ফ্লোর প্রাইস আরোপের কারণে পুঁজিবাজার ছেড়ে চলে যান বিপুলসংখ্যক নারী বিনিয়োগকারী। এরপর কমতে কমতে নারী বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা চলে আসে ৫ লাখের নিচে। পরবর্তীতে বাজারে নারীর অংশগ্রহণ সেভাবে লক্ষ্য করা যায়নি। ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর দেশের পুঁজিবাজারে ফিরে আসতে শুরু করেছে নারী বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে মোট বিনিয়োগকারী ১৬ লাখ। এরমধ্যে ৫ লাখ নারী। অর্থাৎ মোট বিনিয়োগকারীর ২৫ শতাংশই শেয়ারবাজারে নারী বিনিয়োগকারী রয়েছেন।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি সময়ে পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকার পাশাপাশি প্রাইমারি মার্কেটে কিছু ভালো মানের কোম্পানির আইপিও থাকায় আবারও বাজারে যুক্ত হচ্ছে নারী বিনিয়োগকারীরা।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, সম্প্রতি প্রতিদিন গড়ে শতাধিক নারী পুঁজিবাজারের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বিও সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজেটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে বিষয়টি জানা যায়। সিডিবিএলের দেওয়া তথ্যমতে, গত কয়েক বছরের মধ্যে চলতি ২০২৪ সালের প্রথম দুই মাসে সবচেয়ে বেশি নারী বিও অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। পুঁজিবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, এটাকে ইতিবাচক প্রবণতা বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের (বিপিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময় অনেক নারী উদ্যোক্তা পুঁজিবাজারে আসছেন। এটি একটি ভালো দিক। আমি একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে এজন্য গর্ববোধ করছি। আমি একজন নারী হিসেবে ২০০৮ সাল থেকে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের এমডির দায়িত্ব পালন করছি। আমাদের দেশে এমন অনেক নারী রয়েছেন যারা পুঁজিবাজারে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) সাবেক নির্বাহী প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. মাহমুদা আক্তার খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করতে পুঁজিবাজারে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। নারীরা এখনো এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন কারণে নারীরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করেন। এসব সমস্যা শিক্ষার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব।
তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বিনিয়োগকারী হিসেবে নারীদের সুপ্ত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এতে এসব বিনিয়োগ থেকে নারী বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবে বলে তিনি মনে করেন।
বিআইসিএমের সহকারী অধ্যাপক কাশফিয়া শারমিন বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীরা অবহেলিত। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের আর্থিক স্বাধীনতা নেই। আর্থিক বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে নারীদের পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সেখানেও মাত্র এক-চতুর্থাংশ নারী বিনিয়োগকারী।’ কাশফিয়া শারমিন বলেন, বিনিয়োগ আগে শিখতে হবে। তারপর মার্কেটে আসতে হবে। কোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জেনে বিশ্লেষণ করে তারপর বিনিয়োগ করুন। সফলতা পাবেন।
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্যে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে পুঁজিবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৭টি। মার্চ মাসের ৫ তারিখে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ লাখ ৩১ হাজার ৬৪৮ টিতে। অর্থাৎ দুই মাসের ব্যবধানে পুঁজিবাজারে নারী বিনিয়োগকারী বেড়েছে ২ হাজার ১৬১।
সিডিবিএল সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চের ৫ তারিখে পুঁজিবাজারে নারী-পুরুষ মিলিয়ে মোট বিও অ্যাকাউন্ট ছিল ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৭টি। এরমধ্যে পুরুষ বিনিয়োগকারীর ছিল ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৭১৯টি। দেশের পুঁজিবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ২৫ শতাংশ।
দেশের পুঁজিবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং সঠিক বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করতে বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমের আয়োজন করে আসছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট (বিআইসিএম)। দেশের দুই পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)।
বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের কমিশন এবং স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম, প্রাইমারি মার্কেট (আইপিও) বিনিয়োগ, সেকেন্ডারি মার্কেট (স্টক এক্সচেঞ্জে) বিনিয়োগ, সিকিউরিটিজ অ্যানালাইসিস ও পোর্টফলিও ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
তথ্যে দেখা যায়, পুঁজিবাজারে পুরুষদের তুলনায় নারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা এখনো সীমিত। তবে বিএসইসির নানা উৎসাহমূলক উদ্যোগে বর্তমানে নারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী বিনিয়োগকারীদের আর্থিক জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নিয়মিতভাবে নারী বিনিয়োগকারীদের নিয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করে আসছে।
ট্রাস্ট রিজিওনাল ইক্যুইটি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া শারমিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘তার সব নারী বন্ধুরা ব্যাংকিং সেক্টরে কাজ করছেন। তিনি একাই রয়েছেন পুঁজিবাজারে। তিনি বলেন, প্রতিদিনের নিয়মমাফিক গদবাধা কাজ থেকে এই সেক্টরটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ খাতে প্রতিদিন যে পরিবর্তন আসছে, তা মোকাবিলা করতে তার ভালো লাগে।’
পুঁজিবাজারে নারীদের আরও বেশি অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রথমেই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নারীরা যে এ সেক্টরে কাজ করতে পারে, তা সবাইকে মানতে হবে। তিনি বলেন, শুধু নারী বলে বড় কোনো কোম্পানি পরিচালনা করতে পারবে না, তা কিন্তু নয়।’
দায়িত্বপূর্ণ পদগুলোয় নারীদের সংখ্যা কমের কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুরুতেই পরিবার থেকে একটা বাধা কাজ করে। যেমন কোনো প্রোগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণে বাধা, সন্ধ্যার পর নারীরা ঘরের বাইরে বের হতে পারবে না ইত্যাদি। তাই প্রথমেই পরিবারের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। ছেলে বা মেয়ে ভেদাভেদ না করে মেয়েকে সন্তান হিসেবেই ভাবতে হবে।
দেশের বিভিন্ন জেলাতে বিএসইসি কর্তৃক আয়োজিত বিনিয়োগ শিক্ষা কর্মসূচিতে নারী বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ সেশনের আয়োজন থাকে। সেখানে সমাজে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন নারী তাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার অভিজ্ঞতা বিনিময় করে থাকেন এবং অন্য নারীদেরও উৎসাহ প্রদান করেন কীভাবে পুঁজিবাজারসহ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে সফলতা লাভ করা যায়।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নিজ প্রতিষ্ঠানসহ স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বিভিন্ন আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানে নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপদ ও নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করার জন্য প্রতিনিয়ত নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে বিএসইসির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মহিলা কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ড. রুমানা ইসলাম, যা বিএসইসিতে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে একটি বড় অগ্রগতি।
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী বর্তমানে বিএসইসিতে কর্মরত আছেন। বর্তমানে দুই স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদে নারী পরিচালক রয়েছেন। ওরাকলের বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবাবা দৌলা ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ব্রোকার হাউস, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিসহ বিভিন্ন বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
২০১৫ সালে জাতিসংঘে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে মোট ১৭টি লক্ষ্য স্থির করা হয় যার অন্যতম লিঙ্গ সমতা অর্জন ও নারী ক্ষমতায়ন। দেশের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। কোনো দেশের বিনিয়োগ সক্ষমতার অন্যতম মাপকাঠি হলো সঞ্চয়-জিডিপি অনুপাত।