নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘দেবদেবীর অভিশাপে আমি অভিশপ্ত। অভিশপ্ত জীবনটা বড় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাই আমাকে লোহার খাঁচায় ঢুকতে হয়েছে। অপমানের চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে লোহার খাঁচায় ঢুকতে হয়।’
রবিবার (২ জুন) আদালত থেকে বের হওয়ার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে এই মন্তব্য করেন তিনি।
এদিন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেনের আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের চার্জগঠনের বিষয়ে শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালত আগামী ১২ জুন আদেশের জন্য দিন ধার্য রাখেন।
শুনানির শুরুতে আদালতের এজলাসকক্ষে আসামিদের জন্য তৈরি করা লোহার খাঁচায় (আসামির কাঠগড়া) দাঁড়ান তিনি। খাঁচায় দাঁড়ানোর এই অভিজ্ঞতাকে ‘অভিশপ্ত জীবনের অংশ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ড. ইউনূস।
তার আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, শুনানির শুরুতে আদালত ড. ইউনূস ছাড়া বাকি আসামিদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বলেন। তখন ড. ইউনূস বলেন, ‘তার জন্য অন্যদের এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাই তিনি নিজেও লোহার খাঁচায় তৈরি আসামির কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ান। মিনিট দুয়েক পর সবাই বিচারকের অনুমতি নিয়ে এজলাসকক্ষের বেঞ্চে গিয়ে বসেন।’
আদালত থেকে বের হওয়ার পর ড. ইউনূস গণমাধ্যমকে বলেন, লোহার খাঁচার তৈরি আসামির কাঠগড়া তো অপমানজনক। অপমান করার জন্য এটি করা হয়েছে। এটা তো আর সম্মান দেওয়ার জন্য বানানো হয়নি। অপমানের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বানানো হয়েছে। আজ আমি অভিশপ্ত জীবনের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছি। এই প্রথম আমাকে লোহার খাঁচায় দাঁড়াতে হলো।
আদালতে আনা অভিযোগ বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘এ ঘটনার মধ্যে কোনো সত্যতা নেই। যে জিনিস আমি দিয়ে দিয়েছিলাম, সেটার জন্য আমাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। আমার সঙ্গীরা আজ অভিশপ্ত। এটা আমার মনে কঠিনভাবে দাগ কেটেছে। আমার পরিবারকে আক্রমণ করেছে। আমার বাবাকে আক্রমণ করেছে। এটা আমার কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এটা আমার অভিশপ্ত জীবনের অংশ।’
তিনি বলেন, ‘এটা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা যে লোহার খাঁচার মধ্যে দাঁড়িয়েছিলাম আদালতের কাঠগড়ায়। এটা অভিশপ্ত জীবনের একটা অংশ। আমরা নোবেল পুরস্কারের কথা সবাই জানি। দুইটা নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। একটা ছিল আমার নামে, আরেকটা গ্রামীণ ব্যাংকের নামে। দুইটারই সমান গুরুত্ব ও মর্যাদা। কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম নয়। এটা যৌথভাবে দেওয়া হয়েছে, তাও না। দুইটাই স্বাধীনভাবে দেওয়া হয়েছে।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো নজির নাই, একজন নোবেল বিজয়ী আরেকজন নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে মামলা করতে দুদকে হাজির হয়েছে। এটা আমাদের কপালে হলো। এটা অভিশাপের একটা অংশ। যে অভিশাপ আমরা গ্রহণ করে যাচ্ছি। সে অভিশাপ এমনভাবে হয়েছে, একটা নোবেল বিজয়ী এবং এ নোবেল বিজয়ী হলো খুবই সম্পৃক্ত নোবেল বিজয়ী। অনেকটা পিতা-পুত্রের সম্পর্কের মতো নোবেল বিজয়ী। যে আমার কারণে এটা সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। সেটাও আমার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পেয়েছে। এটারই একটা অংশ। যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে দুজনের মধ্যে একজন। এটা আমার বিরুদ্ধে এমনভাবে নিয়ে আসলো খুব কঠিন ভাষায়, রূঢ় ভাষায় আক্রমণ করে।’
তিনি বলেন, ‘অভিযোগ থাকতে পারে কিন্তু রূঢ় ভাষায় আক্রমণ করে অভিযোগগুলো করে। যে অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। এ ব্যাপারে আপনাদের জানিয়েছি, ঘটনা কী ঘটেছিল। এ ঘটনার মধ্যে কোনো সত্যতা তো নেই। যে জিনিস দিয়ে দিয়েছিলাম, সেটার জন্য আমাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, টাকা মেরে দিয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এ পর্যন্ত যত অভিযোগ এসেছে আমার ও সহকর্মীদের বিরুদ্ধে, তারা অভিশাপের একটা অংশ। এটা আমার কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। যে আমার বাবাকে আক্রমণ করেছে, ভাই-বোনদের আক্রমণ করেছে। এই যে সেটা অভিশপ্ত জীবনের একটা অংশ বলে গেলাম।’
নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বলেন, ‘এ সময় কেন তাদের অভিশপ্ত জীবন বহন করতে হচ্ছে সেটা আপনারা জানুন এবং লিখুন। শুধু জানা নয়, কিছু লিখুন। সত্যতা, গুরুত্বটা, ভূমিকাটা কী? রিপোর্টিং বলতে শুধু শুনলাম, লিখলাম এটা না। এর একটা ব্যাখ্যাও আছে। গভীরে যাওয়া, সবাইকে জানান দেওয়া সেটাও একটা অংশ।’