পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার সর্দাপাড়া এলাকার নুর আলম। একসময় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেন তিনি। পাথর উত্তোলন করে চালাতেন সংসার। তবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে আটক হয়ে কারাভোগের পর দেশে ফিরে মানসিক ভারসাম্য হারান তিনি। স্থানীয়দের ওপর হামলার অভিযোগে ৭ বছর ধরে শিকলবন্দি জীবনযাপন করছেন তিনি। অন্যদিকে বৃদ্ধ মা নুর নেহার অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনো রকম সংসার চালাচ্ছেন। অর্থের অভাবে করতে পারছেন না সন্তানের চিকিৎসা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঘরের মাঝখানে দরজার একটু অদূরে বাম হাতে শিকল বেঁধে একটি সিমেন্টের পাকা খুঁটিতে নুর আলমকে বেঁধে রাখা হয়েছে। কখনো বসছেন, আবার কখনো শুয়ে একটি কম্বল গায়ে দিচ্ছেন তিনি। তার আশপাশে কোনো মানুষ গেলেই তাদের পা ধরার চেষ্টা করছেন। চাচ্ছেন বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পেতে। এই ঘরের মধ্যেই তাকে দেওয়া হচ্ছে খাবার।
স্থানীয়রা জানান, একসময় নুর আলম স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এলাকাবাসীর ওপর হামলার অভিযোগে গত ৭ বছর ধরে নিজ ঘরেই শিকলে বন্দি রয়েছেন তিনি। একদিকে দরিদ্র পরিবার, অন্যদিকে নুর আলমের বন্দি জীবন। সব মিলিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে পরিবারটি। তবে সঠিক চিকিৎসা পেলে নুর আলম আবারও সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে দাবি স্থানীয়দের।
পরিবার ও স্বজনরা জানান, একমাত্র সন্তান হওয়ায় বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন নুর আলম। জীবিকার তাগিদে বেছে নেন পাথর উত্তোলনের কাজ। প্রতিদিন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মহানন্দা নদীতে গিয়ে নুড়ি পাথর উত্তোলনের কাজ করতেন তিনি। আর এতেই চলতো তার সংসার। পাথর উত্তোলন করার সময় হঠাৎ একদিন সীমান্ত অতিক্রম করার দায়ে নুর আলমকে আটক করে নিয়ে যায় বিএসএফ। পরে ভারতে তিন বছরেরও বেশি সময় কারাভোগের পর দেশে ফেরেন তিনি। বাড়িতে এসেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।পরে পরিবার চিকিৎসা করলেও তার পাগলামি বেড়ে যায়। স্ত্রীসহ পরিবারের লোকজন এমনকি স্থানীয়দের ওপর হামলা করেন। স্ত্রী বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। এরপর বাধ্য হয়ে মা নুর নেহার তার হাতে শিকল বেঁধে রাখেন। অভাবেই ৭ বছর ধরে নুর আলম শিকল বন্দি জীবনযাপন করছেন।
এদিকে বৃদ্ধ মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছেলে নুর আলম ও তিন নাতনিকে নিয়ে কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে দিনরাত্রি পার করছেন। অর্থের অভাবে একমাত্র ছেলের চিকিৎসা করাতে পারছেন না নুর নেহার। স্ত্রী থাকলেও নুর আলমের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে চলে যান তিনি। এ ছাড়া নুর আলমের এক মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলেও বাবার অসুস্থতার কারণে বিয়ে দিতে পারছেন না।
এ বিষয়ে নুর নেহার বলেন, ‘আমার ছেলে আগে সুস্থ ছিল। মহানন্দা নদীতে পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে বিএসএফের কাছে আটক হয়। পরে তাকে ভারতে কারাগারে নিয়ে বন্দি করে রাখে। বাড়িতে ফেরার পর নুর আবোল-তাবোল কথা বলতে থাকে। পরে একপর্যায় পাগল হয়ে যায়। তার পেছনে অনেক টাকা খরচ করেছি; কিন্তু সুস্থ করতে পারিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বৃদ্ধা মানুষ। আমি মানুষের বাসায় কাজ করে আমার ছেলে ও তার সন্তানদের কোনোরকম খাওয়াই। আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই যে, ছেলেকে ভালো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করাব। তাই বাধ্য হয়ে তাকে বেঁধে রাখতে হচ্ছে। আমার সন্তানের চিকিৎসার জন্য সরকার ও সমাজের সবার কাছে সহযোগিতা কামনা করছি।’
এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলা ইউএনও ফজলে রাব্বি বলেন, ‘নুর আলম দীর্ঘদিন ধরে বন্দি জীবনযাপন করছেন। তাকে পারিবারিকভাবে চিকিৎসা করা হলেও তা যথাযোগ্য হয়নি। তার বিষয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা চেষ্টা করব উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসায় সহযোগিতা করার।’