দেশের পুঁজিবাজারে চলমান অব্যাহত দরপতন রোধের জন্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নতুন মূল্যসীমা বেঁধে দিয়েছে। তবে বিএসইসির সেই উদ্যোগ কাজে আসেনি। উল্টো দরপতনের সীমা বেঁধে দেওয়ার দিনেই বাজারে বড় পতন হয়েছে।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক ডিএসইএক্স গত বৃহস্পতিবার দিন শেষে ৬০ পয়েন্ট বা ১ শতাংশের বেশি কমে নেমে এসেছে ৫ হাজার ৫১৮ পয়েন্টে। গত তিন বছরের মধ্যে এটিই ডিএসইএক্সের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে সর্বশেষ ২০২১ সালের ৩ মে ডিএসইএক্স সূচক ৫ হাজার ৫১১ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল।
একই দিন দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচকটি ১৬৪ পয়েন্ট বা ১ শতাংশের বেশি কমেছে। সূচকের পাশাপাশি দুই বাজারে লেনদেনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে।
পুঁজিবাজারের পতন ঠেকাতে গত বৃহস্পতিবার থেকে শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের দাম কমার সর্বোচ্চ সীমা ৩ শতাংশে বেঁধে দেয় বিএসইসি। গত বুধবার বিকেলে এ আদেশ জারি করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে শনিবার (২৭ এপ্রিল) তালিকাভুক্ত কোনো শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের দাম ৩ শতাংশের বেশি কমার সুযোগ ছিল না। তবে এ নিয়ম কার্যকর করার দিনেই পুঁজিবাজারে বড় পতন হয়।
বিএসইসির এসব উদ্যোগ খুব বেশি কার্যকর হবে বলে মনে করেন না বিনিয়োগকারী, বিশ্লেষক ও বাজারসংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘পুঁজিবাজার ভালো করেতে ৩ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার কোনো কাজে আসবে বলে আমার মনে হয় না। এর ফলে বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। বারবার এ ধরনের পদক্ষেপ না নিয়ে পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে ব্যবস্থা নেওয়া।
এ বিষয়ে মিডওয়ে সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারের পতন রোধে ৩ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার কোনো সমাধান হতে পারে না। পুঁজিবাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া উচিত। ফ্লোর প্রাইস ওঠানের পর দেশের পুঁজিবাজারে দর সংশোধন যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখনই নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
ঢাকার বাজারে গত কার্যদিবসে লেনদেন হওয়া ৩৯৬ কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩০০টির বা ৭৬ শতাংশেরই দাম কমেছে। দাম বেড়েছে ৬৯টির বা ১৭ শতাংশের, আর অপরিবর্তিত ছিল ২৭টির বা ৭ শতাংশের। ঢাকায় লেনদেন ছিল ৫১১ কোটি টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে ৯২ কোটি টাকা কম। আর চট্টগ্রামের বাজারে এদিন লেনদেন হয় ১১ কোটি টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে ১৫ কোটি টাকা কম।
বড় ধরনের মূল্য পতনের জন্য বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ঘন ঘন নীতি পরিবর্তনকে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন। তারা বলেছেন, অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই বারবার নীতি বদলের ফলে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
পুঁজিবাজারে দরপতনের শেষ কোথায়- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারে সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারা, খারাপ কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়া এবং পুঁজির সুরক্ষা দিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কার্যকর উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ তুলেছেন বিনিয়োগকারীরা।
ঈদের ছুটিতে যাওয়ার আগে ব্যাপক দরপতনে প্রায় আড়াই মাসে ডিএসইর বাজার মূলধন বা মোট শেয়ারের সম্মিলিতভাবে দাম কমে যায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। ঈদের পর বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু ছুটি শেষে পুঁজিবাজারে টানা ছয় কর্মদিবস পতন হয়।
এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার ব্রোকার ও ডিলারদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএসইসি। বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানায় সংস্থাটি। এই খবরে ওই দিন সূচক বাড়ে। তবে পরের দিনই আবার পতন দেখা দেয়।
গত বৃহস্পতিবার ঈদের পর লেনদেনের ৯ কর্মদিবসের মধ্যে পতন হয়েছে সাত দিনই। এতে ঈদের পর ডিএসইর সূচক কমেছে ৩৪৫ পয়েন্ট।
ধারাবাহিক পতনের কারণে গত মঙ্গলবার মতিঝিলে মানববন্ধন করেন বিনিয়োগকারীরা। তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পুঁজিবাজারে খারাপ কোম্পানি তালিকাভুক্তের অনুমোদন, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে না পারা এবং পতন রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিবাদ জানান তারা।
এরপর গত বৃহস্পতিবার দরপতনের সর্বনিম্ন সীমা ৩ শতাংশ বেঁধে দেয় বিএসইসি। তবে মূল্যবৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা আগের মতোই ১০ শতাংশ রয়েছে।