
সমসাময়িক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর তালিকায় নজর দিলে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায় তা হলো, প্রায় প্রতিটি দেশেরই সামরিক শক্তি অভাবনীয়। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে অথবা কথিত সেই দুঃস্বপ্নের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, বিশ্ব মোড়লরা কীভাবে তাদের সামরিক শক্তির ঝুলি দিন দিন আরও ভারী করছে। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় অদৃশ্য এক কোণে বসে বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের দিকে কিছুটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি রাখার প্রচেষ্টাই ‘সামরিক শক্তির আদ্যোপান্ত’ সিরিজ। এই সিরিজে আজ থাকছে পাকিস্তানের সামরিক শক্তির বিস্তারিত-
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দখল থেকে ভারতবর্ষের মুক্তির পর পাকিস্তানের সামরিক শক্তির উত্থান ঘটে। স্বাধীনতাপরবর্তী দাঙ্গা ও আঞ্চলিক সহিংসতা ঠেকাতে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এরপর প্রায় সাত যুগ পেরিয়ে বিশ্ব দরবারে বেশ শক্তিশালী সামরিক অবস্থান দাঁড় করিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তির এই দেশ। দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জাতীয় সুরক্ষানীতি সংরক্ষণে তাদের সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পাকিস্তান প্রথম সামরিক দ্বন্দ্বে জড়ায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ১৯৪৭-৪৮ সালের দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই ভারত-পাকিস্তান প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রপাত। এরপর ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে এবং ১৯৭১ সালে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশটির সামরিক বাহিনী সরাসরি অংশ নেয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের সামরিক নীতিতে ব্যাপক রদবদল ঘটে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৯৯ সালে সংঘটিত কার্গিল যুদ্ধে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে সামরিক সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে।
বৈশ্বিক স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত জোট সিয়াটো (SEATO) এবং সেন্টোতে (CENTO) যোগ দিয়ে সামরিক খাতে বিশেষ সুবিধা অর্জন করে তারা।
এ ছাড়া ১৯৮০ সালের সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার মাধ্যমে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে নিজদের সামরিক অবস্থান শক্তিশালী পর্যায়ে নিয়ে গেছে দেশটি।
বর্তমান সামরিক সক্ষমতা
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্সের (জিএফপিআই) তথ্য অনুযায়ী, ১৪৫টি দেশের মধ্যে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থান নবম। সেনা, বিমান ও নৌ - এই তিন বাহিনীর সাহায্যে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসেবে সমীহ কুড়াচ্ছে দেশটি।
এ ছাড়া দেশটির অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা ও সংকট মোকাবিলায় রয়েছে রেঞ্জারস ও ফ্রন্টিয়ার কর্পসের মতো আধাসামরিক বাহিনী। আঞ্চলিক ও জাতীয় প্রতিরক্ষা খাতেই পাকিস্তান বেশি প্রাধান্য দেয়।
দেশটিতে বর্তমানে সাড়ে ৬ লাখ সামরিক সদস্য সরাসরি কর্মরত। সংকটাপন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আছে আরও ৫ লাখ সদস্য। বার্ষিক জিডিপির প্রায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয় দেশটির সামরিক খাত। এই বরাদ্দের পরিমাণ অর্থের হিসাবে প্রায় ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সেনাবাহিনী
পাকিস্তানের সামরিক খাতের সবচেয়ে বড় শাখা দেশটির সেনাবাহিনী। তাদের অস্ত্রের বহরে আছে ৩ হাজার ৭০০টির বেশি ট্যাংক। এই ট্যাংকগুলোর মধ্যে দেশের উৎপাদিত আল-খালিদ এবং টি-৮০ইউডিও রয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশেষায়িত দল স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি) দেশের যেকোনো সংকটে কার্যকর অবদান রাখে। জঙ্গি ও দেশদ্রোহী তৎপরতা ঠেকাতে বেশ সক্ষম তারা।
বিমানবাহিনী
প্রায় ১ হাজার ৪০০টি সামরিক বিমান থাকায় দেশটির বিমানবাহিনী সহজেই তাদের কাজ সম্পন্ন করতে পারে। তাদের বিমানের বহরে রয়েছে এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন, মিরাজ ৩/৫ এবং জে-১৭ থান্ডারের মতো যুদ্ধবিমান। এর মধ্যে জে-১৭ থান্ডার আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে শত্রুঘাঁটিতে উল্লেখযোগ্য আঘাত করতে সক্ষম।
নৌবাহিনী
আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের নৌবাহিনী কার্যকর ভূমিকা পালন করে। আরব সাগরের পাকিস্তানসংলগ্ন অঞ্চলের প্রতিরক্ষা নিশ্চিতের পাশাপাশি পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের প্রতিরোধে দেশটির নৌবাহিনী অত্যন্ত তৎপর।
পাকিস্তানের নৌবহরে রয়েছে - আগস্টা ৯০বি-ক্লাসের মতো শক্তিশালী সাবমেরিন। সাবমেরিন-লঞ্চড ব্যালিস্টিক মিসাইলসের (এসএলবিএমএস) মাধ্যমে পারমাণবিক বোমা ছুড়তে সক্ষম এই নৌযান। এটি সম্প্রতি আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
চীন থেকে আমদানি করা টাইপ ০৫৪এ/পি ফ্রিগ্রেটগুলো পাকিস্তানের নৌসক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
পাকিস্তানের সামরিক নীতি
বিশ্বের যে ৯টি দেশের অস্ত্রের বহরে পারমাণবিক বোমা আছে তার মধ্যে পাকিস্তান অন্যতম। ১৯৭৪ সালে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার কূটনৈতিক উত্তরে এই খাতে গবেষণা শুরু করে দেশটি। দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করতেই পরমাণু খাত শক্তিশালী করা হয়েছে বলে সম্প্রতি এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
তবে ১৯৯৮ সালের পরীক্ষার পর পারমাণবিক শক্তি প্রদর্শনের বিপরীতে অবস্থান নেয় দেশটি।
পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের বহরে আছে শাহিন-৩-এর মতো দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। শাহিন-৩ প্রায় ২ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম।
এ ছাড়া নাসর মিসাইল নামের ট্যাকটিকাল নিউক্লিয়ার ওয়েপন (টিএনডব্লিউ) ভারতের বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধে খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
এদিকে পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এ শক্তি প্রত্যাহারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তান।
তবে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে (এনপিটি) নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার কারণ দেখিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে দেশটি।
সামরিক আধুনিকায়ন প্রচেষ্টা
গত এক দশকে পাকিস্তানের সামরিক খাতে ব্যাপক আধুনিকায়ন ঘটেছে। চীনের সঙ্গে শক্তিশালী কূটনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে জেএফ-১৭-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সম্পন্ন করেছে দেশটি।
এ ছাড়া তুর্কির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে আধুনিক ড্রোন এবং অস্ত্র আমদানি করেছে তারা।
এদিকে জার্ব-ই-আজব এবং রাদ-উল-ফাসাদের মতো জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সাইবার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর যুদ্ধের ময়দানে শক্তিশালী জায়গা দখল করে রেখেছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশ।
সামরিক বাধা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
পাকিস্তানের সামরিক খাতে সবচেয়ে বড় বাধা অর্থনৈতিক চাপ। প্রতিরক্ষা খাতে বার্ষিক বরাদ্দের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করতে হয় বলে আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এদিকে ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের পাশাপাশি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ছে পাকিস্তানের সামরিক খাতে।
এ ছাড়া দেশের জঙ্গি তৎপরতা ও ধর্মভিত্তিক সহিংসতা ঠেকাতেই অনেকটা সামরিক শক্তি ক্ষয় হয়ে যায় দেশটির।
বাধা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সামরিক খাতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় বলা যায়। সামনের এক দশকে পাকিস্তান নিজের পারমাণবিক খাতকে আরও শক্তিশালী করবে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
এই খাতে ইতোমধ্যেই সেকেন্ড-স্ট্রাইক প্ল্যাটফর্ম ও প্রিসিশন-গিল্ডেড সিস্টেমের (পিজিএস) মতো আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে।
ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে দেশটির প্রভাব অনস্বীকার্য। আফগান শান্তি প্রস্তাবে সরাসরি অংশগ্রহণ এবং আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক মেলবন্ধন আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে পাকিস্তানের বাড়তে থাকা প্রভাবকেই আরও স্পষ্ট করে।
এ ছাড়া আধুনিক যুদ্ধনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরও উন্নত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী।
অদমনীয় জাতিসত্তা ও শক্তিশালী সুরক্ষানীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে পাকিস্তান। উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বাধার সম্মুখীন হয়েও গতানুগতিক যুদ্ধ প্রক্রিয়ার পাশাপাশি অত্যাধুনিক যুদ্ধনীতি সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে দেশটি। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশটির শান্তিপূর্ণ অবস্থান বর্তমান সময়ে এসে আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র: গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স (জিএফপিআই), দ্য ন্যাশন: পাকিস্তানস্ মিলিটারি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক ডেভেলপমেন্টস, এস আইপিআরআই আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন, আল-জাজিরা: অ্যানালাইসিস অব পাকিস্তানস কাউন্টার-টেররিজম অপারেশনস।
নাইমুর/পপি/অমিয়/