মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করাটা অনেক ব্যয়বহুল। ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে বাণিজ্যে শক্তিশালী প্রেরণা তৈরি করেছেন। ইউক্রেনের যুদ্ধের মতো বিষয়গুলোয় তাদের বিরোধপূর্ণ অবস্থান থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে এখন এক রকমের ভিত্তি তৈরি হয়েছে।
অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক যুক্তি ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ কিছু শুল্ক চালু করেছেন। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অর্থনীতির ওপর সেগুলো আরোপ করেছেন। শুল্ক আরোপ এমনই থাকবে বলে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি একটি ছাড়া সব দেশের জন্য নতুন ‘পারস্পরিক’ শুল্ক স্থগিত করেছেন। বাকিদের জন্য সার্বিকভাবে ১০ শতাংশ শুল্ক বহাল রাখেন। চীনের জন্য ট্রাম্প ফেব্রুয়ারি এবং মার্চে দুটিতে ১০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি এবং তার ‘স্বাধীনতা দিবসে’ আরোপিত ৩৪ শতাংশ ‘পারস্পরিক’ শুল্কের ওপরে ৫০ শতাংশ শুল্ক যোগ করেন (যা তিনি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ৮৪ শতাংশে বৃদ্ধি করেন)। ফলাফল? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী সব চীনা পণ্যের ওপর কার্যকর সর্বনিম্ন ১৪৫ শতাংশ শুল্ক হার ধার্য করা হয়।
চীন প্রাথমিকভাবে দুটি পণ্যে ১০ শতাংশ বৃদ্ধির সমানুপাতিক শুল্ক দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিল এবং ট্রাম্পের সঙ্গে একটি চুক্তির আশা করেছিল। এর মধ্যদিয়ে তারা সামঞ্জস্যপূর্ণ বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ফলে মার্কিন আমদানিতে সামগ্রিক শুল্ক ১২৫ শতাংশে পৌঁছেছে। ট্রাম্প প্রশাসন বাজি ধরছে যে, মার্কিন বাণিজ্যে তীব্র হ্রাসের ফলে চীন সরকার অর্থনৈতিক ক্ষতি সহ্য করতে পারবে না। চীনের জিডিপির মাত্র ২০ শতাংশেরও কম আসে রপ্তানি থেকে এবং এর রপ্তানির প্রায় ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে যায়। ২০২৪ সালে চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এই রপ্তানির ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ চীনা সংস্থা, কর্মী এবং পরিবারের ওপর অনেক বড় ক্ষতি বয়ে আনবে। এমন এক সময়ে এই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে যখন চীন তাদের স্থবির অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
কিন্তু ট্রাম্পের অদ্ভুত এবং আক্রমণাত্মক শুল্ক আরোপের ফলে চীন সরকার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছে। অভ্যন্তরীণ নীতির কারণে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে। লেসোথোর মতো ছোট ও দরিদ্র দেশ বা কেবল পেঙ্গুইন অধ্যুষিত দ্বীপপুঞ্জের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের নির্লজ্জ ও নির্বিচারে শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপের ফলে বেশির ভাগ সাধারণ চীনা অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। তারা ‘মার্কিন বর্বরতা’কে দায়ী করছে। চীনা সরকার বারবার বাণিজ্যের পারস্পরিক সুবিধার ওপর গুরুত্ব দেয়। বাণিজ্য যুদ্ধে ‘কেউ জিতবে না’ এমন নীতির ওপর তারা জোর দেয়। এই সময়ে চীন জাতীয় সংহতির আহ্বান জানিয়েছে। আমেরিকা যত কম যুক্তিসংগত আচরণ করবে, চীনা সরকার তত বেশি অভ্যন্তরীণ সমর্থন পাবে।
তাছাড়া, চীন একা নয়। বাইডেন প্রশাসন চীনকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য তার মিত্রদের সঙ্গে অক্লান্ত পরিশ্রম করলেও ট্রাম্প চীন এবং ঐতিহ্যবাহী মার্কিন মিত্রদের একই দিকে রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমদানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি করেছেন। ইইউ, চীনের মতো ট্রাম্পের আগে প্রতিশোধমূলক শুল্ক ঘোষণা করেছে যখন শেয়ারবাজারের পতন এবং ট্রেজারি স্থবির হয়ে পড়ে।
চীনের ওপর আমেরিকার সাম্প্রতিক মনোযোগকে ইউরোপ এবং অন্য দেশগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হতে পারে।
এটি কিছুটা হলেও কাজ করতে পারে। মেক্সিকো ইতোমধ্যেই চীনের ওপর মার্কিন শুল্কের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন স্বার্থের ওপর স্বপ্রণোদিত ক্ষতির বেশির ভাগই ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। এমনকি যদি ইইউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে সফলভাবে আলোচনা করে, তবুও ইউক্রেন এবং গ্রিনল্যান্ড যারা অর্থনৈতিক অংশীদার তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমেরিকার প্রতি ইউরোপীয়দের বিশ্বাসে কিছুটা ঘাটতি পড়বে।
আমেরিকার প্রতি হতাশা হঠাৎ করে ইউরোপকে চীনের মিত্র করে তুলবে না। চীনের বিরুদ্ধে ইইউর প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বৈদ্যুতিক যানবাহন রপ্তানি এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধে সমর্থন করার জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যকে আরও ব্যয়বহুল এবং সবার জন্য অপ্রত্যাশিত করে তুলেছে। ট্রাম্প ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার জন্য শক্তিশালী প্রেরণা তৈরি করেছেন।
তাছাড়া, ট্রাম্প যখন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলেন, তখন ইউরোপ এবং চীন উভয়ই বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয় অনুভব করে। বৈদ্যুতিক যানবাহন এবং সৌর-প্যানেল উৎপাদনে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি চীন সবুজায়নে শক্তি প্রযুক্তি এবং পারমাণবিক শক্তির দ্রুততম বিকাশকারী শক্তি বিকল্প যা ইউরোপে নতুন করে আগ্রহ অর্জন করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইউরোপীয় উৎপাদকদের ওপর চীনা রপ্তানির প্রভাব নিঃসন্দেহে একটি জটিল বিষয়। তবে আমেরিকান বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে তাদের অর্থনীতিকে চাঙা করতে উভয় পক্ষকেই আপস করতে অনুপ্রাণিত করবে।
চুক্তি কেমন হবে তা বলা কঠিন। তবে অনেক বিকল্প পথ রয়েছে। চীন তার ইউরোপীয় আমদানি বৃদ্ধি, ইউরোপে রপ্তানির সীমা নির্ধারণ এবং তার মুদ্রার মান বৃদ্ধি করতে পারে। এটি AI, EV ব্যাটারি এবং বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিশনের মতো ইউরোপীয় শিল্পগুলোকে শক্তিশালী করতে প্রযুক্তিকে ভাগ করে নিতে পারে। এই খাতে চীনা সরকারের ভর্তুকি যা ইউরোপীয়রা চীনকে অন্যায্য সুবিধা প্রদানকারী হিসেবে দেখে থাকে। এটি ইউরোপীয় উৎপাদক এবং ভোক্তাদের জন্য সুবিধায় পরিণত হবে। ইউরোপ তার পক্ষ থেকে আরও বিশ্বব্যাপী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় চীনা অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে পারে, যা চীনা নেতারা দীর্ঘদিন ধরে চেয়ে আসছেন।
যদিও চীন রাশিয়াকে পরিত্যাগ করার সম্ভাবনা কম, তবুও চীনা স্বার্থের ক্ষেত্রে তারা বাস্তববাদী মনোভাব দেখিয়েছে। ইউরোপীয়দের প্রতি সদিচ্ছা দেখাতে চাইলে তারা আমেরিকান কৃষি আমদানির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইউক্রেনীয় খাদ্যপণ্যের আমদানি বাড়াতে পারে। ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের সহায়তা করতে পারে। ইউক্রেন পুনর্গঠনে সহায়তা করার জন্য বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণে তার দক্ষতা ব্যবহার করতে পারে এবং চীনা ভাড়াটে সৈন্যদের রাশিয়ায় যোগদান থেকে বিরত রাখতে পারে।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের সাম্প্রতিক বেইজিং সফর এবং জুলাই মাসে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং যে ইইউ নেতাদের সঙ্গে পরিকল্পিত বৈঠকের আয়োজন করবেন তা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্বের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলো বর্ধিত সহযোগিতার সুবিধা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত। যদি তারা সফলভাবে এটি অনুসরণ করে, তাহলে বাণিজ্য যুদ্ধ চীনের জন্য খারাপ নাও হতে পারে। অর্থনৈতিক সংকট বলে মনে হচ্ছে তা একটি ভূ-রাজনৈতিক সুযোগও হতে পারে।
লেখক: চীনা আমেরিকান অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল