একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার ও পরিচালক আবুল হায়াত। গত ৮ সেপ্টেম্বর নিজের ৮০ বছরে পা রেখেছেন এ গুণী অভিনেতা। এ দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি মঞ্চনাটক থেকে চলচ্চিত্র, লেখক থেকে পরিচালক সব জায়গায় বাংলা সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। নিজের কর্মময় ৮ দশককে গ্রন্থাবদ্ধ করেছেন এই জীবন্ত নক্ষত্র। নিজের আত্মজীবনীর নাম রেখেছেন 'রবি পথ-কর্মময় ৮০'।
শনিবার (২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমিতে এক বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন হয়। অভিনেতার নানা অভিজ্ঞতা, গল্প ও ঘটনা নিয়ে ‘রবি পথ’ বইটি লেখা। প্রায় দশ বছর ধরে পরম যত্নসহকারে বইটি লিখেছেন বলে জানান তিনি। আবুল হায়াতের ডাক নাম রবি। ডাক নামেই নিজের আত্মজীবনীর নাম রাখা হয়েছে বলে জানান এ অভিনেতা।
মোড়ক উন্মোচনের আগে বইটির বিভিন্ন ভাগ থেকে অতিথিদের সামনে পড়ে শোনান নাট্যাঙ্গানের পরিচিতমুখেরা। তাদের মধ্যে ছিলেন আজাদ আবুল কালাম, অপি করিম, দীপা খন্দকার, রওনক হাসান, ইন্তেখাব প্রমুখ।
গভীর মনোযোগসহকারে উপস্থিত সবাই আবুল হায়াতের লেখা কথাগুলো শুনছিলেন, আর গভীরভাবে মোহিত হচ্ছিলেন। গ্রামে বেড়ে উঠা থেকে শুরু করে শহরের লেখাপড়ার জীবনের গল্প শুনে মনে হচ্ছিল এ গল্প শুধু আবুল হায়াতের একার নয়। সবাই যেন কোনো না কোনোভাবে গল্পের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পাচ্ছিলেন।
গল্পপাঠের ফাঁকে ফাঁকে আবুল হায়াৎকে নিয়ে স্মৃতি চারণ করেন আমন্ত্রিত গুণীজনেরা। উপস্থিত ছিলেন মামুনুর রশিদ, নওয়াজিশ খান, সারা জাকের মতো পদকপ্রাপ্ত নাট্যকার ও শিল্পীরাও। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন তারিক আনাম খান, নরেশে ভুঁইয়া, আবুল হায়াতের দুই কন্যা বিপাশা হায়াৎ, নাতাশা হায়াত প্রমুখ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
অভিনয় শিল্পী সঙ্গের ব্যানারে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানের সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন অপি করিম।
গুণীজনদের কথা ও গল্পপাঠ শেষে আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে নিজের আত্মজীবনের মোড়ক উন্মোচন করেন আবুল হায়াৎ। এরপর জীবনসঙ্গীনি মাহফুজা খাতুন শিরিন ও দুই মেয়ে বিপাশা হায়াত ও নাতাশা হায়াতকে নিয়ে মঞ্চে ওঠেন আবুল হায়াত, আবেগঘন কথা বলেন দর্শকদের উদ্দেশ্যে।
নিজের আত্মজীবনী সম্পর্কে আবুল হায়াত বলেন, ‘বইটা কেন লিখেছি, এর কোনো জবাব নেই। ১০ বছর ধরে লিখেছি, বইটা পড়লেও সবাই তা টের পাবেন। আমি নিজেও তো অনেকের বই পড়েছি। ভাবলাম, লিখি না, আমার জীবনেও তো অনেক ঘটনা আছে। বই লেখার ক্ষেত্রে যে ঘটনা আমাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে, মুর্শিদাবাদ থেকে একটি পরিবার চট্টগ্রামে এল শুধু টেবিলে বসে একটা দাগ টানার কারণে। যখন বলা হলো, এটা হিন্দুস্তান, এটা পাকিস্তান। তার কারণে আমার মা-বাবা একটা দেশ ছেড়ে আরেকটা দেশে এলেন। বোঝালেন যে এটা তোমার দেশ না, ওটা তোমার দেশ। প্রথমত, সেখান থেকে কষ্টটা, ক্ষতটা আমি আমার লেখায় ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। তারপর আমি যে তিন বছর বয়সে এলাম, এরপর বড় হলাম—সেই বিষয়গুলো লিখতে লিখতে মনে হলো, বাকি জীবনটা লিখে ফেলি। এরপর অনেকবার ফেলে রেখেছি, অবহেলা করেছি। এক পাতা লিখেছি, ছিঁড়ে ফেলেছি। দশ পাতা লিখেছি। তারপরও পড়ে ছিল বহুদিন। বিপাশা নিয়মিত বলত লেখার ব্যাপারে। আমি বলেছিলাম, আমার জীবনী কে পড়বে? তখন বিপাশা বলেছিল, তুমি তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখক। তোমার জীবনী তোমার চেয়ে ভালো কেউ লিখতে পারবে না। আমি চাই, তোমার জীবনীটা লেখা হোক। এটা মনে হয়েছে, হ্যাঁ, তাই তো, আমার জীবনী আমার চেয়ে ভালো আর কে লিখবে। আমিও তারপর ভাবলাম, লিখি। এরপর তিথি (বইটির প্রকাশক) যখন বলল, ‘আমি ছাপাব।’ তখন তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করলাম। ভেবেছি আর সময় পাব কি না। এভাবেই লেখা হলো।’
গুণী এ অভিনেতা গত ৩ বছর যাবৎ ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করছেন। স্ত্রী শিরিন হায়াতকে কাছে টেনে কান্নাজড়িত কন্ঠে শোনালেন অসুস্থতা ও ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করার গল্প।
তিনি বলেন, ‘আজ থেকে তিন বছর আগে চিকিৎসক বললেন, আমার ক্যান্সার হয়েছে। আমি জানতে পারলাম, আমি ক্যান্সার রোগী। হাসপাতাল থেকে বাসা পর্যন্ত আর কথা বলতে পারিনি। পুরো রাস্তা আসার সময় তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। রাতে খাওয়া দাওয়া করে আমি শুয়ে ছিলাম। অন্ধকারে একা কাঁদছি। হঠাৎ টের পেলাম, উনি পাশে এসে শুয়েছেন। আমি তখনো নিঃশব্দে কাঁদছি। হঠাৎ ওনার একটা হাত আমার গায়ে এসে পড়ল। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। তখন উনি বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এই রোগটা তোমাকে কেন দিল, আমাকে দেখতে পেল না?’ বলেই হাউমাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সারাটা জীবন আমার সঙ্গে, আমার দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, আনন্দ সবকিছুতে সে। আজকে আমি এই যে তিনটা বছর ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করছি, শুধু তাঁর কারণে। সে আমার সবচেয়ে বড় সহযোদ্ধা, আমাকে শিখিয়েছে, আই এম অ্যা ফাইটার।’
আবুল হায়াত যখন এসব কথা বলছিলেন তখন পুরো মিলায়তনটা কেমন জানি ভারী হয়ে উঠল। শুধু মঞ্চে আবুল হায়াতের সাথে তার পরিবার কাঁদছিলো এমন নয়, এ কান্না স্পর্শ করেছিল উপস্থিত সকলকে। সবাই দাঁড়িয়ে জীবনের এ লড়াইয়ে অভিনতাকে জানালেন অভিবাদন, করতালি দিয়ে জোগালেন সাহস। অভিনেতাও বললেন, ‘আমি শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ করে যেতে চাই। আপনারা দোয়া করবেন।’
হাসান