কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে বাংলাদেশের লোডশেডিংয়ের সমস্যা কমানোর তড়িৎ চাহিদা বিশ্লেষণের নিজস্ব এআই মডেল তৈরি করেছেন ঢাকার ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী হালিমা হক। কীভাবে তার গবেষণার শুরু হয় ও এ ধরনের গবেষণা থেকে কীভাবে উপকৃত হবে দেশ, তা নিয়ে এবারের আয়োজন। লিখেছেন ফারজানা ফাহমি
মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে ঘন ঘন বিদ্যুৎবিভ্রাট থেকে কীভাবে নিস্তার পাওয়া যায়, এই নিয়ে ভাবতে শুরু করেন হালিমা। এ ধরনের কাজ ইতোমধ্যে উন্নত বিশ্বে হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশে করা যাবে কি না, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন হালিমা। তাই থিসিসের কাজ করার সময় তিনি ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তৈরি করে ফেলেন ঢাকার তড়িৎ চাহিদা বিশ্লেষণের নিজস্ব এআই মডেল।
রোবোটিকসের প্রতি আগে থেকেই আগ্রহ ছিল তার। তাই ইন্টারনেট অব থিংসের (আইওটি) কিছু কাজেও যুক্ত ছিলেন হালিমা। সেসব দেখেই তাকে একজন শিক্ষক ‘মেশিন লার্নিং’ শেখার পরামর্শ দেন। তখন তিনি তড়িৎ প্রকৌশলের মূল বিষয় ‘পাওয়ার’-এর সঙ্গে কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ঘটানো যায়, সে বিষয়ে ভাবতে শুরু করলেন। সেখান থেকেই হালিমার মাথায় আসে এআই দিয়ে কীভাবে লোডশেডিংয়ের সমস্যা কমানো যায় এ নিয়ে বিস্তর ভাবনা। যেই ভাবনা সেই কাজ। তাই তিনি এ বিষয়ে থিসিসের কাজে মনোনিবেশ শুরু করলেন।
তার পুরো কাজে তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন আইইউবির অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। যিনি তাকে সব সময় সহায়তা করেছেন। ইতোমধ্যে হালিমার শক্তি চাহিদা বিশ্লেষণ মডেলটি তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশলীদের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইইইর একটি উচ্চমানের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। থাইল্যান্ড ও মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত আইইইইর কিছু সম্মেলনেও গবেষণাপত্রটি স্বীকৃতি পেয়েছে।
হালিমার এনার্জি ডিমান্ড সাধারণত বিগ ডেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করে এবং কিছু ফিচার ও প্যাটার্ন শনাক্ত করে ভবিষ্যৎ বিদ্যুতের চাহিদার পূর্বাভাস দেয়। মডেলটি এই তথ্য থেকে চাহিদার পূর্বাভাস দিতে শিখার পাশাপাশি গ্রিড ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও সম্পদ বরাদ্দকে সক্ষম করে তুলে।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে কতটা শক্তির প্রয়োজন তা বোঝার জন্য এবং সেই শক্তির সরবরাহ কে কীভাবে সর্বোত্তমভাবে পরিচালনা করা যায় তা বুঝতে অতীতের ডেটা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দেয়।হালিমার তৈরি করা এ মডেলকে আগের ডেটা দেওয়া হলে এআই আপনাকে আওয়ারলি, মান্থলি এবং ইয়ারলি কোন ধরনের বিদ্যুৎ চাহিদা প্রয়োজন তার ধারণা আপনাকে দেবে।
ধরা যাক, আপনার বাসায় অতিথি আসবেন। কিন্তু মুশকিল হলো অতিথি ঠিক কয়জন হতে পারে, কী রান্না করবেন এবং আপনার অতিথিরা কতদিন থাকবে সে সম্পর্কে আপনি জানেন না। এমন কোনো জ্যোতিষীর খোঁজ যদি পাওয়া যেত, আগেভাগেই যে অতিথির আনুমানিক সংখ্যা বলে দিতে পারবেন, তাহলেই কিন্তু সমস্যা অনেকাংশে সমাধান হয়ে যায়।মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই ‘জ্যোতিষী’র কাজই করে। বিগত কিছু আয়োজনের তথ্য তাকে দিলে সেগুলো বিশ্লেষণ করে সে পরের অনুষ্ঠান সম্পর্কে একটা সম্ভাব্য ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করতে পারে।
তাই হালিমা এআই দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদা হিসাব করতে বসেছিলেন। মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে উত্তরার পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৬৫ লাখ নমুনা বা ডেটা তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন। নমুনার মধ্যে ছিল এই অঞ্চলের বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্ট নম্বর, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের বিদ্যুৎ বিল, শুল্ক, ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক ইউনিট ইত্যাদির তথ্য। এ ছাড়া এ কাজ পরিচালনা করার জন্য কিছু পরিবেশগত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন হালিমা। যেমন ওই সময়ের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা। হালিমার মেশিন লার্নিং মডেল এই বিপুল তথ্য বিশ্লেষণ করে। তাঁর তৈরিকৃত মডেলটি ৯২% সঠিক বিশ্লেষণ দিতে পারে।
একটি মেশিন লার্নিং মডেল সফলভাবে কার্যকর করতে হলে প্রতিটি ধাপে দক্ষ পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন। এই ৬৫ লাখ তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে টানা তিন থেকে চার দিন তাকে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে হয়েছে। বারবার বিভিন্ন ছোটখাটো পরিবর্তন এনে নতুন নতুন মডেল প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটি কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ ছিল। এ ছাড়া কোন ধরনের তথ্য দিলে মডেলটি ঠিকঠাক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও সম্পূর্ণভাবে তার ওপর ছিল।
হালিমা মনে করেন, তার তৈরি মডেলের পূর্বাভাস ব্যবহার করে দেশের বিদ্যুৎবিভ্রাট কমানো সম্ভব। তবে কাজটা শুধু প্রকৌশলী ও নীতিনির্ধারকদের নয়। তিনি বলেন, ‘গবেষণাটা বাস্তবে রূপ দিতে হলে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগের প্রয়োজন। এই মডেল সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে টেকসই সমাধান করা সম্ভব।’
গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকও এ বিষয়ে একই মত দিয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছেন, ‘মেশিন লার্নিং আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রবণতা বুঝতে সাহায্য করে, যার মাধ্যমে আরও কার্যকর নীতিমালা তৈরি করা যায়। ফলে লোডশেডিং কমবে এবং টেকসই নগর-পরিকল্পনার পথ সুগম হবে।’
/ফারজানা ফাহমি