
ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের কারণে খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি গোলাম রব্বানী টিপু হত্যার শিকার হতে পারেন বলে ধারণা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। আর এই তিন সূত্র ধরে এগোচ্ছে র্যাব ও পুলিশ।
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসংলগ্ন হোটেল সি গালের সামনে টিপুকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) দুপুরে টিপুর বোনের স্বামী ইউনূছ আলী শেখ কক্সবাজার সদর মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। এদিকে হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে দুজনকে আটক করেছে র্যাব-১৫।
তারা হলেন খুলনার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ইফতেখার হাসান চালু এবং কক্সবাজার শহরের টেকপাড়া এলাকার নুরুল কবির ভুট্টু। টিপু ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। টিপু ও চালু ভালো বন্ধু বলে জানা গেছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের দিন থেকে তারা আত্মগোপনে ছিলেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার সকালে ইফতেখার ও টিপু কক্সবাজারে আসেন। তারা কক্সবাজার শহরের কলাতলী সড়কের হোটেল গোল্ডেন হিলে ওঠেন। তবে হোটেলের ‘অতিথি লিপিবদ্ধ বই’-এ দেখা গেছে, সকাল ৭টায় ইফতেখার ও টিপুর সঙ্গে রুমি (২৭) নামের এক নারীও হোটেলে ওঠেন।
হোটেল গোল্ডেন হিলের ম্যানেজার মোহাম্মদ শফিক বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে টিপুসহ তিনজন হোটেল আসেন। টিপু হোটেলটির দুই কক্ষবিশিষ্ট ৭০০৩ নম্বর ফ্ল্যাটে ওঠেন। একটি কক্ষে টিপু এবং অপরকক্ষে দুজন অবস্থান করছিলেন। সন্ধ্যার পর টিপু হোটেল থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি।
র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক আরও বলেন, ‘আমাদের হাতে আসা হোটেলটির অভ্যর্থনা কক্ষের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ৩১ মিনিটে ওই নারীসহ টিপু হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। এরপর রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে হোটেল সি গালের সামনের ফুটপাতে টিপু দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন। রাত ১২টার পর ইফতেখারকে ওই হোটেল থেকে আটক করে র্যাব। তবে রুমি পলাতক রয়েছেন।
টিপু হত্যার তিন কারণ
স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচন ও আন্ডারওয়ার্ল্ড সম্পৃক্ততা, যা খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা শরিফুল আনাম ও তার ছেলে আশিকুল আনামসহ একটি পক্ষ গোলাম রব্বানী টিপুর প্রতিপক্ষ প্রার্থী মো. কবির হোসেন কবু মোল্লাকে সমর্থন করেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। ৫ আগস্টের পর গোলাম রব্বানী টিপুর বাড়িতে হামলার সঙ্গে এদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া টিপু দৌলতপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থি নেতা শহিদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহীদকে (৪২) হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে দৌলতপুর খান এ সবুর রোডে ইসলামী ব্যাংকের সামনে শহিদুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, শহিদুল ইসলাম প্রাইভেট কারযোগে পাবলা চুন্নুর বটতলার নিজ বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মাইক্রোবাস তার গাড়ির গতিরোধ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাইক্রোবাসে থাকা সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তার শরীরের পেছন দিক থেকে গুলি ঢুকে ফুসফুস ভেদ করে চলে যায়। এ ঘটনায় তার ভাই তৌহিদ দৌলতপুর থানায় দেয়ানা উত্তরপাড়ার গোলাম রব্বানী টিপুসহ ২০ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
২০২২ সালের ৩০ জুন নগরীর মুজগুন্নী এলাকায় জুলকার নাঈম মুন্নাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে জুলকার নাঈম মুজগুন্নী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় দুই দুর্বৃত্ত একটি মোটরসাইকেলে এসে তার মাথায় গুলি করে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
আরও একটি বিষয়ে নজর দিতে হচ্ছে চরমপন্থি নেতা গাজী কামরুলের সঙ্গে গোলাম রব্বানী টিপুর দ্বন্দ্ব ছিল। গাজী কামরুলের সঙ্গে শহিদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহীদের সম্পৃক্ততা ছিল। হুজি শহীদ নিহত হওয়ার পর গাজী কামরুলের সঙ্গে গোলাম রব্বানী টিপুর দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়।
হোটেলে দুই কাউন্সিলরের সঙ্গে এক তরুণী
হোটেল গোল্ডেন হিলের ‘অতিথি লিপিবদ্ধ বই’-এ দেখা গেছে আটক ইফতেখার, নিহত গোলাম রব্বানী টিপুর সঙ্গে রুমি (২৭) নামের এক নারীও সকাল ৭টায় হোটেলে ওঠেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আসা হোটেলটির অভ্যর্থনা কক্ষের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ৩১ মিনিটে ওই নারীসহ নিহত কাউন্সিলর টিপু হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসংলগ্ন হোটেল সি গালের সামনের ফুটপাতে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন গোলাম রব্বানী টিপু। তারপর থেকে রুমি নামে ওই নারী পলাতক।
পুলিশের ধারণা, রুমির বাড়িও খুলনায়। তিনি খুলনা মেডিকেলে পড়াশোনা করছেন। রুমি ছাড়াও একাধিক নারীর সঙ্গে টিপুর যোগাযোগ থাকার তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
২০১৮ সাল থেকে কক্সবাজারে যাতায়াত টিপুর
মামলার বাদী ইউনূছ আলী শেখ বলেন, নিহত গোলাম রাব্বানী টিপু ৮ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে ঢাকা থেকে বাসে কক্সবাজারে যান। সকাল ৭টার দিকে নেমে হোটেল গোল্ডেন হিলে ওঠেন। পরবর্তী সময়ে তার স্ত্রী নূরজাহান বেগম তাকে (ইউনূছ) রাত ১০টার দিকে জানান, তার ভাই টিপুকে কক্সাবজারে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, কক্সবাজারে টিপুর চিংড়ি হ্যাচারি রয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে তিনি এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সেই সুবাদে এখানকার অনেকে তাকে চেনেন। ৫ আগস্ট থেকে এলাকা থেকে সরে গিয়েছিলেন টিপু। তারপর বেশ কয়েকবার বাড়ির সামনে অস্ত্রের মহড়া দিয়েছিল সন্ত্রাসীরা।
টিপু হত্যায় যে অস্ত্রের ব্যবহার
র্যাব-পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ধারণা, ঘটনাস্থলে পড়েছিল টিপুকে লক্ষ্য করে করা গুলির খোসা। সে খোসা ৯ এমএম ইউএসএর প্যারাবলিয়াম ৯.৯ মিলিমিটার পিস্তলের। তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এটি প্রশিক্ষিত কোনো কিলার এ হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে।
কক্সবাজার র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন জানান, ইফতেখারকে কক্সবাজার শহরের কলাতলী সড়কের হোটেল গোল্ডেন হিল থেকে রাত ১২টার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। এ ছাড়া নুরুল কবির ভুট্টু নামে একজনও হেফাজতে নিয়েছে র্যাব। এ হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত চলছে।