রাজনৈতিক ও পূর্ব বিরোধের জের ধরে পাবনায় হঠাৎ করে হত্যাকাণ্ড বেড়ে গেছে। গত দেড় মাসে জেলায় সাতজন খুন হয়েছেন। নভেম্বর মাসের প্রথম ১৮ দিনেই ঘটেছে পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এর মধ্যে দুদিনের ব্যবধানে খুন হয়েছেন তিনজন। আর অক্টোবর মাসে ঘটেছে দুটি হত্যাকাণ্ড। এর মধ্যে একটি ঘটনা হত্যা নাকি অপমৃত্যু তা নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। এসব হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বেড়েছে ছিনতাই, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, লুটপাটের মতো অপরাধ। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশ এখনো মাঠে পুরোপুরি সক্রিয় হয়নি। এ সুযোগে অপরাধ বেড়েছে।
তবে পুলিশ বলছে ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, প্রতি মাসে জেলায় গড়ে চার-পাঁচটি হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ের সংখ্যাটি অস্বাভাবিক নয়।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ নভেম্বর সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজের মাছের খামারে যাচ্ছিলেন পাবনা সদর উপজেলা মৎসজীবী দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক জালাল উদ্দিন (৪৫)। স্থানীয় বেতেপাড়া মোড়ে পৌঁছালে হেমায়েতপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সদস্য মুন্তাজ আলী এবং তাদের লোকজন জালালকে কুপিয়ে হত্যা করে। রাজনৈতিক বিরোধের জেরে জালাল প্রাণ হারানোর পর থেকে তার পরিবার এখন দিশেহারা।
জালালের স্ত্রী সালমা খাতুনের অভিযোগ, ‘স্থানীয় কবরস্থানের কমিটি গঠন নিয়ে জালালের ওপর মুন্তাজ ও তার লোকজন ক্ষুব্ধ ছিল। মুন্তাজের কথা না শুনেই কমিটিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রাধান্য দিয়েছিলেন জালাল। সেই ক্ষোভের আগুনে প্রাণ দিতে হলো তাকে।’ এদিকে হত্যাণ্ডের পর মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন জালালের ছেলে লাবু হোসেন। তিনি জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন।
পরদিন ১৭ নভেম্বর রাতে পাবনা শহরে তুষার হোসেন (১৬) নামে এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সে ২০২৩ সালের ২১ অক্টোবর স্কুলছাত্র সিয়াম হত্যা মামলার প্রধান আসামি। কিন্তু তুষারের মা তাসলিমা খাতুনের বক্তব্য অনুযায়ী তার ছেলে ছিল নির্দোষ। বলেন, ‘সিয়াম হত্যার সময় তুষার বন্ধুদের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিল। ওই সময় মারামারিতে রক্তাক্ত হয়েছিল তুষার। পুলিশ তাকে সেই অবস্থায় গ্রেপ্তার করায় হয়ে যায় এক নম্বর আসামি। কিন্তু আমার ছেলে হত্যা করেনি।’
তুষারের বোন আশা খাতুন বলেন, ‘আমার ভাই হত্যার সঙ্গে জড়িত কি না, বা সেই হত্যা করেছে তা প্রমাণ হবে আদালতে। আইনে তার বিচার হবে। তাই বলে হত্যার বদলে হত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না। যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে তাদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
ঠিক পরদিন ১৮ নভেম্বর সকালে ঈশ্বরদীর রূপপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে ওয়ালিফ হোসেন মানিক (৩৫) নামে এক যুবলীগ কর্মীকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০২৩ সালের ১৭ জুন ছাত্রলীগ কর্মী তাফসির আহম্মেদ মনা হত্যা মামলার আসামি ছিলেন তিনি। জামিনে বের হয়ে প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারান মানিক।
শুধু জালাল, তুষার বা মানিক নয়। গত দেড় মাসে পাবনা জেলায় ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে জেলাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। হত্যাকাণ্ড ছাড়াও অপমৃত্যু, ছিনতাই, হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও সংঘর্ষের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পুরো জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় মাসে পাবনায় সাতটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ৬০ জন। আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১১ জনকে। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড পূর্ব বিরোধ, রাজনৈতিক বিরোধ ও প্রতিশোধ প্রবণতা থেকে ঘটেছে।
এ ছাড়া গত ৮ নভেম্বর সকালে আতাইকুলা থানার গঙ্গারামপুর এলাকা থেকে আসিফ হোসেন (৩২) নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবকের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আগের দিন ৭ নভেম্বর রাতে এলাকায় একটি জলসা শুনে বাড়ি ফেরার পথে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি।
২৯ অক্টোবর বিকেলে নিখোঁজ হয়েছিলেন আতাইকুলার ভ্যানচালক রবিউল ইসলাম (৪৫)। চার দিন পর ১ নভেম্বর সকালে তার লাশ তৈলকুপি গ্রামের একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যার পর তার ভ্যানটি নিয়ে লাশ গুম করার জন্য পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়।
৩১ অক্টোবর সকালে সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়ার সিংহনগর স্কুলের সামনে পদ্মা নদীর তীরে ১২ বছরের এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন ১ নভেম্বর বিকেলে একই উপজেলার সাতবাড়িয়ার কাঞ্চন পার্কের সামনে ভাসমান অবস্থায় ২২ বছরের এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) পাবনার সভাপতি আব্দুল মতীন খান মনে করেন, ‘৫ আগস্টের পর পুলিশ প্রশাসন এখনো মাঠে পুরোপুরি সক্রিয় না থাকার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। যখন অপরাধীর বিচার হবে না, তখন অন্য অপরাধী আরও উৎসাহী হবে। প্রশাসন এখনই লাগাম টেনে না ধরলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।’
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) রেজিনূর রহমান বলেন, ‘অতীতের রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পাবনায় প্রতি মাসে সাধারণত চার থেকে পাঁচটি হত্যা মামলা হয়ে থাকে। চলতি নভেম্বর মাসে পাঁচটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি হত্যা মামলা। আর একটি মৃত্যুর মামলা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এলে বোঝা যাবে সেটি হত্যা নাকি অপমৃত্যু। সেটি সন্দেহজনক হিসেবে আছে। এরই মধ্যে প্রায় সবগুলো মামলার রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছে। অনেক আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
রেজিনূর রহমান আরও বলেন, ‘প্রতি মাসে পাবনা জেলার মামলা পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝায় যায় এগুলো স্বাভাবিক একটি বিষয়। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পুলিশের ওপর আস্থা রাখুন। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সংকট কাটিয়ে পুলিশ আরও বেশি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এখানে মানুষের আস্থা হারানোর কিছু নেই।’