প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে এয়ারবেইস বানাতে দিলে কোনো নির্বাচনে জিততে সমস্যা নেই- এমন প্রস্তাব তাকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি রাজি হননি। প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার (২৩ মে) সন্ধ্যায় গণভবনে ১৪ দল নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের শুরুতে এসব কথা বলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাড়ে চার মাস পর জোটসঙ্গীদের সঙ্গে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করে আরও বলেন, ‘বে অব বেঙ্গলে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) ঘাঁটি বানাবে। ভারত মহাসাগরের এই শান্তিপূর্ণ জায়গাটার ওপর তাদের নজর। এখানে বেইস বানিয়ে তারা কোথায় হামলা করতে চায়? আমি এটা করতে দিচ্ছি না বলেই খারাপ।’ তিনি বলেন, ‘তবে জনগণ সঙ্গে রয়েছে, তারাই সামনে চলার মূল শক্তি।’
বাংলাদেশের গ্যাস না বিক্রির সিদ্ধান্তের বিষয়ে শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রকে ঈঙ্গিত করে বলেন, ‘গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় বসার মতো দৈন্যে ছিলাম না কখনো। শক্তিশালী (যুক্তরাষ্ট্র) দেশটি সেই সিদ্ধান্তকে (বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত) ভালোভাবে নেয়নি। আমি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, দেশের স্বার্থ বিক্রি করে ক্ষমতায় যাব না। পরে কিন্তু ক্ষমতায় আসতে পারিনি।’ তিনি বলেন, “চক্রান্ত এখনো চলমান রয়েছে। ফিলিস্তিনের মতো মায়ানমার ও বাংলাদেশের একটি অংশ চট্টগ্রাম নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো খ্রিষ্টান স্টেট বানাবে। তারা বে অব বেঙ্গলে (বঙ্গোপসাগরে) ঘাঁটি করতে চায়, কারণ বে অব বেঙ্গল ও ভারত মহাসাগরে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। আর এ জায়গাটাতেই কোনো ‘কন্ট্রোভার্সি’ নেই। কারও কোনো দ্বন্দ্ব নেই।”
সরকারের সমালোচকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলে দেশের উন্নয়ন হয়, তা গেল ১৫ বছরে প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও শুনতে হয় কথা বলার স্বাধীনতা নেই। কিন্তু সরকার কারও গলা টিপে ধরেনি। সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও টেলিভিশন করে দেওয়ার পরও বলছে, কথা বলতে পারি না। সরকারের বিরুদ্ধে ফেসবুকেও সমালোচনা, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। আমরাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এ ব্যাপারে সচেতন যে কীভাবে এ সমস্যার মোকাবিলা করা যায়।’
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুদ্রাস্ফীতি সব দেশের মতো বাংলাদেশেও হচ্ছে। একই কথা রিজার্ভের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রিজার্ভ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কেননা আপৎকালীন খাদ্য মজুত রয়েছে। এত বেশি আলোচনার (রিজার্ভসংকট নিয়ে সমালোচনা) কারণে আজ প্রায় সবাই রিজার্ভ নিয়ে কথা বলেন। এই সতর্কতা দেশের জন্য ভালো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজয় ও স্বাধীনতার চেতনা নস্যাৎ করতেই ২৫ আগস্টের ঘটনা ঘটানো হয়। তার পর থেকেই দেশটা শুধু পেছাতে থাকে। সরকার জনগণের জন্য কাজ করে, কেবল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই মানুষ এটা বুঝতে পারে।
সমবায়ের মাধ্যমে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ধান-মাছ চাষ হচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, ‘সেখানে ছয় বিঘা জমি দিয়েছি আমি। সুইজারল্যান্ডে যাচ্ছে এখন শরীয়তপুরের সবজি। ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্ত অতিক্রম করেই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।’
সব সময় সাধারণ-নির্যাতিতদের পাশে আছেন বলেও জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা কবে ফেরত যাবে জানি না। প্রতিদিন সেখানে নতুন নতুন শিশু জন্ম নিচ্ছে। অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। আলোচনা চালানো হচ্ছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মায়ানমারের পরিস্থিতি ভালো নয়। তাদের (রোহিঙ্গা) তো আর ঠেলে দিতে পারি না। আলাপ-আলোচনা করে যাচ্ছি। যুদ্ধ করতে যাইনি, ঝগড়াও করতে যাইনি। কখন যে তাদের ফেরাতে পারব, জানি না। আমরা তো রিফিউজি ছিলাম, তাদের কষ্ট বুঝি। তাদের ভাসানচরে নিচ্ছি। কিছু গেছে, আরও যাবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে বাধাগুলো আছে, সেগুলো অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছি। ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা চলছে। আমরা এর প্রতিবাদ করছি। যেখানেই যাই, এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলছি। ইরানের প্রেসিডেন্ট মারা যাওয়ার ঘটনায় আমরা শোক জানিয়েছি। শোক দিবসও পালন করেছি। যেখানেই মানুষ বিপদে পড়েছে, আমরা পাশে দাঁড়িয়েছি। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয় নীতিতে কাজ করছি।’
উৎপাদনে কোনো সংকট নেই দেশে, তবে মুদ্রাস্ফীতি কমানো চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন শেখ হাসিনা। ভবিষ্যতের করণীয় ঠিক করতে ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৪-দলীয় জোটের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা এসেছেন, ভালো হয়েছে। আমি খুশি হয়েছি। সবার কথা শুনব... কীভাবে কী করা যায়।’ তিনি বলেন, স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে আরও সুসংগঠিত হয়ে মানুষের কাছে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ছাড়া দেশের মানুষের কল্যাণ হবে না। গ্রেনেড হামলাকারী, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামি; ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ নিয়ে রোজই আন্দোলন, সরকার উৎখাতসহ নানা রকম হুমকি-ধমকি দেয়। যতক্ষণ জনগণ আছে সঙ্গে, ওটা আমি কেয়ার করি না। তারপরও দেশে জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসংযোগ, এগুলো যেন না করতে পারে। এগুলো যারা করবে, তাদের কোনো ছাড় নেই... যতই মুরব্বি ধরুক, আর যা-ই ধরুক। এদের আমরা ছাড়ব না। মানুষের ক্ষতি যারা করবে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।’
বৈঠকে ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, গণতন্ত্রী পার্টির (একাংশ) সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার, গণতন্ত্রী পার্টির (আরেক অংশের) সভাপতি ডা. শাহাদাৎ হোসেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের শুরুতে জোটের সমন্বয়কের নেতৃত্বে ফুল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানানো হয়।