ঢাকা ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পাঁচ ইস্যুতে রাজনীতিতে অস্থিরতা

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৫, ১২:১০ পিএম
আপডেট: ০৪ মে ২০২৫, ১২:১৭ পিএম
পাঁচ ইস্যুতে রাজনীতিতে অস্থিরতা
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ, সংস্কার বাস্তবায়ন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন, মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য মানবিক করিডর ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে না পরে- গুরুত্বপূর্ণ এই পাঁচটি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী তৎপরতায় দেশে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

এসব ইস্যুতে দলগুলোর পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে তৈরি হয়েছে উত্তাপ। এর ফলে আবার জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, নির্বাচন আসলে কবে বা আদৌ হবে তো! কারণ সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানই বলেছেন, নির্বাচন দাবি করাটাই যেন এখন বড় অপরাধ। 

অন্যদিকে মায়ানমারের সঙ্গে মানবিক করিডরকে কেন্দ্র করে সরকার কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। কারণ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি এনসিপি; এমনকি সর্বশেষ গতকাল হেফাজতে ইসলামও করিডরের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

শনিবার (৩ মে) হেফাজতের সমাবেশ থেকে সরকারের উদ্দেশে বলা হয়েছে, মানবিক করিডরের নামে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না। একই মঞ্চ থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘ভুলে যাবেন না, আমরা আপনাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) ক্ষমতায় বসিয়েছি।’ 

সরকারের বিরুদ্ধে এই অবস্থান ছাড়াও নির্বাচনের দিনক্ষণ ও সংস্কার বাস্তবায়ন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে দলগুলো এখন প্রায় মুখোমুখি। কারণ বিএনপি আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রশ্নে এখনো অনড় অবস্থানে রয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘আমরা খেয়াল করছি, কিছুদিন ধরে অত্যন্ত সুকৌশলে দেশে এমন একটি আবহ তৈরির প্রচেষ্টা চলছে, যেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানানোই যেন এক অপরাধ।’

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী আগে সংস্কারের কথা বললেও এখন তারা আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে। গতকাল জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা দুটি সময়কে উপযুক্ত মনে করি। একটি ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে। তবে যদি এ সময়ের মধ্যে সংস্কারগুলো এবং বিচারের প্রক্রিয়া দৃশ্যমান বা জনমনে আস্থা সৃষ্টির পর্যায়ে না আসে, তাহলে সর্বোচ্চ এপ্রিল। ফেব্রুয়ারিতে সম্ভব না হলে কোনোভাবেই এপ্রিল মাস পার হওয়া উচিত নয়।’ নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াতের অবস্থান সরকার-এনসিপি ও বিএনপির মাঝামাঝি বলা যায়। 

তবে এনসিপি নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য রাজনীতির ময়দানে উত্তাপ ছড়িয়েছে। গত শুক্রবার রাজধানীর এক সমাবেশে দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’ পর্যবেক্ষকদের মতে, এনসিপির এই বক্তব্য নির্বাচন নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হলো। গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বর্তমান সরকার মনে হচ্ছে নির্বাচন দিতে চায় না। 

এদিকে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যোগাযোগের জন্য ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত জানানোর পর থেকেই দেশের রাজনীতিতে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটি রাজনৈতিক দল এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেনি। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি এবং সর্বশেষ হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ থেকে করিডরের ব্যাপারে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে। 

হেফাজতের সমাবেশ থেকে আলোচিত ইসলামি বক্তা ও জৌনপুরের পীর মুফতি ড. সাইয়্যেদ এনায়েত উল্লাহ আব্বাসী বলেন, ‘করিডর (মায়ানমারের রাখাইনের জনগণের জন্য মানবিক করিডর) দিয়ে স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। আলেমদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।’ 

এর আগে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িত এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে জানায়নি অন্তর্বর্তী সরকার। স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ মনে করে, করিডর দেওয়া না-দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের কাছ থেকে, সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের প্রত্যেক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের মাধ্যমে।

ফলে করিডর নিয়েও জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি অস্পষ্টতা রয়েছে। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশ-মায়ানমারের সঙ্গে এই মানবিক করিডর নিয়ে আবার নতুন কোনো সংকট তৈরি হয় কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা প্রশ্ন এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। 

এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন- কোনটি আগে হবে এই আলোচনা নিয়েও বিতর্ক ছড়াচ্ছে। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই পক্ষে-বিপক্ষে নানা বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। বিএনপি বরাবরই স্থানীয় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। আর জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ- এই চারটি দল ইতোমধ্যে স্পষ্ট করে বলেছে, তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়। 

প্রসঙ্গত, গুরুত্বপূর্ণ এই পাঁচ ইস্যু ছাড়াও সংবিধান, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, নির্বাচন কমিশন সংস্কারের যেসব প্রস্তাব রয়েছে তা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এসব প্রস্তাব নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা তেমন জোরালো নেই। 

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সমাবেশে হেফাজতের অনেকে অনেকভাবে বলতে পারেন। তবে দলটির মূল নেতৃত্ব জানে একটা বিচারকাজ শুরু করে শেষ করতে সময় লাগে। আপিল প্রক্রিয়া থাকে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে বিচারকাজ শুরু করতে পারাটাই। হেফাজত বিচার-প্রক্রিয়া শেষ করে নির্বাচনের কথা বলতে পারে।

কিন্তু বিএনপির সঙ্গে বৈঠককালে তাদের বুঝিয়েছিলাম, বিচার একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমরা বিচার শুরু করি, পরবর্তী সময়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তারা বিচার প্রক্রিয়া চলমান রাখবে। কারণ সব অভিযুক্তকে এখনো বিচার-প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা সম্ভব হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘মানবিক করিডর নিয়ে জনগণকে অন্ধকারে রেখে এমন সিদ্ধান্ত অনভিপ্রেত। যদি বিষয়টি একান্তই জরুরি হতো, তাহলে সবার সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত।’

‘বাংলাদেশের সংবিধান বা প্রচলিত আইনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো এখতিয়ার সরকারের নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিচার করা বা নিষিদ্ধ করার কোনো ধারা বা সিস্টেম আইনে আছে বলে আমার জানা নেই। আওয়ামী লীগের মধ্যে যেসব লোক খারাপ ছিল তাদের বিচার করতে পারে। কিন্তু গোটা দলকে নিষিদ্ধ করার যুক্তিসংগত কারণ নেই। কারণ এই দলকে অনেক লোক ধারণ করে, অনেকে এটার সঙ্গে যুক্ত আছে। সবাই তো আর খারাপ না। এখন জনগণের কাছে যদি এই দলটি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে জনগণই এটার বিচার করবে। দলকে নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার কোনো দল বা সরকারের আছে, এটা আমি মনে করি না।’ 

জি এম কাদের বলেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। যদি অবাধ নির্বাচন দিতে হয়, তাহলে সব দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দিতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে রাখলে স্বাভাবিক নির্বাচন হবে না।’ 

সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘দেশকে সংকটমুক্ত করতে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থায় যাওয়া হলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে কোনো শর্ত দেওয়া উচিত নয়। গণহত্যার দায়ে বিচার প্রক্রিয়াকে নিশ্চিত করার স্বার্থেই নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।’ 

সংস্কার-প্রক্রিয়ার শর্ত জুড়ে যারা নির্বাচন দীর্ঘায়িত করতে চাইছে তাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘যারা বলছে, নির্বাচন হলে বিচার হবে না; আমি মনে করি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে তাদের সন্দেহ আছে। নির্বাচিত সরকার আওয়ামী লীগের বিচার করবে না এ কথা বলার মানে হলো, জনগণের ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই।’

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কৃতকর্মের বিচার সবাই চায়, আমরা চাই। কিন্তু বিচার করতে কতদিন সময় লাগবে? বিচার তো কেউ নির্দিষ্ট করতে পারবে না। নির্বাচনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিচার বিষয়টি জুড়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা দেখি না। বিচার-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাদের (আওয়ামী লীগ) নিষিদ্ধের বিষয়টি আসতে হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘মানবিক করিডরের মতো এত বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি সরকার। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু সরকারের মধ্যে আমরা সেই ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখছি না। এটা চিন্তার ব্যাপার।’

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘জুলাইয়ে আওয়ামী লীগ গণহত্যা পরিচালনাকারী দল হিসেবে জাতিসংঘ চিহ্নিত করে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে তাদের বিচার করার এখতিয়ার শুধু আদালতের, কোনো দলের নয়। যারা গত ১৫ বছর দেশে জুলুম, নির্যাতন, দুঃশাসন চালিয়েছে তাদের কি জনগণ ক্ষমা করবে? ফ্যাসিস্ট ও ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশকে জনগণ আর দেখতে চায় না। দল ও ব্যক্তির দুটোরই বিচার করতে হবে। ব্যক্তি হিসেবে যারা অপরাধ করেছে তাদের বিচার করতে হবে। আর বিচার-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের বিষয়ে চূড়ান্ত রায় আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও সতর্ক থাকতে হবে- ফ্যাসিবাদ যেন পুনর্বাসনের সুযোগ না পায়।’ 

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিচারের আগে নির্বাচন না হওয়ার দাবি প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই, এই দাবিটা কেন উঠল? বিচার নিয়ে কি তাহলে কোনো সন্দেহ-সংশয় তৈরি হয়েছে? কিংবা বিচার বিলম্বিত হবে বা হচ্ছে এ ধরনের কোনো আশঙ্কা? এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তো সরকারের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ। সরকারেরই উচিত এ বিষয়টা পরিষ্কার করা। বিচার বিলম্বিত হলে যদি নির্বাচন পেছাতে হয় তাহলে মানুষ সরকারকেই সন্দেহ করবে। মনে হবে নির্বাচন না করার জন্য সরকার ইচ্ছা করেই বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ঘটাচ্ছে। আমি মনে করি, বিচার বা নির্বাচন যে কোনোটারই অযৌক্তিক বিলম্ব সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।’

বাজেটে দুদকের বরাদ্দ বাড়ছে না

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১২:৫৬ পিএম
আপডেট: ০৩ জুন ২০২৫, ০১:০৫ পিএম
বাজেটে দুদকের বরাদ্দ বাড়ছে না
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে চলতি অর্থবছরের তুলনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে না। বরং বরাদ্দ কিছুটা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বাজেট পরিকল্পনায় এবার দেশব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেটে দুদকের জন্য মোট বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১৯১ কোটি টাকা।

এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ১২ কোটি ৭১ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জন্য গত বছরের ৬ জুন ঘোষিত বাজেট ঘোষণায় দুদকের জন্য মোট বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৯১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭৯ কোটি ৩০ লাখ এবং উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয় ১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বাজেটের তুলনায় এবার পরিচালন ব্যয় কমিয়ে উন্নয়ন ব্যয় সামান্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে মঞ্জুরি ও বরাদ্দে দুদকের উল্লেখযোগ্য কার্যাবলি, কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে বলা হয়েছে, দেশব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে সব জেলায় ১৩ সদস্যবিশিষ্ট ‘মহানগর বা জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, সব উপজেলায় ৯ সদস্যবিশিষ্ট উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি পুনর্গঠন ও পরিচালনা এবং ইউনিয়ন দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও পরিচালনা করা হবে। এর মধ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির কার্যক্রম আগে থেকেই চলমান, তবে এবারই প্রথম ইউনিয়ন পর্যায়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সততা এ নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টি করা এবং গণসচেতনতা গড়ে তোলার কাজে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে স্ব স্ব কর্ম এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেমন- স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রাবাস, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহযোগী হিসেবে সততা সংঘ প্রতিষ্ঠা করা হবে। শিক্ষার্থীদের সততা চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সততা স্টোর’ নামে বিক্রেতাবিহীন স্টোর চালু করা হবে। সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সেবা নিশ্চিত করতে গণশুনানি কার্যক্রম চালু রাখা হবে। তথ্যপ্রযুক্তিগত উন্নয়নসহ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো হবে। দুদকের খুলনা, রংপুর, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয়ের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হবে।

দুদকের জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবিত ১৯১ কোটি টাকার বরাদ্দে ১৬৫ কোটি টাকার আবর্তক ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে নগদ মজুরি ও বেতন ৯৯ কোটি ২৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, প্রশাসনিক ব্যয় ২১ কোটি ২৭ লাখ ১৫ হাজার, ফি ও কমিশন ৫ লাখ ৫০ হাজার, প্রশিক্ষণ ৪ কোটি ২০ লাখ, পেট্রল ও ফুয়েল ৩ কোটি ৩ লাখ, ভ্রমণ ও বদলি ৬ কোটি ২১ লাখ ৩৬ হাজার, খাদ্য সরবরাহ ১০ কোটি, মুদ্রণ ও মনিহারি ১৩ কোটি ৫৩ লাখ ৭৯ হাজার, সাধারণ ও কাঁচামাল সরবরাহ ৩১ লাখ ৬৫ হাজার, পেশাগত সম্মানী ও সংরক্ষণ ৪ কোটি ৭ লাখ ৫ হাজার, মেরামত ও সংরক্ষণ ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৮৮ হাজার এবং স্থানান্তর ও শ্রেণিবদ্ধহীন ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।     

চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্য গত বছরের ৬ জুন ঘোষিত বাজেটে দুদকের জন্য ১৯১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হলেও সংশোধিত বাজেটে ১৬৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৫৪ কোটি ৩০ হাজার টাকা এবং উন্নয়নে ৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বাজেটে ১৮৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। তবে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫৩ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৪৭ কোটি ৫৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা।   

ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পথনকশা নেই

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১১:৩৪ এএম
ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পথনকশা নেই
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়ে ব্যাংকিং খাতে ক্ষয় ঠেকানো গিয়েছে বলে দাবি করছে বর্তমান সরকার। তবে এখনো স্থিতিশীলতা ফেরেনি। এবারের বাজেটে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাজেট বক্তৃতায় তেমন কোনো পথনকশা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আস্থাহীনতার কারণে ব্যাংকে আমানত খুব বেশি বাড়ছে না। অন্যদিকে, সুদহার বাজারভিত্তিক করায় বেড়েছে ঋণের সুদহার। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। সব মিলিয়ে খাদের কিনারে ব্যাংক খাত।

এমন বাস্তবতায় ব্যাংক খাতে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংকিং খাতের সংস্কার বিষয়ে তেমন কোনো কিছু উল্লেখ নেই। যা হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, ‘বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য নেই। যা মোটেও ঠিক হয়নি। এটি খুবই হতাশাজনক।’

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ইতোমধ্যে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলোই বাজেট বক্তৃতায় তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে নতুন কোনো পথনকশা নেই। বাজেট বক্তৃতায় বলা উচিত ছিল, তারা চলে যাওয়ার আগে কোন কোন সংস্কার শেষ হবে। কয়টা ব্যাংককে নিষ্পত্তি করে দিয়ে যাবে।

বাজেট বক্তৃতায় আর্থিক খাতের সংস্কার বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিগত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে এ খাতকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকট, দেউলিয়াত্ব বা অস্তিত্বের জন্য হুমকি এমন সব ঝুঁকির সময়োপযোগী সমাধান এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে।

সংস্কারের অংশ হিসেবে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো: (ক) ব্যাংকিং খাত সংস্কার কর্মসূচির ভিত্তি তৈরি করতে ব্যাংকগুলোর সম্পদের ব্যাপক গুণগত পর্যালোচনা করা, (খ) নীতি ও প্রবিধানসমূহের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিতকরণে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুশাসন বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং (গ) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চুরি/পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।

চাপ সামলানোর বাজেট

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ০৯:৫৯ এএম
চাপ সামলানোর বাজেট

অর্থনীতিতে এখন চলছে নানা সংকট। সবচেড়ে বড় সংকট মূল্যস্ফীতির চাপ। নতুন বাজেট নিয়ে দেশের জনগণের প্রত্যাশা ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। জীবনযাপনে ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা ছিল ব্যক্তিশ্রেণি আয়করে ছাড় দেবেন তিনি। ব্যবসায়ীদের আশা ছিল বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে থাকবে প্রণোদনা। কমানো হবে করপোরেট কর। কর্মসংস্থান বাড়াতে থাকবে পদক্ষেপ। প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়াতে রপ্তানিতে কমবে কর। সঞ্চয়কারীদের জন্য থাকবে সুখবর। ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে ঘোষণা আসবে সংস্কারমূলক পদক্ষেপের। 

অর্থ উপদেষ্টা সোমবার (২ জুন) যে বাজেট দিলেন তাতে নতুন অর্থবছরে এসব প্রত্যাশার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। অনেক আশার কথা শোনালেও সংকট মোকাবিলার দিকনির্দেশনা নেই। বরং নানা ক্ষেত্রে কর ও ভ্যাটের বোঝা চাপিয়েছেন। কয়েক শতাধিক পণ্য আমদানিতে অগ্রিম কর বসানোর প্রস্তাব করেন। বাড়তি রাজস্ব আহরণে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর আমদানি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্কহার বৃদ্ধির কথা বলেন। এসব কর প্রস্তাব কার্যকর হলে আরও চাপে পড়বেন জনগণ। কঠিন হবে জীবনযাপন। অর্থনীতিবিদরা বলেন, অর্থ উপদেষ্টার প্রত্যাশা বড়। পরিকল্পনা দুর্বল। যদিও অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, একটি যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট দেওয়া হয়েছে। 

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বিএনপি বলেছে, এই বাজেটে মৌলিক জায়গায় গলদ রয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল খবরের কাগজকে দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, নতুন বাজেট ব্যয়ের দিক থেকে গতানুগতিক। আয়ের দিক থেকে সাহসী। 

অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’। ৬৪ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তব্যে তিনি গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। অর্থনীতিতে ঝুঁকির কথা স্বীকার করেন। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এবারের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে নজর না দিয়ে অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করার ওপর গুরুত্ব দেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বলেন, এই শক্তিশালী ভিত্তিই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এই ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য গতকাল বেলা ৩টায় বিটিভিতে বাজেট ঘোষণা করেন তিনি। একই সঙ্গে কোথা থেকে এই ব্যয় মেটানো হবে, ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হবে সে কথাও তুলে ধরেন। এর আগে দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আগামী বাজেট অনুমোদন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন অধ্যাদেশ জারি করার পর ঘোষণা করা হয় বাজেট।

যে অর্থবছরটি (২০২৪-২৫) শেষ হতে যাচ্ছে তাতে মূল বাজেটের আকার ধরা হয় ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটের আকার আগের বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম, শতকরা হারে যা ১ শতাংশ।

অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। 

প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। এ জন্য প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে। তাই এবারের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।’
 
তারুণ্যকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। এ লক্ষ্যে ‘তারুণ্যের উৎসব’ নামে একটি নতুন উদ্যোগ চালু করা হবে। এ জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘দেশের যুবসমাজের শক্তি ও সম্ভাবনাকে জাতি গঠন এবং আত্মকর্মসংস্থানের দিকে পরিচালিত করার জন্য তাদের সম্পৃক্ততাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে সরকার আসন্ন অর্থবছরে দেশব্যাপী এই উৎসব আয়োজনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। 

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা বলেন ড. সালেহউদ্দিন। কিন্তু কী সুবিধা দেওয়া হয়েছে সে বিষয়টি পরিষ্কার করেননি তিনি। খাদ্যনিরাপত্তায় নজর দেন অর্থ উপদেষ্টা। এ জন্য সারের মজুত বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন। বিদেশ থেকে টাকা আনার বিষয়ে নজর দেন অর্থ উপদেষ্টা। বলেন, পাচারের অর্থ ফেরত আনতে দুদক কাজ করছে। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রচলিত আইনের পুনর্গঠন ও সংশোধনের প্রস্তাব করেন। 

সামাজিক সুরক্ষায় নজর দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। বয়স্ক, বিধবাসহ ভাতাভোগীদের মাসিক টাকার অঙ্ক ও আওতা বাড়িয়েছেন তিনি। দুস্থদের সহায়তায় চলমান খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সম্পদের সুষম বণ্টন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া এবারের বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য। এ ছাড়া রাজস্ব আয় ও সরকারি ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে একটি যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট দেওয়া হয়েছে।

কর প্রস্তাব
কর আহরণ বাড়াতে দীর্ঘ ও মধ্য মেয়াদে কৌশল নির্ধারণের প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা। একই সঙ্গে বিভিন্ন খাতে করারোপ ও করছাড় দিয়ে বাড়তি রাজস্ব আহরণের কথা বলেন। আয় থাকুক আর না থাকুক, নতুন করদাতাদের জন্য ১ হাজার টাকা ধার্য করেন তিনি। কৃষিতে নজর দেন। এ খাতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে বছরে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত রাখার ঘোষণা দেন। সর্বজনীন পেনশন থেকে উদ্ভূত আয়ে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ১২টি সেবা নিতে শুধু টিআইএন জমা দিলে হবে- নতুন বাজেটে এমন বিধান করা হয়েছে। ইন্টারনেট সেবায় উৎসে কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে এই সেবা আরও সহজ হবে। 

যারা বাণিজ্যিকভাবে পণ্য আমদানি করেন, নতুন বাজেটে তাদের কর বাড়ানো হয়েছে। নির্মাণসেবার বিপরীতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে এ খাতের খরচ বাড়বে। অনলাইন ব্যবসায় কমিশনের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। এর ফলে এই খাতের খরচ বাড়বে। এসব কর প্রস্তাবের মাধ্যমে বাড়তি ১৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। 

বাজেটের আকার
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ঘোষণা দেন। এটি জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি বা আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আসবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। কর ব্যতীত প্রাপ্তি থেকে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১৯ হাজার কোটি টাকা আসবে এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে। 

অর্থায়ন
প্রস্তাবিত বাজেটে সামগ্রিকভাবে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক- এ দুই উৎস থেকে ঘাটতি পূরণ করা হবে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা আসবে বিদেশি ঋণ থেকে। 

জিডিপির প্রবৃদ্ধি
আগামী বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ।

নিমতলী ট্র্যাজেডির ১৫ বছর: এখনো আছে স্বজন হারানোর ব্যথা

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ০৮:১৪ এএম
নিমতলী ট্র্যাজেডির ১৫ বছর: এখনো আছে স্বজন হারানোর ব্যথা
ছবি: সংগৃহীত

২০১০ সালের ৩ জুন। পুরান ঢাকার নিমতলীর ৪৩ নবাব কাটরার পাঁচতলা ভবনটি বিয়ের আয়োজনে ঝলমল করছিল। চারদিকে ছিল আনন্দ আর হই-হুল্লোড়। কিন্তু হঠাৎ এক বিস্ফোরণ, তারপরেই ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে আর্তনাদ আর কান্নার রোল শোনা যেতে থাকে। কারণ মুহূর্তে কেমিক্যালের সংস্পর্শে দ্রুতই ছড়িয়ে যায় আগুন। আগুন যখন নিভল, ততক্ষণে প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। যার মধ্যে ছিলেন ভবনটির মালিক গোলজার এলাহীর পরিবারেরই ১১ জন।

সেই ১১ স্বজন হারানোর ব্যথা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন গোলজারসহ বেঁচে থাকা স্বজনরা। কেবল এই পরিবারটি নয়, সেই রাতের ভয়াবহতায় যারা মারা গিয়েছিলেন, তাদের স্বজনরা এখনো বুকে কষ্ট নিয়ে সময় পার করেন। আজ সেই নিমতলী ট্র্যাজেডির ১৫ বছর পূর্ণ হলো।

দিন যায়, মাস যায়, দেখতে দেখতে বছরও চলে যায়, কিন্তু স্বজনহারাদের কষ্ট যায় না। গত রবিবার নিমতলী গিয়ে দেখা যায়, পাঁচতলা এই ভবনসহ আশপাশের যে বাড়িগুলো পুড়েছিল, তা এখনো দেখে চেনার উপায় নেই। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলো মেরামতের পর রং করা হয়েছে। ওই দিন যারা দগ্ধ হয়েছিলেন, তাদের পোড়া ক্ষত শুকিয়ে গেলেও কিছুতেই সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছেন না । এখনো তারা দুচোখের পানিতে বুক ভাসান। ওই ভবন ঘেঁষে পশ্চিম পাশে নিহত ব্যক্তিদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে নিমতলী এলাকায় কর্মচঞ্চল মানুষের এখনো অনেক ব্যস্ততা। দোকানপাট ও অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মানুষের জটলা রয়েছে যথারীতি আগের মতোই।  

এলাকাবাসী জানান, সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এখানে ৫টি বাড়ি পুড়ে গিয়েছিল। এখন দেখে বোঝার উপায় নেই। বাড়িগুলো মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু সেই ভয়াবহ ঘটনা এখনো তারা ভুলতে পারেননি। 

তাদের দাবি, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ঘটনার পর সরকার ও প্রশাসনের লোক তৎপর হলেও এখন আর কেউ দেখতে আসে না তাদের সমস্যা।

নবাব কাটরার ‘দিনসাবেরা’ নামে ওই পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় কেমিক্যাল বা রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১২৪ জন। খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলার সময় সেই ভয়ংকার দিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন ভবনমালিক গোলজার। পরিবারের ১১ সদস্য হারানোর ব্যথা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। 

গোলজার বলেন, ‘আমার স্ত্রী, দুই সন্তান, মেজো ও ছোট ভাইয়ের পরিবারের ৬ জন এবং আমার মা ও চাচি আগুনে পুড়ে মারা যান। ১৫ বছর আগের সেই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিন আমাদের বাসার এক ভাড়াটের একটি বিয়ের আয়োজন ছিল। বিয়ের রান্না হচ্ছিল বাসার নিচে। ওই দিন আমি ও আমার মেজো ভাই মোহাম্মদ দিদার বাসার বাইরে ছিলাম। দুই ছেলের কিছু কাগজপত্র ফটোকপি করতে বাজারে গিয়েছিলাম। হঠাৎ খবর পাই বাড়িতে আগুন লেগেছে। দৌড়ে বাড়ির সামনে এসে দেখি পুরো বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ভেতরে যারা আটকা পড়েছিলেন, তাদের আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছিল। সেই কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে, অসুস্থ বোধ করি। সেদিন যেন ছিল লাশের মিছিল, চারদিকে পোড়া  লাশের গন্ধ। ভেতরে ধোঁয়ায় আটকা পড়ে আমার স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের ১১ জন মারা যায়।’ বলতেই দুচোখ ভিজে আসে হাজি গোলজার এলাহীর।  

গোলজার বলেন, ‘আমার যমজ দুই সন্তান ইমতিয়াজ গোলজার ও ইসতিয়াক গোলজার এবং স্ত্রী ইয়াসমিনের অনেক স্মৃতি। ১৯৯২ সালে দুই সন্তান একসঙ্গে জন্মেছিল। ওরা দুই ভাই মায়ের রান্না খুব পছন্দ করত। মায়ের হাতের তৈরি কাচ্চি ও পায়েস তাদের খুব পছন্দের ছিল। এ ছাড়া বাইরে ফাস্টফুড খেতে তারা খুব পছন্দ করত। বাইরে খেতে খুব এনজয় করত।’ বলতে বলতে চোখ মোছেন গোলজার। 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তাদের কথা এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না। প্রতিবছরই ওই দিনটি এলে কষ্ট আরও বাড়ে। বেঁচে থাকলে ছেলে দুটি আজ কত বড় হতো। বাবা হয়ে কাঁধে সন্তানের লাশ বহন করতে হয়েছে, এর চেয়ে বড় কষ্ট পৃথিবীতে আর কী হতে পারে?’

গোলজার জানান, পোড়া বাড়ি মেরামতের জন্য সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। প্রতিবছরই এই দিনে মিলাদ মাহফিল, কবর জিয়ারত ও তবারকের ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় তিনি পরিবারের নিহত সদস্যদের জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করেন।

গোলজারের পাঁচতলা ভবনের বিপরীত পাশেই রয়েছে একটি ইলেকট্রিক দোকান। এখানকার ব্যবসায়ী আহসান উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাড়িগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। বিদ্যুতের তার এত ঘনভাবে লাগানো যে অনেক জায়গায় জটলা বেধে থাকে। যেকোনো সময় শর্টসার্কিট হতে পারে। এ ছাড়া একটু বৃষ্টিতেই এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়। এসব দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।’  

প্রতিবছর আজকের এই দিনে নিমতলীবাসী কাঁদেন। স্বজন হারানোর কথা স্মরণ করে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দিনব্যাপী দোয়া মাহফিল আয়োজন করা হয়।

প্রকাশ্যে বিচার: নুরেমবার্গ থেকে বাংলাদেশ

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ১০:৪০ এএম
আপডেট: ০২ জুন ২০২৫, ১০:৫২ এএম
প্রকাশ্যে বিচার: নুরেমবার্গ থেকে বাংলাদেশ
ছবি: সংগৃহীত

জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম কোনো মামলার বিচার প্রক্রিয়া রবিবার (১ জুন) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। এই বিচারকাজ দেশে এবং সারা বিশ্বকে দেখাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালের শুনানি সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। এইভাবে কোনো দেশের কোনো সাবেক সরকারপ্রধানের বিচার প্রক্রিয়া প্রকাশ্যে সম্প্রচারের দৃষ্টান্ত আগে বিশ্বের কোথাও দেখা যায়নি। তবে ইতিহাসখ্যাত জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে একটি আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে প্রায় ২০০ জন জার্মান যুদ্ধাপরাধীর বিচার অনেকটা প্রকাশ্যে হয়েছিল। আধুনিক কালে পৃথিবীর আরও কয়েকটি দেশে টেলিভিশনে সরাসরি বিচার সম্প্রচারের তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এই প্রথম বলে টেলিভিশনে শেখ হাসিনার বিচারিক কার্যক্রমের সম্প্রচারও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে যেসব সাবেক সরকারপ্রধানের বিচার হয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন উত্তর-মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদের প্রেসিডেন্ট হিসেন হাবরে, সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির, মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, চিলির প্রেসিডেন্ট অগুস্তো পিনোশে, ক্যাম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী পলপট প্রমুখ। 

এদের মধ্যে ওমর আল-বশিরের বিচার হয়েছিল জাতিসংঘের অধীন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্টে (আইসিসি)। আন্তর্জাতিক আদালত প্রথমে তার বিরুদ্ধে পশ্চিম সুদানের দারফুরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পরে গণহত্যার অভিযোগে দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু জাতিসংঘ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় আন্তর্জাতিক আদালত তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা বন্ধ করে দেয়। 

আফ্রিকার শাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেন হাবরের বিচার হয় সেনেগালে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান যিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অন্য দেশে গঠিত আদালতে সাজা পান। পরে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। 

আরব বসন্তের ঝোড়ো আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের হত্যার অভিযোগে মিসরের একটা নিম্ন আদালতে তার আজীবন কারাবাসের সাজা হয়। পরে পুনর্বিচারে তিনি মুক্তি পান। 

চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট অগুস্তো পিনোশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের। বিচার চলাকালে তার মৃত্যু হয়। ক্যাম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পল পটের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের। 

এসব সাবেক সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের বিচার জনসমক্ষে হয়নি। তাদের বিচার হয়েছে মূলত লোকচক্ষুর আড়ালে। তবে মানবতার বিরুদ্ধে বা গণহত্যার বিরুদ্ধে সমকালীন পৃথিবীতে যে বিচারটি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে সেটি হচ্ছে জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে সিরিজ বিচার। এই বিচারটি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের ছিল না, তবু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হিসেবে সুপরিচিত। 

আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে ২০০ জার্মান যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সময় প্রতিদিন প্রায় ৪০০ দর্শক উপস্থিত থাকতেন। সাংবাদিকদের রেকর্ডসংখ্যক উপস্থিতি ছিল, ২৩টি দেশের ৩২৫ জন সাংবাদিক এই বিচারের সময় উপস্থিত থেকেছেন। পুরো বিচার প্রক্রিয়াটি ইংরেজি, ফরাসি ও রুশ ভাষায় অনুবাদ করে সাংবাদিকদের হাতে দেওয়া হতো। প্রকাশ্য বিচারের অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এই নুরেনবার্গ বিচার প্রক্রিয়াটি। 

যুক্তরাষ্ট্রে যথাক্রমে ১৯৭৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৫ সালে টেড বান্ডি, উইলিয়াম কেনেডি স্মিথ এবং ও. জে. সিম্পসনের বিচার প্রক্রিয়াও টেলিভিশনে দেখেছেন বিশ্ববাসী। যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে বেন অলিভারের বিচারও সম্প্রচারিত হয়েছে টেলিভিশনে। ইসরায়েলে ১৯৬১ সালে নাৎসি যুদ্ধাপরাধী আইখম্যানের বিচারও টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে। ব্রাজিলের সুপ্রিম ফেডারেল কোর্ট ও সুপিরিয়র ইলেকটোরাল আদালতে অনুষ্ঠিত সব বিচার ২০০২ সালে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছিল। ইউক্রেনে ২০১৪ সালের পর থেকে প্রায় ৭ হাজার মামলার বিচার প্রক্রিয়া ভিডিও টেপ করে সম্প্রচার করা হয়েছিল। আধুনিক কালে টেলিভিশনে সরাসরি বিচার প্রক্রিয়া সম্প্রচারের ইতিহাস তাই নতুন নয়, তবে বাংলাদেশে নতুন।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার কার্যক্রম সেই নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। এই প্রথম এই ধরনের বিচার প্রক্রিয়াটি কোর্ট থেকে সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচারের মাধ্যমে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় এর আগে এরকম কখনও ঘটেনি। বিচারের স্বচ্ছতার জন্য এই সম্প্রচার বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এতে দেশবাসী আদালতে কীভাবে বিচারটি হচ্ছে সেটা দেখার সুযোগ পাচ্ছে।