ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দুই বছর পূর্তি আজ (২৪ ফেব্রুয়ারি)। গত দুই বছরে এই যুদ্ধ পাল্টে দিয়েছে বিশ্বের ভূরাজনীতি ও অর্থনীতির চিরচেনা রূপ। পরিবর্তন এসেছে ইউরোপের সুরক্ষা চিন্তাভাবনাতেও। আকারে বড় হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো। যুদ্ধের মাশুল গুনতে হচ্ছে ভৌগোলিকভাবে দূরে থাকা রাষ্ট্রগুলোকেও। তবে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধের সূত্রপাত হলেও এখনো সেই জোটে ঠাঁই মেলেনি তাদের।
ইউক্রেনের জন্য এ যুদ্ধ নিয়ে এসেছে বিপর্যয়। তাদের জনসাধারণ মারা যাচ্ছে, অবকাঠামো ধ্বংস হচ্ছে। এমনকি ভূখণ্ডের কিছু অংশের দখলও হারিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের ইউক্রেনবিষয়ক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ মিশন (এইচআরএমএমইউ) জানায়, জানুয়ারি পর্যন্ত দুই বছরের যুদ্ধে ইউক্রেনের ১০ হাজার ৩৭৮ জন বেসামরিক লোক প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৫৬০টি শিশুও আছে। এ ছাড়া ওই সময় পর্যন্ত আহত হয়েছেন ১৯ হাজার ৬৬২ জন।
অন্যদিকে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী থেকে দাবি করা হয়, যুদ্ধে ইউক্রেনের অন্তত সাড়ে ৩ লাখ সেনা মারা গেছে। তবে নিজেদের পক্ষে হতাহতের কোনো সঠিক হিসাব না দিলেও যুদ্ধের দৈনন্দিন হিসাব অনুপাতে বিবিসি জানায়, রুশ সেনা নিহতের সংখ্যা ১ লাখের বেশি। এসব হিসাবের পরও হতাহতের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে দুই পক্ষেরই।
নিউইয়র্ক টাইমসের চলতি মাসের এক প্রতিবেদন বলছে, যুদ্ধে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। বিপুল সৈন্য মারা গেছে। কিন্তু তারা তা নিয়ে সেভাবে মুখ খুলছে না। অনেক রুশ নাগরিকও এ নিয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেন্টাগনের এক কর্মকর্তা জানান, যুদ্ধে রাশিয়ার সেনা মারা গেছে প্রায় ৬০ হাজার। আহত হয়েছেন ৩ লাখের মতো।
রয়টার্সের গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী এ যুদ্ধ শুরু করেছিল ৩ হাজার ৩০০ ট্যাংক নিয়ে। সেগুলোর মধ্যে ২ হাজার ২০০টি ধ্বংস হয়ে গেছে।
পশ্চিমাদের মনোযোগে ঘাটতি
এসব ডামাডোলের মধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোর একক মনোযোগ হারিয়েছে ইউক্রেন। গাজা যুদ্ধের কারণে সেদিকেও ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে তাদের। ইসরায়েলের পক্ষে কথা বলা, গাজায় সহায়তা পাঠানো নিয়েই বেশি সরব হতে দেখা গেছে পশ্চিমা দেশগুলোকে।
অন্যদিকে গত দুই বছরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকারকে আরও স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করে তুলেছে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৈশ্বিক জিডিপির গড় হারের চেয়ে দ্রুত বাড়ছে। দেশটির মজুরি বেড়েছে। গতিশীল হয়েছে রুশ অর্থনীতি। সব মিলিয়ে আরও শক্ত হয়েছে পুতিনের অবস্থান।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস আটকে দিয়েছে ইউক্রেনের জন্য বরাদ্দ হওয়া ছয় হাজার কোটি ডলারের সহায়তা তহবিল। আধুনিক অস্ত্র পাওয়ার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে ধরনা দিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন। কিন্তু তাদের এ আবেদনে সেভাবে সায় দিচ্ছে না জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেন দুই বছর ধরেই রাশিয়াকে নিজ মাটি থেকে হটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সরবরাহ, কৌশল ও অর্জন– সবই কিছুটা কমেছে প্রথম বছরের তুলনায়।
ইউক্রেনের শস্য রপ্তানিতে বাধা
যুদ্ধের আগে ইউক্রেনকে বলা হতো ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’। এ দেশটি থেকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে গম, যব, বার্লি, ভুট্টা, সূর্যমুখী ফুলের তেল সরবরাহ হতো। রাশিয়ার আক্রমণের আগে বিশ্বের ৪০ কোটির বেশি মানুষ ইউক্রেনীয় সরবরাহের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পরপরই হঠাৎ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যায় তেল ও শস্যের দাম। সে সময় কৃষ্ণসাগর বন্দর রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ দিয়ে অবরুদ্ধ ছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে শস্য রপ্তানি বন্ধ থাকে কয়েক মাস। সে সময় অস্থিতিশীলতা বাড়তে শুরু করে বিশ্ববাজারে।
পরের বছরের জুলাইয়ে তুরস্ক ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে শস্যচুক্তি হয়। ওই চুক্তির আওতায় বিশ্ববাজারে ইউক্রেনের শস্য সরবরাহ নিরাপদে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে উভয় পক্ষ সম্মত হয়।
এর প্রায় এক বছর পর গত বছরের জুলাইয়ে ওই চুক্তি থেকে সরে আসে রাশিয়া। সে সময় ইউক্রেনের হাতে পথ খোলা ছিল দুটি। এক. প্রতিবেশী দেশ রোমানিয়া ও পোল্যান্ডের ওপর দিয়ে শস্য সরবরাহ করা। দুই. দানিয়ুব নদীর মাধ্যমে মধ্য ইউরোপে শস্য পাঠানো।
বিশেষজ্ঞরা সে সময় বলেছিলেন, স্থলপথে প্রতিবেশী দেশের ওপর দিয়ে রপ্তানি করলে দেশগুলোর বাজার শস্যে সয়লাব হতে পারে ও সেখানকার কৃষকরা অসন্তুষ্ট হতে পারেন। বাস্তবেও তা-ই হয়েছে। দিন কয়েক আগেও পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্তে অবস্থান নিতে দেখা গেছে ক্ষুব্ধ পোলিশ কৃষকদের। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বিক্ষোভ করেছেন কৃষকরা।
জ্বালানির দামে অস্থিরতা
ইউক্রেন যুদ্ধ বাস্তবতায় শুরু থেকেই রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছিল পশ্চিমা দেশগুলো। এসবের জেরে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে জ্বালানির দাম। সে অবস্থা এখনো বিদ্যমান। জ্বালানির মূল্য পুরো বিশ্বেই বেড়েছে। আর এর প্রভাব পড়েছে সার থেকে শুরু করে পরিবহন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামে।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমাসহ সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলারের। তবে গোটা বিশ্বের মূল্যস্ফীতির দায় একা ইউক্রেন যুদ্ধের না হলেও এতে বিষয়টির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রেখেছে মূলত সরবরাহসংকট ও ডলারের দাম। প্রায় সব দেশকেই ডলারের বিপরীতে নিজ মুদ্রার মান কমাতে হয়েছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছর বেশ কটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ। সেসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে কংগ্রেস থেকে সহায়তা প্যাকেজ ছাড়, আধুনিক অস্ত্র পাওয়া, গাজার যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
এ বছর রাশিয়াতেও নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। ধরেই নেওয়া হচ্ছে, আবারও পুতিনকে দেখা যাবে ক্ষমতায়। সম্প্রতি রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা ও কট্টর পুতিন সমালোচক অ্যালেক্সেই নাভালনির মৃত্যু হয়েছে দেশটির মেরু অঞ্চলের কারাগারে। তাই পুতিনের বিরুদ্ধে আন্দোলন বেগবান হবে, না মুখ থুবড়ে পড়বে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
এসবের মধ্যে নতুন করে আবারও নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পশ্চিমারা। গতকাল শুক্রবার রাশিয়ার পাঁচ শরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।