ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন ফের নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। সরকারি নানা সেক্টর থেকে শুরু করে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এর বাইরে নেই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। ক্যাম্পাসের নানাবিধ কার্যক্রমে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের হাওয়া ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের কতটুকু ছুঁতে পেরেছে? নতুন উদ্যমে নিজ ক্যাম্পাস নিয়ে শিক্ষার্থীরাই বা কী ভাবছে? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিজেদের ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন মাহমুদ শাকিল
আল মাহামুদ
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী ক্যাম্পাসে শিক্ষকরা যেভাবে মন খুলে পড়াতে পারছেন আগে তেমনটা আমরা দেখিনি। নানা কারণে তারা অনেক কিছুই পড়ালেখার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে গিয়েও বলতে পারেননি। অধিকাংশ শিক্ষক নতুন এই প্রেক্ষাপট ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
এই নতুন স্বাধীনতা ক্যাম্পাসে মুক্তচিন্তা চর্চা করার একটি বড় পথ খুলে দিয়েছে। আন্দোলনের কারণে ক্লাস-পরীক্ষা কিছুদিন পিছিয়ে গেলেও ডিপার্টমেন্ট যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করছে শিক্ষার্থীরা যেন সেশন জটে না পড়েন। যদিও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি থাকলেও প্রশাসন নির্বাক। এ ছাড়া আমার প্রত্যাশা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে আমাদের মৌলিক অধিকার বুঝিয়ে দেবে।
মাহির শাফিন
মার্কেটিং বিভাগ
আন্দোলনের পর ক্যাম্পাসে পা রাখা যেন অজানা এক জগতে প্রবেশ করা। সবকিছু একই, তবু ভেতরের শক্তি আর দৃষ্টিভঙ্গি একদম নতুন। ক্লান্তি, ভয় আর দীর্ঘ রাতের যুদ্ধের পর শিক্ষার্থীরা যেন আরও বেশি সাহসী ও সচেতন হয়ে উঠেছেন। দেশপ্রেম আর একাত্মতা তাদের মননে গাঁথা।
সব বর্ষের শিক্ষার্থীরাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, নিজেদের অবস্থান দৃঢ়ভাবে তুলে ধরছেন। যদিও আন্দোলনের দুঃসহ স্মৃতি এখনো আমাদের মনে বিদ্যমান। আর ছাত্র রাজনীতির পুরোনো প্রভাব তো এখনো কোথাও কোথাও টিকে আছেই। তবু সবার মনে একটাই আশা- এই পরিবর্তন স্থায়ী হোক। আপন স্বকীয়তায় এগিয়ে যাক প্রাণের জবি।
মো. তৌহীদুল ইসলাম
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
একটা আন্দোলন; অনেক কষ্ট-ক্লান্তি, দিনের পর দিন নির্ঘুম রাত, ভীতি, অফুরন্ত সাহস আর দেশের প্রতি এক অভিন্ন ভালোবাসার পর ক্যাম্পাসকে নতুন করে দেখার ইচ্ছা সবারই। ছাত্র রাজনীতির অনুপস্থিতিতে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। শিক্ষকদেরও আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে না পারায় অনুশোচনা করতে দেখা যায়। প্রত্যেক শিক্ষকই আগের তুলনায় অনেক কোঅপারেটিভ আচরণ করছেন, যেটা খুবই ইতিবাচক। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ইস্যুসহ জাতীয় সব ইস্যুতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখন অনেক বেশি সচেতন। রক্তক্ষয়ী আন্দোলন আমাদের অধিকার সচেতনতা বাড়িয়ে দিয়েছে বটেই তবে বিপ্লবী শিক্ষার্থীদের মাঝে এক আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতার এই সুবাস চিরকাল থাকুক।
রাকিব হাসান
ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগ
এখন নতুন প্রত্যাশায়, অতীতের অপূর্ণতা যেন স্পর্শ করতে না পারে সেজন্য ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা নতুন উদ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই বন্যা মোকাবিলায়ও শিক্ষার্থীদের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশংসনীয়। শিক্ষার্থীরা তাদের মত প্রকাশের জন্য বিভিন্ন কৌশল ও মাধ্যম (বিক্ষোভ ও মিছিল, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সেমিনার বিতর্ক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সংবাদমাধ্যম, গণস্বাক্ষর অভিযান ও স্মারকলিপি প্রদান) ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে যাওয়া শিক্ষার্থীরা রাজনীতিমুক্ত একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তাদের ক্যাম্পাস জীবন উপভোগ করছেন। বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণসহ স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতে পারছেন, যা তাদের চিন্তার বিকাশে সহায়তা করছে।
আরাফাত খন্দকার
দর্শন বিভাগ
২৪-এর বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নতুন উদ্যম এবং উদ্দীপনায় লেখাপড়াসহ অন্যান্য সৃষ্টিশীল ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল চর্চার সংগঠনগুলো রাজনৈতিক বলয় থেকে বেরিয়ে এখন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। শিক্ষকদের ইতিবাচক চিন্তা ও কার্যক্রমও বর্তমান সময়ে বেশ লক্ষণীয়। বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাঝে নতুনভাবে মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। আন্দোলন-পরবর্তী ক্যাম্পাস দিনে দিনে আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এখন অন্যতম দাবি, লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক মুক্ত ও অনিয়মমুক্ত ক্যাম্পাস। আমার প্রত্যাশা থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ও মুক্ত চিন্তা চর্চার জায়গা হিসেবে অভূতপূর্ব হয়ে উঠুক। ক্যাম্পাস থাকুক নিরাপদ ও সুস্থ ধারার।
মো. তৈয়বুজ্জামান তালুকদার
ফিন্যান্স বিভাগ
বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলস্বরূপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক নতুন উদ্যম জাগিয়ে তুলেছে। এই আন্দোলনের পর থেকে শিক্ষার্থীরা আরও সচেতন, সংগঠিত এবং সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও বন্যাসহ নানা ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধের এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।
ক্যাম্পাসে নতুন ভিসি স্যারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন না তুললেই নয়। কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসন আগের মতোই নিষ্ক্রিয় বলে মনে হচ্ছে, তবে সময়ের সঙ্গে প্রশাসনের কার্যকারিতা হয়তো আরও পরিষ্কার হবে। আমি আশা রাখি, সামনের দিনগুলোয় ক্যাম্পাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই মুক্ত মনের পরিচয় রাখবে।
কলি