ভোলার দুর্গম জনপদের মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া চারটি আধুনিক নৌ অ্যাম্বুলেন্স স্থানীয়দের কোনো কাজে আসছে না। অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে উপহারের এসব নৌযান। অপরদিকে এগুলো বন্ধ থাকায় দ্রুত চিকিৎসাসেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের। এগুলো কবে থেকে চালু হবে, তাও সঠিকভাবে বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।
জেলার চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষ ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন লক্ষাধিক মানুষের এই চরে কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার নির্ভরযোগ্য কোনো নৌযান ছিল না। এতে তাদের নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। তাদের এ দুর্ভোগ লাঘবে ২০১৭ সালে জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনপুরা উপজেলায় প্রথম একটি নৌ অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে একে একে ২০১৮ সালে দৌলতখান, ২০১৯ সালে চরফ্যাশন ও ২০২০ সালে তজুমদ্দিন উপজেলায় আরও তিনটি নৌ অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। প্রথম দিকে এগুলো স্থানীয়দের উপকারে আসে। কিন্তু পরে চালক না থাকা, জ্বালানিসংকটসহ নানা অজুহাতে তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি। ফলে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে অবহেলায় অযত্নে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের চারটি নৌ অ্যাম্বুলেন্স অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও অবহেলার কারণে এসব অ্যাম্বুলেন্স পানিতে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এরমধ্যে দৌলতখান ও চরফ্যাশনের নৌ অ্যাম্বুলেন্স দুটি নদীর জোয়ারে তলিয়ে গিয়ে আবার ভাটায় জেগে উঠেছে। আর তজুমদ্দিন ও মনপুরার বাকি দুটিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে আছে। ফলে দুর্গম এলাকার বাসিন্দাদের অতিরিক্ত ব্যয়ে চিকিৎসা নিতে শহরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে চর জহিরউদ্দিনের বাসিন্দা আবুল কালাম ও বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেওয়া নৌ অ্যাম্বুলেন্সের বিষয়টি চরের অনেক মানুষ জানেই না। এ বিষয়ে কখনো কোনো প্রচারও শুনিনি। তজুমদ্দিন সি-ট্রাক ঘাটে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের নৌ অ্যাম্বুলেন্সটি পড়ে আছে অযত্নে-অবহেলায়। আর চরের অসুস্থ শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীর চিকিৎসায় উপজেলা সদরে আনতে হয় নৌকায়। রোদ-বৃষ্টির মধ্যে নদী পারাপারের সময় রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে যান।’
চরফ্যাশন উপজেলার সাগর মোহনার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর কুকরি-মুকরি ইউনিয়নের বাবুগঞ্জ গ্ৰামের ফিরোজ কবিরাজ জানান, তার মেয়ে দুই মাস আগে সন্তান প্রসব করেছেন। ওই এলাকায় কোনো হাসপাতাল না থাকায় তিন হাজার টাকা দিয়ে স্পিডবোট ভাড়া করে কচ্ছপিয়া হয়ে অ্যাম্বুলেন্সে চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে হয়েছে। এতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় ও ফিটনেসবিহীন নৌযানে ধকল সহ্য করতে হয়েছে। অথচ কচ্ছপিয়া ঘাটে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের সরকারি একটি নৌ অ্যাম্বুলেন্স পানিতে ডুবে আছে।
একই ইউনিয়নের শাহবাজপুর গ্রামের দিনমজুর রাকিব হোসেন জানান, তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুনকে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে হয়েছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় কচ্ছপিয়া ঘাটে যেতে দেড় হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। খোলা ট্রলারে নদীর ঢেউ একজন প্রসূতির জন্য কষ্টকর। অর্থের অভাবে তার মতো অনেকেই স্বাস্থ্যসেবা পেতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
ভোলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় আম্পানসহ নানা কারণে ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দৌলতখান উপজেলার, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি চরফ্যাশন উপজেলার, ২০২০ সালে ২২ মে তজুমদ্দিন উপজেলারটি ও সর্বশেষ ২০২১ সালের ৩০ মে মনপুরা উপজেলার নৌ অ্যাম্বুলেন্সটি বিকল হয়। সিভিল সার্জন দপ্তরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নৌ অ্যাম্বুলেন্সগুলো খরস্রোতা মেঘনা নদীতে চলাচল অনুপযোগী ও গতি কম।
ভোলা সিভিল সার্জন ডা. কে এম শফিকুজ্জামান বলেন, ‘বিকল হওয়া প্রতিটি নৌ অ্যাম্বুলেন্সের মেরামতের জন্য আকু বিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৪ লাখ টাকা করে বাজেট দিয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অর্থ বরাদ্দের জন্য একটি চাহিদাপত্র দিয়েছি। বরাদ্দ পাওয়া গেলে দ্রুত নৌ অ্যাম্বুলেন্সগুলো মেরামত করে চালু করা সম্ভব হবে।’