‘পীর’ এটি ফারসি শব্দ। অভিধানে যার অর্থে লেখা হয়েছে—মুসলমান সাধুপুরুষ, পুণ্যাত্মা। মানে যিনি দুনিয়াত্যাগী পুরুষ। আল্লাহভীতি আছে যার মনে। ইবাদত-বন্দেগিতে মত্ত এমন মহান ব্যক্তি। ‘শায়েখ’ আরবি শব্দ। যার বহুবচন মাশায়েখ এবং ‘বুজুর্গ’- এ দুটোর অর্থও সম্মানিত ব্যক্তি, ধর্মীয় পণ্ডিত ও বয়োবৃদ্ধ মানুষকেই বোঝায়। যিনি বয়সে বা ইলম-জ্ঞানের দিক থেকে বড়ো ও শ্রদ্ধাভাজন।
সাধারণত আরব জাহান এবং ইরান-ইরাক প্রভৃতি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষাসম্পন্ন করা একদল নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিগণই হলেন পীর-মাশায়েখ। যেমন—শাহ জালাল ইয়ামেনি (রহ.)। যিনি সুদূর ইয়ামেনের অধিবাসী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে জন্মস্থান ত্যাগ করেন। বাংলাদেশের সিলেটে আমৃত্যু ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। ঠিক এভাবেই যারা ইসলাম, ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির দাওয়াত নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে; ছুটে গিয়েছেন শহরে নগরে হাটে বাজারে গ্রামে বন্দরে। তাদের হাত ধরেই অসংখ্য মানুষ ইসলামের ছায়াতলে এসেছে। ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছে। ইসলাম ধর্ম শিখেছে। আর পীর-মাশায়েখরাই পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন। ইতিহাস ও ঐতিহ্য তাই বলে। ঐতিহাসিকরা এমন ইতিহাসই রচনা করেছেন। তবে তৎকালীন সময়ের আধ্যাত্মিক ধর্মীয় নেতা বা পীর-বুজুর্গরা ছিলেন সত্যিকারার্থে আল্লাহভীতির গুণে গুণান্বিত। আপাদমস্তক ইসলামের আলোয় উজ্জীবিত। তাদের আমল আখলাক প্রভৃতি ছিল সুন্নতের নমুনায় উদ্ভাসিত।
এর বাইরে অতীতে এবং বর্তমানেও কতক নামধারী ভণ্ড প্রতারক পীর বা আলেম রয়েছেন, যারা ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও আদর্শ লালন না করলেও ইসলামের অপব্যাখ্যায় তারা সিদ্ধহস্ত। কাজেই এমন দু-চারজন ভণ্ড প্রতারক দেখে বাকি সব বুজুর্গ সম্পর্কে মন্দ ধারণা করা কিছুতেই সঠিক ও সমীচীন হতে পারে না। এ জন্য চুন খেয়ে জিহ্বা পুড়ে গেলে দইয়ের প্রতি ভয়ের কারণ নেই। তেমনি ভণ্ড প্রতারক পীর দেখে সত্যিকার পীর-বুজুর্গ আলেম থেকে দূরে সরে যাওয়ার কোনো অর্থ হতে পারে না। মূলকথা হলো, পীর মানে ধর্মীয় নেতৃত্বদানে সক্ষম এমন নেতৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তি। আর আরবিতে যা হুবহু শায়েখ শব্দেই ব্যক্ত করা যায়। কিংবা বলা যায়, ধর্মীয় মুরব্বি। অনুসরণীয় নেতা। অভিভাবক অর্থেও হতে পারে। অনুরূপ মাওলানার বেলায়ও একই কথা। যার অর্থ হলো, আমাদের বন্ধু বা অভিভাবক। আর অভিভাবক মাত্রই নেতৃত্ব দিতে সক্ষম- এমন কাউকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করা উদ্দেশ্য। তবে তার মধ্যে সত্যিকার অর্থে ধর্মীয় শিক্ষা ও আদর্শ থাকা জরুরি। নয় তো তিনিই হতে পারেন ঈমান আমল ধ্বংসের কারিগর।
বাস্তবিক অর্থে অতীতে যারাই ধর্মীয় বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন—এমন আলেমই হলেন, পীর ও শায়েখ, মাশায়েখ। আর যারাই ধর্মীয় নেতা হবেন, ইসলামের নেতৃত্ব দেবেন, তারাই মূলত দেশ ও এলাকাভেদে এই পীর মাওলানা শায়েখ জাতীয় লকবগুলো বহন করে থাকেন। কেউ একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ করে, তালিম-তারবিয়ত হাসিল করে। কেউবা এমনিতেই। আবার কেউ কেউ কারও অতিভক্তি, অজ্ঞতা, ভুলভাল প্রচারণার শিকার হয়ে বয়ান বক্তৃতা; কিংবা জনসমাগমে প্রভাবিত হয়ে এই কাজটি করেন। ভক্তরাও তা অন্ধবিশ্বাসে গেলেন। তাই তারা, বলেন- লেখেন ও দাবি করেন- পীর মাওলানা ও শায়েখ। অনেকে বাপ-দাদার বংশের ধারায় নিজেকে পীরজাদা পরিচয় দেন। নামের শুরুতে পীর যুক্ত করেন। এমন লোকজন থেকেও সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি।
আর আজকাল তো ‘পীর’ শব্দটি অনেকটাই পৈতৃক হয়ে গেছে। বাবা পীর ছিলেন। ব্যস, ছেলেও পীর। তবে হক্কানি পীর এক জিনিস। আর ভণ্ড প্রতারক ধর্মব্যবসায়ী পীর আরেক জিনিস। একাডেমিক শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক সোহবত সান্নিধ্য ছাড়া যারা পীর, তারা কোন্ স্তরের পীর? কেমন পীর? যা-ই হোক, সেই ধারাবাহিকতায় দাড়ি টুপি লেবাস সুরত দেখেই কোনো ইউটিউবারও যদি কাউকে পীর-মাওলানা শায়েখ দাবি করে, রীতিমতো প্রচার করতে শুরু করে- তাতে আপাতত অবাক হওয়ার কিছু নাই!
এ জন্য পীর মাওলানা শায়েখ ইত্যাদি ধর্মীয় পরিভাষার সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। সঠিকভাবে এগুলোর প্রয়োগ তথা ব্যবহার করতে হবে। হুট করে কাউকে পীর মানা যাবে না। যদি তিনি কোরআন-হাদিসের সঠিক অনুসরণ না করেন, তবে এমন পীর বুজুর্গ শায়েখ ইত্যাদি পরিহারযোগ্য। এদেরকে পরিহার করে হক্কানি আলেমদের অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের এ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষাগুলো বুঝেশুনে, সঠিকভাবে এগুলোর মর্ম বোঝার তাওফিক দান করুন। প্রতারক পীর শায়েখ ইত্যাদি ধর্মীয় পরিভাষা ব্যবহারকারী চক্র থেকে আমাদের দ্বীন ঈমান আমল রক্ষা করার তাওফিক দান করুন।
লেখক: খতিব, ভবানীপুর মাইজপাড়া হক্কানি জামে মসজিদ, গাজীপুর