
পদোন্নতি, নিয়োগ-বদলি, সুযোগ-সুবিধাসহ নানা দাবিতে একের পর এক আন্দোলনে বেহাল হয়ে পড়েছে জনপ্রশাসন। দীর্ঘদিন ধরে চলা এসব আন্দোলনের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন সংকট।
গত বছরের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। পটপরিবর্তনের ফলে সে সময় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দেয় অস্থিরতা ও ভয়। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর পদোন্নতিবঞ্চিত ও অসময়ে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। বঞ্চিত, বিক্ষুব্ধ এসব কর্মকর্তা একপর্যায়ে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। একপর্যায়ে সরকার দীর্ঘদিন প্রশাসনের বাইরে থাকা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ দেয়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, চুক্তিভিত্তিক এসব নিয়োগের পর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব ও সচিবরা চলমান কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছেন না। ফলে প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজের গতি মন্থর হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জনপ্রশাসনে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের মাঝে অস্থিরতা চলছে। অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা বলছেন, একই অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে আন্দোলন করছে অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া বিসিএসের (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) পুলিশ ক্যাডার, পররাষ্ট্র ক্যাডার, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডার, ইকোনমিক ক্যাডার, কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট ক্যাডার, ট্যাক্সেশন ক্যাডার, সমবায় ক্যাডার, খাদ্য ক্যাডার, ডাক ও টেলিযোগাযোগ ক্যাডার, রেলওয়ে পরিবহন ও বাণিজ্য ক্যাডার, পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডার, পরিসংখ্যান ক্যাডার, মৎস্য ক্যাডার, আনসার ক্যাডার, বন ক্যাডার, তথ্য ক্যাডার, সড়ক ও জনপথ ক্যাডার, গণপূর্ত ক্যাডার, স্বাস্থ্য ক্যাডার, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ক্যাডার, রেলওয়ে প্রকৌশল ক্যাডার, পশুসম্পদ ক্যাডার, কৃষি ক্যাডার, সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার ও কারিগরি শিক্ষা ক্যাডাররা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গঠন করেছেন আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ।
‘ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয় তার’ বাস্তবায়ন, উপসচবি পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ; সব ক্যাডারে সমতা স্থাপন; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারসহ সব ক্যাডারকে একই কমিশনের আওতায় রাখা; পরিবার পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান ক্যাডারকে সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত রাখাসহ ১৪ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করছেন ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশের কারণে অন্য ২৫ ক্যাডারের ১২ জন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করার বিরুদ্ধেও নিজেদের অবস্থান জানিয়েছেন তারা। পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হলেও সমাধান করা হয়নি। তা ছাড়া জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন উপসচিব পুলে প্রশাসন ক্যাডার থেকে শতকরা ৫০ ভাগ ও অন্য ২৫টি ক্যাডার থেকে অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ কোটা রেখে পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ করে। এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। এ ছাড়া অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, একটি নির্দিষ্ট ক্যাডারের গোষ্ঠী-স্বার্থে উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিসংখ্যান, ডাক, পরিবার-পরিকল্পনা, কাস্টমস ও ট্যাক্স ক্যাডারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা অভিযোগ করেন, পক্ষপাতদুষ্ট জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়া একটি ক্যাডারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে।
‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করায় প্রশাসনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে কি না জানতে চাইলে পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, তা তো হচ্ছেই। মানসিক প্রশান্তির সঙ্গে দাপ্তরিক কাজ করতে না পারলে বিঘ্ন তো ঘটবেই। তিনি বলেন, ‘আমাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রাখা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশের কারণে পরিষদের ১২ জন সদস্যের (কর্মকর্তা) বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অথচ একই অপরাধে ২১ জন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা অভিযুক্ত হলেও এখনো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের এসব অপরাধের বিবরণ প্রমাণসহ উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্টদের কাছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি জনপ্রশাসন।’
অন্যদিকে কালাকানুন ও নিবর্তনমূলক আখ্যা দিয়ে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে প্রতিদিন সচিবালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত ঐক্য ফোরাম। ইতোমধ্যে সংগঠনটি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। কর্মচারীদের আন্দোলন চলমান থাকায় প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজকর্মে প্রভাব পড়ছে জানিয়ে সংযুক্ত ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘কর্মচারীরা যে প্রতিদিন কর্মঘণ্টা নষ্ট করে আন্দোলন করছেন, তাতেই তো প্রশাসনের কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে। সরকার আমাদের আন্দোলনকে মূল্যায়ন করছে কি না, সেটা তো আমরা বুঝতে পারছি না। আমাদের ডাকা হবে আলোচনার জন্য, সরকারের পক্ষ থেকে এ কথা বলা হলেও এখনো তেমন কোনো ইঙ্গিত পাইনি। আন্দোলন চলছে, স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত হচ্ছে। এটা যাতে না হয়, তার দায়দায়িত্ব তো সরকারেরও রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দাবিদাওয়া প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টাকে প্রধান করে ইতোমধ্যে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে সরকার। সেই কমিটি বৈঠক করেছে। অথচ কী আলোচনা হয়েছে তা আমরা এখনো জানি না। সরকার কেন এই আইনটি করেছে বা তাদের মোটিভ কী তাও আমরা জানি না।’
তিনি বলেন, ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়া চাকরি থেকে বরখাস্তের অধ্যাদেশের বিধান বাতিল না করলে প্রয়োজনে সারা দেশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে কঠোর আন্দোলনে যাব। আমাদের সেই প্রক্রিয়া চলছে। সারা দেশের মাঠ প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও সংস্থার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আন্দোলন নিয়ে আলোচনা চলছে।’
কো-চেয়ারম্যান বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি দেওয়ার মতো আইন বর্তমানে রয়েছে। তারপরও কেন এই অধ্যাদেশ জারি করা হলো, তা আমরা জানি না।’ নিবর্তনমূলক এই কালো আইন প্রশাসনের কেউ চান না দাবি করে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের একটাই দাবি, এই কালাকানুন বাতিল করতে হবে।’
অপর কো-চেয়ারম্যান মো. বাদিউল কবির খবরের কাগজকে জানান, ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করায় ক্ষুব্ধ সব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। অধ্যাদেশের খসড়ায় শৃঙ্খলা বিঘ্নিত, কর্তব্য সম্পাদনে বাধা, ছুটি ছাড়া কাজে অনুপস্থিত, কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানির জন্য কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরিচ্যুতির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। অধ্যাদেশ বাতিলের এই দাবি ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে দেব। সরকার জারি করা অধ্যাদেশ বাতিল করবে কি না, জানতে চাইলে বাদিউল কবির বলেন, ‘ইতোমধ্যে কয়েকজন উপদেষ্টা আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন যে এই অধ্যাদেশ অপপ্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। তাই সরকার অযৌক্তিক মনে করলে বাতিল করে দিতে পারে। আমরা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই কালো আইন সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি জানাই।’
প্রসঙ্গত, গত ২৫ মে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে সরকার। এর আগে গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশটির খসড়া অনুমোদনের পর ২৪ মে থেকেই আইনটি প্রত্যাহারের দাবিতে সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব কটি সংগঠন সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করে আসছিল। তারা এই অধ্যাদেশটিকে নিবর্তনমূলক ও কালো আইন হিসেবে অভিহিত করছেন।