‘কইগো, তোমার বাবার বাড়ি থাকি ইবার ইফতারি আইলো না। লাগা (পাশের) ঘরের বউর বাড়ির ইফতারি তো আইলো।’ এমন কথাগুলো বলছিলেন তামান্না বেগমের শাশুড়ি। তামান্নার মনে দাগ কাটে শাশুড়ির কথা শুনে। কারণ, এ বছর বাবার বাড়ি থেকে এখনো আসেনি ইফতারি। অন্যদিকে বাসিত মিয়ার বেয়াইন মুঠোফোনে বলেন, ‘বেয়াই ইবার ইফতারি পাঠানো লাগতো নায়, কাপড়চোপড় পাঠাই দিয়েন।’
রমজানে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে তামান্নার মতো অনেক মেয়ে অপেক্ষায় থাকেন, কবে আসবে বাবার বাড়ির ইফতারি। একদিকে প্রতীক্ষা করলেও তিনি জানেন তার বাবার আর্থিক দুরবস্থার কথা। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ফল ব্যবসায়ী বাসিত মিয়া ভাবছেন, ইফতার পাঠালে যা খরচ হতো এখন কাপড়চোপড়ে এর দ্বিগুণ হবে।
সিলেটের শত বছরের ঐতিহ্যগত প্রথা মেয়ের বাড়িতে ইফতারি আজ অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘মেয়ের বাড়িতে ইফতারিকে না বলুন’- এমন দাবি উঠেছে। মেয়ের বাড়িতে ইফতারি পাঠানোর বিরুদ্ধে বলছেন অনেকেই। এই প্রথা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে জোরেশোরে।
মৌলভীবাজার শহরের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই অঞ্চলে ইফতার প্রথা পুরোনো ঐতিহ্য। রমজানে বাবার বাড়ি থেকে মেয়ের বাড়িতে ইফতারি পাঠানো হয়। সে ইফতারি শুধু সেই বাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। যেদিন ইফতারি আসবে, সেদিন প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া হয় দাওয়াত। সেই সঙ্গে চলে নীরব এক প্রতিযোগিতা। কার শ্বশুরবাড়িতে কত বেশি পদের ইফতারি এল, কে কতজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াল। যার শ্বশুরবাড়ি থেকে যত বেশি ইফতারি আসে তার তত সুনাম।
এই প্রথার বিলুপ্তি চায় নতুন প্রজন্ম। তারা একে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন। বলছেন, মেয়ের বাড়িতে ইফতারি দেওয়াটা অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের জন্য বিত্তের প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। আবার এই প্রথা পালন করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হতে হয় দরিদ্র মা-বাবাকে।
সংস্কৃতিকর্মী হেলাল আহমদ বলেন, ‘এই প্রথাটি বিলুপ্ত হওয়ার দরকার। ইফতারি নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে অনেক মেয়েকে লাঞ্ছিত হতে দেখেছি। শহরে এই প্রথা কম দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলে এখনো তা চালু আছে। অনেক বাবার সাধ্য নেই ইফতারি পাঠানোর।’
শিক্ষক জাহাঙ্গীর জয়েস বলেন, ‘প্রথা যখন নিয়ম হয়ে যায়, তখন নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে সেটা মারাত্মক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এ নিয়ে মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাটি, নির্যাতন পর্যন্ত হচ্ছে। এটা তখন ব্যাধির মতো হয়ে যায়। এ ধরনের প্রথা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।’
স্থানীয় মাওলানা রাজন আহমদ বলেন, ‘মেয়ের বাড়িতে মাহে রমজানে ইফতারি পাঠানো বহুলপ্রচলিত একটি কুসংস্কার। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই কুপ্রথা এখনো শেকড় ঘেরে আছে।’