বরিশাল নগরীর আলেকান্দা এলাকার পলিটেকনিক সড়কের বাসিন্দা নাহিয়ান আমিন। তার মা-বাবাসহ স্বজনরা স্বপ্ন দেখতেন নাহিয়ান একদিন মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে। দেশ-বিদেশে তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু সেই স্বপ্ন নিমেষেই শেষ হয়ে গেল গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়।
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে যে ৪৬ জন নিহত হয়েছেন, সেই তালিকায় আছেন বরিশাল নগরীর পলিটেকনিক রোডের রিয়াজুল আমিনের ছেলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী নাহিয়ান আমিনের নাম। তিনি ২২তম ব্যাচের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
নাহিয়ানের ফুফাতো ভাই বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. নাভিদ নূর জানান, নাহিয়ানের বাকপ্রতিবন্ধী বাবা নগরীর একটি বেসরকারি ক্লিনিকে কর্মরত। মা একজন গৃহিণী। দুই ভাইবোনের মধ্যে নাহিয়ান ছোট। একমাত্র বোন মালিহা মেনহাজ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। অতি সাধারণ পরিবারের বেড়ে ওঠা নাহিয়ান অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ডা. নাভিদ বলেন, ‘তাকে নিয়ে সবাই গর্ব করতাম। কী বলব, ভাষা হারিয়ে ফেলছি। আমাদের সেই স্বপ্ন সবই শেষ হয়ে গেছে। এ ক্ষতি শুধু আমাদের হয়নি। পুরো বরিশালের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।’
নাহিয়ানের বাড়ি গিয়ে জানা যায়, গতকাল সকাল থেকেই ওই বাড়ির সমানে মানুষের ভিড় জমতে থাকে। বেলা ৩টা পর্যন্ত তার বাবা-মা জানতে পারেননি ছেলের অবস্থা। বেলা আড়াইটার দিকে ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স বরিশালে পৌঁছলেও তার বোনসহ অন্য স্বজনদের বহন করা গাড়ি পেছনে থাকায় লাশবাহী গাড়িটি রাখা হয় প্রিয় বিদ্যাপীঠ বরিশাল জিলা স্কুলের পেছনের একটি মাঠে। পরে বেলা সাড়ে ৩টায় বোন ও স্বজনদের বহনকারী গাড়ি দুটি আসার পর পলিটেকনিক রোডের বাসায় নেওয়া হয় নাহিয়ানের নিথর দেহ। বাড়ির সামনে লাশবাহী গাড়ি এসে পৌঁছামাত্র কান্নায় ভেঙে পড়েন নাহিয়ানের মা-বাবাসহ স্বজনরা। এ সময়ে বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে।
একমাত্র বোন মালিহা মেনহাজ ভাইয়ের দেহের পাশে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। বাকপ্রতিবন্ধী বাবা রিয়াজ উল আমিনের ভেতরটি ভেঙেচুরে গেলেও তা প্রকাশ করতে পারছিলেন না। দুই চোখে অশ্রু। মা জ্ঞান হারাচ্ছিলেন বারবার।
নাহিয়ানের হাউস টিচার বরিশাল জিলা স্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সে আমাদের বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিল। এসএসসি পরীক্ষায় বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল। এমনকি ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বুয়েটে চান্স পায়। একজন নম্র-ভদ্র, বিনয়ী এবং নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলিসম্পন্ন একজন মেধাবীকে হারালাম আমরা।’ কথা বলার সময়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি।
এদিকে গতকাল আসরের পর বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নগরীর বিভিন্ন স্তরের মানুষ এতে অংশ নেন। পরে নগরীর মুসলিম গোরস্তানে দাদা-দাদির কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
মৃত্যুর ১৯ ঘণ্টা আগেও ফেসবুকে ২৯ ফেব্রুয়ারি লিপ ইয়ায়ের দিনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে নাহিয়ান লিখেছিলেন, হয়তো চার বছর পর আবার ২৯ ফেব্রুয়ারির এমন একটা দিনের দিকে ফিরে তাকাব। নাহিয়ানের দেওয়া শেষ পোস্টটির স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।