![ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা](uploads/2024/02/06/1707198258.S-D-Subrata.jpg)
‘একুশ প্রকৃত অর্থে মুক্তছন্দা বহতা নদীর নাম
এই সত্য বিশ্ববুকে আমরাই এঁকে রাখলাম।’
(অমর একুশে তুমি আত্মপরিচয়- হাসান হাফিজ)
একুশ মানে প্রতিবাদী হওয়া, একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশের চেতনা আমাদের ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে চির অম্লান হয়ে থাকবে। মায়ের ভাষার জন্য জীবনদানের এমন নজির বিশ্বমাঝে আর কোথাও নেই। ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে একুশের প্রভাব এতটাই বেশি যে, ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের আত্মদান বৃথা যায়নি। একুশের পথ ধরেই গণ-অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে আমরা পেয়েছি আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অনন্য চেতনাদীপ্ত অধ্যায় হলো একুশে ফেব্রুয়ারি। কেননা, মাতৃভাষার মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখতে এ দিন বাংলার দুর্জয় সন্তানেরা অকুতোভয়ে যে রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করেছিল পিচঢালা কালো রাজপথ। এই ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসন দিয়েছে।
ভাষা আন্দোলনে শহিদদের আত্মত্যাগ স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। তাদের আত্মোৎসর্গেই আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে পেয়েছি। বাঙালির জীবনজুড়ে ভালোবাসার অনন্য প্রতীক হয়ে আছে। কবি নির্মলেন্দু গুণ তাইতো তার ‘ভাষা, সুন্দরের শ্রেষ্ঠ ভূষণ’ কবিতায় যথার্থ বলতে পেরেছেন...
‘শৃঙ্খলিত ভাষায় আমি কি আমার প্রিয়তমার রূপের ঐশ্বর্য, আমার আনন্দ বেদনা আজকের মতো বর্ণনা করতে পারতাম?’
এ ভালোবাসা শুধু ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ ভালোবাসা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সকল মহৎ ও মানবিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশের প্রথম সফল গণ-অভ্যুত্থান এবং শাসকচক্রের বিরুদ্ধে প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রথম সফল সংগ্রাম ছিল এ ভাষা আন্দোলন। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস পায়। বাঙালির আত্মপরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অনুপ্রেরণা পায় এবং ন্যায্য দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাই পরবর্তী সময়ে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। ফলে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। তাই বলা যায়, বাঙালির স্বাধীনতার মূলসূত্র একুশের ভাষা আন্দোলনের মাঝেই নিহিত ছিল। এর পথ ধরেই আমরা আমাদের স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। একুশ আসে আমাদের প্রাণের আবাহনে। একুশ আসে চেতনায় ঢেউ জাগাতে। একুশ আসে আশার আলো জাগাতে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিতে। ১৯৫৩ সাল থেকে এ দেশের মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেসকো এ দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। সেই থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর বহু দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। আর ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। একুশ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়।
আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এবং জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একুশের চেতনার উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বাঙালি জাতির মন-মানসে একুশ নব সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ ঘটায়। আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিতে একুশের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় একুশের পদচারণে দেখা যায়। কবি-সাহিত্যিকরা একুশকে উপজীব্য করে রচনা করেছেন অসংখ্য সাহিত্যকর্ম। একুশের চেতনায় রচিত হয়েছে অগণিত গল্প, কবিতা, গান, উপন্যাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই আমাদের অন্যান্য সব আন্দোলন বিকশিত হয়েছে। ফলপ্রসূ হয়েছে। পেয়েছি সাফল্য। আমাদের জাতায় জীবনে একুশ দান করেছে নব প্রেরণা। একুশ আমাদের সামনে চলার অনুপ্রেরণা। বাংলা শিল্প-সাহিত্যের ধমনিতে নিত্য সক্রিয় রয়েছে একুশের চেতনা। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, মুনীর চৌধুরী নাটক ‘কবর’, মাহবুব উল-আলম রচিত কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’, জহির রায়হান রচিত ‘আরেক ফাল্গুন’, চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়া এসব কালজয়ী সাহিত্যকর্ম ও ছবি সবই একুশের অসামান্য অবদানের ফসল। একুশ আমাদের শরীরে দিয়েছে প্রাণ, দিয়েছে শক্তি। একুশ আমাদের কণ্ঠে ভাষা দিয়েছে, হৃদয়ে দিয়েছে আবেগ, চেতনায় জাগিয়েছে দৃঢ়তাসহ বুকে দিয়েছে সাহস। একুশ আমাদের মুক্তির চেতনায় উদ্দীপ্ত করেছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহিদরা যে অবদান রেখেছেন তাকে অম্লান রাখতে হবে। আর এ উদ্দেশ্যে বর্তমান প্রজন্মকে যথাযথভাবে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে আমাদের ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস জানার সুযোগ করে দিতে হবে যাতে তারা একুশের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে সত্য ন্যায়ের পথে এগিয়ে যেতে পারে। দেশকে, দেশের মাটিকে ভালবাসতে পারে হৃদয় থেকে। একুশের চেতনায় বাঙালি মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ সন্ত্রাস, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে শিখেছে। একুশ শক্তি ও সাহস জোগাবে বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ে। একুশ আমাদের হৃদয়ে থাকবে আলোর পথের দিশারী হয়ে। ‘অসীম আকাশে অগণন গ্রহ তারা সূর্য শশী নক্ষত্র /সব শূন্যতার অক্ষরমালা ভাষা নীহারিকা (শোণিতে রঞ্জিত মাতৃভাষা- রবিউল হুসাইন)’। একুশ আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শক্তি ও সাহসের অনুপ্রেরণা। একুশ আমাদের চেতনা শাণিত কথার এক বড় অস্ত্র। একুশ মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া। যতদিন বাঙালি আর বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন একুশ আমাদের সামনে চলার আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখাবে অন্ধকার থেকে আলোর পথে চলতে। একুশ আমাদের ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে এক অবিনাশী চেতনার নাম।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ
[email protected]