবিষ্যতে দেশটির সামরিক নীতি কী হবে এ বিষয়ে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। চলমান যুদ্ধ ও ভূরাজনৈতিক স্নায়ু যুদ্ধে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে হলে রাশিয়াকে সামরিক খাত আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে দেশটির জনগণের মধ্যে পুতিন কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারেন এটাই দেখার বিষয়। সূত্র: কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস, বিবিসি ও আল-জাজিরা
নাইমুর/পপি/অমিয়/