ঢাকা ৪ ফাল্গুন ১৪৩১, সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৪ ফাল্গুন ১৪৩১

দলেও অপাঙ‌্ক্তেয় ওবায়দুল কাদের

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৭ পিএম
আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:১৮ এএম
দলেও অপাঙ‌্ক্তেয় ওবায়দুল কাদের
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

পালাব কেন? কোথাও যাব না। প্রয়োজনে মির্জা ফখরুল সাহেবের বাসায় উঠব। কী; জায়গা দেবেন তো? ঠিক এ ধরনের বক্তব্যের কারণে বছরজুড়ে আলোচনায় থেকেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পেছনে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বেফাঁস ও লাগামহীন বক্তব্য। একই সঙ্গে তিনি এবং তার সহযোগীদের দুর্নীতিও ছিল অন্যতম কারণ। কাদেরের এসব বক্তব্যে এবং তার গত আট বছরের (সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে) কার্যক্রমের কারণে দলে তার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়ে। অনেকের মতে, সরকার পতনের আগেই দলে ওবায়দুল কাদের প্রায় অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়েন। সরকার পতনের পর দলে এখন আর তিনি প্রায়োজনীয় নন, এক রকম অনাবশ্যক হয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই নেতা। 

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের প্রাচীনতম এ দলটির সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরের মতো হাস্যকর ও সমালোচিত নেতা আর আসেননি। প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক থেকে ওবায়দুল কাদের পর্যন্ত অনেক নেতাই বিতর্কে জড়িয়েছেন। তবে হাস্যকর কর্মকাণ্ডের জন্য ওবায়দুল কাদের বেশি আলোচিত ও সমালোচিত।

টানা তিনবার সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন কাদের। দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে খুশি করে চলায় কাদেরের শীর্ষ পদ যায়নি। ফলে সাধারণ সম্পাদক পদে আওয়ামী লীগে দীর্ঘদিন নতুন মুখ আসেনি। আসেনি সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ও ক্যারিশম্যাটিক কোনো নেতা। কিন্তু যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারেনি ওবায়দুল কাদেরের একঘেয়েমি রাজনীতি। তারই মূল্য দিতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মধ্য দিয়ে। 

সরকার পতনের পর দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বড় অংশে আলোচনা রয়েছে- ওবায়দুল কাদের এখন দলের জন্য অনিবার্য তো নয়ই, বরং বোঝা। তার জন্য দল ধীরে ধীরে ডুবছে। ওবায়দুল কাদের দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য সারা দিন ব্যস্ত থাকতেন। গত ১৫ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত যেসব শিক্ষার্থী নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান তুলেছেন, তাদের মোকাবিলায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগই যথেষ্ট বলে মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের।

দলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশ মনে করেন, দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে থেকে কাদেরের এমন বক্তব্য দলের জন্য সাংঘাতিক ক্ষতি বয়ে এনেছে। যে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সময় পায়নি আওয়ামী লীগ।

সে সময় দলের অভ্যন্তরীণ সভায় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের কারণে ছাত্রলীগকে বিতর্কের মধ্যে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রেও ওবায়দুল কাদেরের ওই বক্তব্যকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। গত ২৯ জুলাই ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে কাদেরের ওই বক্তব্যের কড়া সমালোচনা হয়। যদিও নিজের বক্তব্যের পক্ষে সাফাই গেয়ে কাদের বলেছেন, তার বক্তব্যকে মিডিয়ায় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

২০১৬ সালে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের স্থলাভিষিক্ত হন ওবায়দুল কাদের। সে সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরকে অনেক নেতাই মেনে নিতে পারেননি। সেই থেকে এখনো পদটি আঁকড়ে ধরে রেখেছেন তিনি। একই সঙ্গে সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেছেন ওবায়দুল কাদের। একাধিক পদের দায়িত্বে থাকায় দলে এবং মন্ত্রণালয়ের কোনোটিতেই যথাযথ সময় দিতে পারতেন না ওবায়দুল কাদের। ফলে মন্ত্রণালয় ও দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে পড়েন প্রভাবশালী এই নেতা। এর সঙ্গে শারীরিক অসুস্থতার জন্য প্রতি মাসে দেশের বাইরে যেতে হতো কাদেরকে। তিনি দলের দায়িত্বে আসার পর থেকে আওয়ামী লীগে ‘কাউয়া ও হাইব্রিড’ শব্দগুলো চালু হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ওবায়দুল কাদের যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়নের কথা বলতেন ঠিকই, তবে নিজেই কাউয়া ও হাইব্রিড নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। তার আমলে অনুপ্রবেশকারীদের আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ারও নজির রয়েছে। 

ওবায়দুল কাদের সাবেক ছাত্রনেতা থেকে বর্তমানে মূল দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। অথচ তার আমলেই দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাবেক তুখোড় ছাত্রনেতাদের কদর কমে যায়। গত আট বছরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাবেক তুখোড় ছাত্রনেতাদের (সভাপতি-সম্পাদক) উল্লেখযোগ্যভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, সাবেক ছাত্রনেতারা দলীয় কার্যালয়ে এলে তাদের নানাভাবে অপমান করা হতো। মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রেও একই কাজ করেছেন ওবায়দুল কাদের। এ নিয়ে একাধিকবার দলের মধ্যে সমালোচনা হয়। অনেকেই অভিমানে কার্যালয়ে যাতায়াত কমিয়ে দেন, না হয় বন্ধ করে দেন। অনেক নেতার রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ারও নজির রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বাকি ৮০ নেতার মধ্যে একধরনের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। আড়ালে একে অন্যের নামে বিষোদ্গার করতেন। কাদের নিজেও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বহু নেতাকে প্রকাশ্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। ক্ষিপ্ত হয়ে অনেক নেতা আবার ওবায়দুল কাদেরকে গালমন্দও করেছেন। 

দলের সাধারণ সম্পাদক ও দুটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রায় সময় এক থেকে দুই হাজার ছবি একযোগে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে শেয়ার করতেন। দলীয় নেতারা তার ছবির নিচে মন্তব্য করতেন- ‘ভাই এত হাজার হাজার ছবি তুলতে যে সময় লাগে তা যদি দলের জন্য ব্যয় করতেন; তাহলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির এত খারাপ পরিণতি হয় না!’

একাধিক দায়িত্বে থাকার কারণে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ সম্মেলন ডাকতেন ওবায়দুল কাদের। আর এসব সম্মেলনে অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখতেন তিনি। দলীয় সভা-সমাবেশে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও দলের নেতাদের নিয়ে হাস্যরসাত্মক বক্তব্য দিতেন, যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতো। 

যেমন- ‘খেলা হবে। আপনারা খেলার জন্য প্রস্তুত?’; ‘জ্বালা হায়রে জ্বালা, অন্তরে জ্বালা’; ‘ভালো হয়ে যাও মাসুদ, ভালো হয়ে যাও’; ‘ওরা কারা-কোথা থেকে এল’; ‘পালাব না, কোথায় পালাব? পালাব না, প্রয়োজনে ফখরুল সাহেবের বাসায় গিয়ে উঠব। কী জায়গা দেবেন তো? না হলে ঠাকুরগাঁওয়ের যে বাড়ি আছে না, ওই বাড়িতে গিয়ে উঠব।’ (সরকার পতনের পর মির্জা ফখরুলও এই বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন); ‘একটুও বলব না, একটা শব্দও বলব না। কেন দশটা মিনিটও সহ্য হয় না?’; ‘২৮ থেকে ৪ তারিখ কতদিন হলো? ২৮ তারিখের পর তো শেখ হাসিনা নেই, হায়রে মির্জা ফখরুল! হায়রে হায়! টেলিভিশনে দেখলাম খালি দৌড়াচ্ছে’; ‘মঞ্চে সব নেতা। পুরা নেতা, আধুলি নেতা, সিকি নেতা, পাতি নেতা। নেতায় নেতায় স্টেজ ভাঙে’ ইত্যাদি। 

সংবাদ সম্মেলনে দলের অথবা মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট প্রশ্নে, যা তার বিপক্ষে গেলেই ক্ষেপে যেতেন ওবায়দুল কাদের। উত্তর না দিয়ে নিজেই সাংবাদিককে পাল্টা প্রশ্ন করে বসতেন কাদের। তা নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। 

দলীয় সূত্র বলছে, সাধারণ সম্পাদক পদে থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদেরও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাবেক ছাত্রনেতা ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের প্রকাশ্যে অপমান করার নজিরও রয়েছে। তা নিয়ে আবার আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের হাতিহাতি হয়। দেশের বিভিন্ন জেলা, এমনকি নিজের উপজেলার নেতারা দেখা করতে এলে তাদের প্রকাশ্যে গালমন্দ করেছেন তিনি। বিশেষ করে তৃণমূলের নেতারা দলীয় দপ্তরে কোনো অভিযোগের কাগজ জমা দিতে এলে ওই নেতাদের মুখে তা ছুড়ে মারার নজিরও রয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় তৃণমূলের নেতারা ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তার প্রটোকল বাহিনীর সদস্যরা নানাভাবে হেনস্তা করতেন। এই নিয়ে কার্যালয় থেকে বের হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে অনেক নেতাই বলেছেন- সৈয়দ আশরাফের (সাবেক সাধারণ সম্পাদক) আমলে আওয়ামী লীগ ভালো ছিল। ওবায়দুল কাদের দলের জন্য ক্ষতিকর। 

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে ওবায়দুল কাদেরের অযোগ্যতাই বেশি দায়ী। প্রতিনিয়ত ব্যক্তিত্বহীন আচরণ ও অদূরদর্শী বক্তব্য দিয়ে তিনি নিজেকে বিতর্কিত করেছেন। এমনকি বিতর্কিত করেছেন ঐতিহ্যবাহী দলের সাধারণ সম্পাদক পদটিকেও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র-জনতার আন্দোলন মোকাবিলা করা ছিল ওবায়দুল কাদেরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ঢাকা মহানগর থেকে শুরু করে সারা দেশে আওয়ামী লীগকে দ্বিধা-বিভক্ত করেছেন ওবায়দুল কাদের। তার আমলেই জেলা এবং উপজেলার চেয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের অবস্থা বেহাল হয়ে পড়ে। মহানগর উত্তর-দক্ষিণের থানা এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও দলের সহযোগী সংগঠনের কোনো কমিটি নেই। এমন বাস্তবতায় মহানগর আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তাকে বলা হয়। নেতা-কর্মীদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করলে দলের মধ্যে বিরোধ আরও বাড়ে। তার সামনেই পক্ষে-বিপক্ষে তর্কাতর্কি করেন নেতা-কর্মীরা। এক নেতা আরেক নেতাকে মারতে যান। এসব সামাল দিতে না পারায় একপর্যায়ে ওবায়দুল কাদেরকেও তোপের মুখে পড়তে হয়। কাদেরের দুর্বলতা নিয়েও নেতা-কর্মীরা বলতে থাকেন। যার ফলে ছাত্র-জনতার আন্দোলন মোকাবিলায় উল্লেখ্যযোগ্যভাবে সাড়া মেলেনি নেতা-কর্মীদের।

টানা তিনবার দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকলেও ওবায়দুল কাদের তৃণমূলে বরাবরই বিতর্কিত ভূমিকায় ছিলেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ মতবিনিময় সভা এবং বিভাগীয় বর্ধিত সভা ঢেকে কাউকে কথা বলতে দিতেন না। কেউ সাংগঠনিক বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও তাকে অপমান করে মুখ বন্ধ করে দিতেন। এই নিয়ে সাবেক ছাত্রনেতা ও মহানগরের নেতারা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ জানিয়ে আসছিলেন। 

সরকার পতনের আগে গত ৩১ জুলাই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন মোকাবিলা করতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ। সভায় ওবায়দুল কাদের সাবেক ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন বলে দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে এক দিন আগে জানানো হয়। কিন্তু বরাবরের মতো ওই সভায়ও ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে মতবিনিময় সভা মুলতবির ঘোষণা দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সাবেক ছাত্রনেতারা তাকে ঘিরে ভুয়া ভুয়া স্লোগান দিতে থাকেন। তাদের থামাতে চাইলে ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ করে নেতারা বলতে থাকেন, ‘মতবিনিময় সভা ডেকে সংবাদ সম্মেলন করছেন কেন? তাহলে আমাদের ডাকলেন কেন? আগে আমাদের কথা শুনবেন, আলোচনা করবেন, তারপর ব্রিফ করেন। তা না করে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলা শুরু করে দিলেন!’ 

সভা শেষে বের হতে চাইলে তাকে ঘিরে ফেলেন সাবেক ছাত্রনেতারা। পরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সাহায্যে কার্যালয় থেকে বের হতে পারেন। 

৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দীর্ঘদিন যারা ওবায়দুল কাদেরকে তোষামোদ করে সুবিধা নিয়েছেন, তারাও কাদেরের দুঃসময়ে কাছে নেই। দলের কোনো সিদ্ধান্তে ওবায়দুল কাদেরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সর্বশেষ নানা কায়দা করে স্ত্রীসহ কলকাতায় পৌঁছান তিনি। তবে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা হয়েও কেউ কাদেরের খোঁজ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ জানান কাদের। তবে তার ডাকে সাড়া দেননি শেখ হাসিনা।

রাজনীতির ‘মিথ’ বদলের বছর

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪২ এএম
আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৫৪ পিএম
রাজনীতির ‘মিথ’ বদলের বছর

একটানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পাশাপাশি প্রায় সব বিরোধী দল ও মতকে কোণঠাসা করতে পেরেছিলেন শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, পরপর প্রশ্নবিদ্ধ তিনটি নির্বাচন করেও তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিলেন। এর ফলে জনমনে এমন একটি ধারণা বা ‘মিথ’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল যে, শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে কিছুতেই ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না। ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণই যে নিয়ামক শক্তি, এ কথা দেশের মানুষ প্রায় অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। জনগণের পাশাপাশি এক যুগ ধরে আন্দোলন ও মামলা-হামলার মুখে থাকা বিএনপির একাংশের মধ্যেও এমন ধারণা বা বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছিল। কারণ একবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে এবং দুবার নির্বাচন বর্জনের পরেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পাওয়ায় কিছুটা হতাশা তৈরি হয়েছিল দলটির মধ্যে। 

ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মিসিসিপির সাবেক গবেষণা সহযোগী ক্রিস্টোফার জে. ফ্লাড তার ‘পলিটিক্যাল মিথ: আ থিওরিটিক্যাল ইন্ট্রোডাকশন’ বইতে রাজনৈতিক মিথকে এমন একটি ধারণা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যা রাজনৈতিক জীবন ও সামাজিক বাস্তবতার ব্যাখ্যা ও গঠন করতে ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মিথ হলো এমন গল্প, প্রতীক বা বিশ্বাসের সমষ্টি, যা একটি গোষ্ঠী বা সমাজের মধ্যে একটি বিশেষ আদর্শ বা ন্যারেটিভকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং সেই ন্যারেটিভের ভিত্তিতে রাজনৈতিক আচরণ ও নীতিমালা প্রভাবিত হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হওয়ার পরে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনই ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে হয়েছে বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে আর কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে বিশ্বাস করতেন না দেশের জনগণ। ফলে ‘বিএনপি শেষ, দলটির আর ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা কম’ কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করেছেন। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ বেশ কয়েকজন নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর এবং নিবন্ধন বাতিলের ফলে দলটির অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। বেশ কয়েক দফা ভাঙন, সরকারের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ, মামলা ও গ্রেপ্তার; সর্বোপরি সরকারের কূটকৌশলের কারণে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল হেফাজতে ইসলামীও। কিন্তু ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সব ‘ধারণা’ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। পতন হয় মহাক্ষমতাধর শেখ হাসিনা সরকারের। তিনি পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।

বস্তুত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও সাড়ে ১৫ বছরে দেশের রাজনীতি ও ক্ষমতার বলয় তৈরি হয়েছিল শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে। দৃশ্যত তার শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় এবং ক্রমাগতভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারায় তাকে সরাতে পারবে না এমন বিশ্বাস বা মিথ তৈরি হয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার প্রভাব ছাড়াও দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থক বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর প্রচারণাও এই মিথ তৈরিতে সহায়তা করেছে বলে মনে করা হয়।

রাজনৈতিক মিথ নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় বলে ক্রিস্টোফার জে ফ্লাড তার ওই একই বইতে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক মিথ প্রায়ই এমন এক ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, যিনি জনগণের কাছে অসাধারণ ও অতিমানবীয় গুণাবলীর অধিকারী হিসেবে উপস্থাপিত হন। এই ব্যক্তি-চরিত্রটি অনেক সময় ‘কাল্ট অব পারসোনালিটি’ সৃষ্টি করে।” 

শেখ হাসিনার পতন-পরবর্তী বাংলাদেশের এখনকার রাজনীতি কারও কল্পনার মধ্যেও ছিল না। অথচ সেই ঘটনাই ঘটেছে ২০২৪ সালে। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরের মধ্যেও দেশের রাজনীতি এরকম আর কখনো ওলটপালট হয়নি; বা উল্টে যায়নি। এ বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাড়ে ১৫ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকা শক্তিশালী আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা থেকে ছিটকেই পড়েনি; দলটির রাজনীতিও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। অন্যদিকে দীর্ঘসময় ক্ষমতার বাইরে থেকে অত্যন্ত কোণঠাসা অবস্থায় থাকলেও ওই এক দিনের ঘটনায় বিএনপির রাজনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অনেকের মতে, ক্ষমতায় এখন পর্যন্ত না গেলেও দেশের রাজনীততে বিএনপিই এখন সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর।

একইভাবে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের ঘটনায় সমান্তরালে রাজনীতিতে লাভবান হয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ বিএনপির রাজনৈতিক মিত্ররাও। কারণ দলগুলো এখন স্বস্তির মধ্যে রাজনীতি করছে, নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও দলটির মিত্র দলগুলোর নেতারা হয় কারাগারে নয়তো আত্মগোপনে রয়েছেন। দলটির নির্বাচনে অংশগ্রহণও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ‘আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার কখনো পতন হবে না’ রাজনৈতিক এই ‘বিশ্বাস বা ধারণা’র কারণেই দলটির অনেক ডাকসাইটে নেতা এবং প্রভাবশালী সমর্থক আগেভাগে দেশ ছেড়ে পালাতে পারেননি। তাদের বেশির ভাগই বিশ্বাস করতেন, শেখ হাসিনাকে কেউ ফেলতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন। এমন ধারণা তৈরি হওয়ার কারণ হলো; ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার সরকার পতনের আন্দোলন সহিংস ও বেগবান হলেও শেষ পর্যন্ত সরকার তা সামাল দিতে সমর্থ হয়। সরকার টিকে যায়।

সর্বশেষ গত ২২ জুলাই আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময় ‘শেখ হাসিনা পালায়নি, শেখ হাসিনা পালায় না’ এমন বক্তব্যের পর দুশ্চিন্তায় থাকা আওয়ামী লীগের মধ্যে আবারও স্বস্তি ফিরে আসে। জনগণের মধ্যেও তখন আলোচনা ওঠে, সরকার পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠছে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যুক্ত হওয়ায় ৫ আগস্ট সকালে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর মানুষ গণভবন দখল করে নেয়। 

ওই দিনের পর আওয়ামী লীগের একাংশ নানাপথে নানাভাবে পালিয়ে যান। আবার অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে আছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থাকবে’ এমন বদ্ধমূল ধারণা থেকেই দুর্নীতি দেশের তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। সীমাহীন দলীয়করণ হয়েছে পুলিশ ও প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের প্রায় সর্বস্তরে। জনগণের প্রতি আস্থা এবং ভোটের রাজনীতির বদলে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত কার পক্ষে এমন আলোচনাই বড় হয়ে উঠেছিল। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য জনগণের কাছে যাওয়ার আর কোনো তাগিদ আওয়ামী লীগ নেতারা অনুভব করেননি। তাদের মনোভাব ছিল, পরিস্থিতি যাই হোক, ‘ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা একটা উপায় বের করবেনই।’

এবং সত্যি সত্যি তিনি উপায় বের করেছিলেনও। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা হলো, শেখ হাসিনা পরপর তিনবার প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে দলকে ক্ষমতায় নিয়ে গেছেন। একইভাবে বিরোধী দল ও মতকে তিনি দমিয়ে রাখতেও সক্ষম হয়েছেন। এর ফলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টিও তাদের আর মাথায় ছিল না। কারণ ‘শেখ হাসিনাই থাকবেন’ এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও নিরপেক্ষ থাকার আর কোনো ঝুঁকি নেননি। তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছেন। নির্বাচন কমিশনও এই ধারার বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি নেয়নি। এভাবেই সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরের নির্বাচন নিয়ে দলটির নেতা-কর্মীদের আর মাথা ঘামাতে হয়নি। সরকার, প্রশাসন ও আওয়ামী লীগ সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল । এভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে তারা একতরফা ভাবে জয়লাভ করেছে। কেন্দ্র থেকে দেশের তৃণমূল পর্যন্ত এভাবে আওয়ামী লীগের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকারের দুর্নামও এভাবেই জনমনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। 

সুইডেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আইডিইএর (দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিসট্যান্স) প্রতিবেদনে এ কারণেই কর্তৃত্ববাদী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। ‘দ্য গ্লোবাল স্টেট অব ডেমোক্রেসি’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে ২০২২ সালের বৈশ্বিক গণতন্ত্র পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। 

ক্রিস্টোফার জে ফ্লাডের মতে, রাজনৈতিক মিথ সমাজে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি জনগণের আচরণকে প্রভাবিত করে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং কখনো কখনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেরণাও জোগায়। 

বাংলাদেশেও সরকারের পরিবর্তন তথা সেই পতন এতটাই আকস্মিক ছিল যে, শেখ হাসিনা কয়েক ঘণ্টা আগেও বুঝতে পারেননি দেশ ছেড়ে তাকে পালাতে হবে। ফলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের তাৎক্ষণিকভাবে আত্মগোপনে যেতে হয়েছে এবং দলটির রাজনীতিও আকস্মিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।

বছরের সেরা ঘটনা ছাত্র আন্দোলন

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২১ এএম
আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৩ এএম
বছরের সেরা ঘটনা ছাত্র আন্দোলন
ফাইল ছবি

এ বছরের জুলাইতে বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস বিনির্মাণ করেছেন আলোকিত ছাত্রনেতৃত্ব- ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তা পরিচিতি পেয়েছে বিশ্বব্যাপী। বছরের সেরা ঘটনা এটাই- ‘ছাত্র আন্দোলন’। ছাত্রদের আন্দোলনের সূত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সংস্কৃতি ও শাসনব্যবস্থায় মৌলিক গুণগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। তিনি বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।

সূচনা

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। আন্দোলন গতিশীল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বড় অংশ এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। শুরুতে যারা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, নানা সময়ে গণমাধ্যমে যাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা গেছে, তারাই পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছেন এই আন্দোলনের মুখ ও মুখপাত্র। ‘সমন্বয়ক’ হিসেবে তারা নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। এই সমন্বয়কদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম, ইংরেজি বিভাগের হাসনাত আবদুল্লাহ, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সারজিস আলম, ভূগোল বিভাগের আবু বাকের মজুমদার প্রমুখ। এরা সবাই ছাত্র কিংবা সদ্য ছাত্রত্ব ছেড়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের মহানায়ক। তবে এককভাবে নয়, সম্মিলিতভাবে, সম্মিলিত নেতৃত্বের মাধ্যমে। বাংলাদেশে এর আগে এমনটি ঘটেনি। নিজেদের সাফল্য সম্পর্কে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘মানুষ মুক্তি খুঁজছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই মুক্তি ঘটেছে।’ 

আন্দোলনের গতিমুখ ও সাফল্য
বাংলাদেশে ছাত্র-আন্দোলনের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। ছাত্র-আন্দোলনের কারণেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। ২০২৪-এর জুলাইতে আরও একবার ছাত্র আন্দোলনের অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে বাংলাদেশ বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্ন দেখছে। এবারের গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতৃত্ব বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদমুক্ত বহুত্ববাদী অংশগ্রহণমূলক বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন। এসবই হচ্ছে তাদের রাষ্ট্রদর্শন। ১৯৭১ সালে যে রাষ্ট্রদর্শনের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই ‘ন্যারেটিভ’কেও তারা সংশোধন করে নতুন ‘ন্যারেটিভ’ সামনে নিয়ে এসেছেন। গত সাড়ে ১৫ বছরে স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রীয় যে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা হয়েছে, তারা তার সংস্কারের কথা বলছেন। লক্ষ্য, বাংলাদেশ যাতে আর কখনো স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে না ওঠে। কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব যেন আর না ঘটে। সার্বিকভাবে দেশে যেন একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

যেভাবে নায়ক হয়ে উঠেছেন তারা
সব মিলিয়ে মাত্র এক মাসের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছেন তারা। জুলাইয়ের ২ তারিখ থেকে ৪ দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি দেন। ৬ জুলাই পর্যন্ত তারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করেন। জুলাইয়ের ৭ তারিখে পালন করা হয় গণপরিবহন বন্ধ ও রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি। এরপর আসে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। বাংলা ব্লকেডের সময় রাজধানীর মেট্রোরেল ছাড়া অন্য সব পরিবহন বন্ধ ছিল। লাগাতার এসব কর্মসূচি পালনের সময় শিক্ষার্থীরা পুলিশি হামলার শিকার হন। ১৪ জুলাই গণপদযাত্রার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি দেন। ওই দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে উল্লেখ করলে শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করেন এবং নানা স্লোগান দেন। এরই প্রেক্ষাপটে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গত রাতে (১৪ জুলাই) বিক্ষোভ করে আমরা সোমবার (১৫ জুলাই) রাত ১২টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে তার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলাম। প্রত্যাহার না হওয়ায় আমরা রাস্তায় নেমেছি।’ এই বক্তব্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে নাহিদ ইসলাম আন্দোলনের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। এই ঘটনায় আন্দোলন গতি পায়। আবু সাঈদের মৃত্যু আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে। ঊনসত্তরের আসাদের মৃত্যু, মুক্তিযুদ্ধে ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যু, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেনের মৃত্যু ও ড. মিলনের মৃত্যু যেভাবে আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল, এবারের গণ-অভ্যুত্থানে আবু সাঈদের মৃত্যু ছাত্র আন্দোলনকে তার চেয়েও অনেক বেশি বেগবান করে।

১৮ জুলাই পালিত হয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি। ১৯ জুলাই মধ্যরাতে নাহিদ ইসলাম আটক হন। পাশাপাশি অন্য তিন সমন্বয়কের সঙ্গে চলছিল সরকারের তিনজন প্রতিনিধির বৈঠক। সেই বৈঠকে অংশ নেন সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ এবং সহ-সমন্বয়ক তানভীর আহমেদ। বৈঠকে তারা ৮ দফা দাবি জানান। ২১ জুলাই জানানো হয় ৯ দফা দাবি। পরে ২২ জুলাই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মুখ হয়ে ওঠা নাহিদ ইসলাম ৪ দফা দাবি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত করেন।

আন্দোলনের এই পর্যায়ে সরকারের নানা তৎপরতার ফলে কিছুটা সমন্বয়হীনতা দেখা দিলেও ২৪ জুলাই থেকে আবার আন্দোলনের গতি সঞ্চারিত হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিখোঁজ তিন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদ প্রকাশ্যে আসেন। তারা নতুন করে ৮টি বার্তা দেন। ২৬ জুলাই গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল থেকে নাহিদ ও অন্য দুই সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে সরকারি গোয়েন্দারা তুলে নিয়ে যায়। পরদিন আরও দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে হেফাজতে নেয় গোয়েন্দারা। সমন্বয়করা এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আটক সব শিক্ষার্থীর মুক্তি দাবি করেন এবং সারা দেশের দেয়ালগুলোতে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনের কর্মসূচি দেন। পুলিশের চাপে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে অন্য সমন্বয়কারীরা জানান এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ৩১ জুলাই তারা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করেন। ১ আগস্ট গোয়েন্দা হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই সমন্বয়কারীরা হচ্ছেন নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, আবু বাকের মজুমদার, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুম।

৩ আগস্ট ডাক দেওয়া হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আয়োজিত বিশাল সমাবেশ থেকে এই অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা তুলে ধরা হয়। শহিদ মিনার থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পদত্যাগের ১ দফা ঘোষণা করেন। এ সময় শহিদ মিনারে অন্য কেন্দ্রীয় সমন্বয়করাও উপস্থিত ছিলেন। ৬ আগস্ট ঘোষণা করা হয় ‘লং মার্চ টু ঢাকা’। তবে সেই কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে আনা হয়। ৫ আগস্ট আন্দোলন দমনের নামে ১০৮ জন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ নাগরিককে হত্যা করা হয়। এর আগের টানা কয়েক দিনও বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় শত শত নিরীহ মানুষের মৃত্যুর খবর। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবল আন্দোলনের মুখে সরকারি বাসভবন গণভবন ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। এভাবে অবসান ঘটে সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনের। আর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সমন্বয়করা গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক হয়ে উঠেছেন।

দেশ-শাসনে সমন্বয়ক
শুধু আন্দোলন নয়, দেশ-শাসনেও সমন্বয়করা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ৮ আগস্ট তাদেরই আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আন্দোলনের নেপথ্যে থাকা আরেক সমন্বয়ক মাহফুজ আলমও উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করার ফলে তাদের গুরুত্ব এখন অপরিসীম। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে, কী দাঁড়াবে, কোন পথে অগ্রসর হবে, রাষ্ট্রনীতি কী হবে- এই মুহূর্তে তারা সেই ভূমিকা পালন করছেন। সংস্কারের পর নির্বাচনের কথাও তাদের মুখ থেকে শোনা গেছে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে এক নতুন রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায়। জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররাই হয়ে উঠেছেন বছরের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য চরিত্র। তাদের হাতেই হয়তো বিনির্মাণ ঘটবে বৈষম্যহীন সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের।

বিজয়টা উদযাপন করতে পারেনি শিশু জাবির

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫ এএম
বিজয়টা উদযাপন করতে পারেনি শিশু জাবির
জাবির ইব্রাহিমের বিপ্লবী ভঙ্গিমা এখন শুধুই স্মৃতি। ছবি: খবরেরে কাগজ

জাবির ইব্রাহিমের বয়স সবে ছয় পেরিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তার খুব বেশি বোঝার কথা নয়। তবে টেলিভিশন দেখে এবং বড় বোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবাইনা কবির নেহার কাছ থেকে জেনে সে আফসোস করত। শিশুসহ অন্যদের মেরে ফেলার বিষয়টি তাকে খুবই পীড়া দিত।

জানা যায়, গত ৫ আগস্ট সকালে মাথায় একটি হেলমেট পরে বাবার কাছে আসে শিশু জাবির ইব্রাহিম। এরপর বাবাকে বলে, ‘আমি আর্মি অফিসার হব।’ বাবা প্রশ্ন করেন, ‘কেন’? জাবির বলে, ‘আমি আর্মি হয়ে পুলিশকে মারব। পুলিশ আমার ভাই-বোনদের গুলি করে মারতেছে। এই জন্য তাদেরও আমি মারব।’ বাড়ির সবাই জাবিরের এই কথায় অবাক হয়ে যায়।

ওই দিন দুপুরের দিকে স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৪২), সন্তান জুবাইনা কবির নেহা (২১), জুবায়ের মাহতাব আবদুল্লাহ (১১) ও জাবির ইব্রাহিমকে (৬) সঙ্গে নিয়ে ঢাকার উত্তরা এলাকায় বিজয় উল্লাসে যোগ দিতে যান কবির হোসেন (৫৩)।

ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে হাজার হাজার মানুষ তখন সড়কে সড়কে আনন্দ মিছিল করছিল। খুব খুশি ছিল শিশু জাবির ইব্রাহিমও। কখনো মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে, কখনো আঙুল উঁচিয়ে বিজয় উদযাপনে সেও সবার মতো ব্যস্ত ছিল।

বাবা কবির হোসেন বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে একটি সেতুর ওপর ছিলাম আমরা। এ সময় হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পাই। লোকজনও দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। আমিও পরিবারের লোকজন নিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করি। জাবিরের ডান হাত ছিল আমার বাঁ হাতে ধরা। হঠাৎ একটি গুলি এসে জাবিরের পায়ে লাগে। একটু দূরে গিয়েই জাবির নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তাকে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসকদের অনেক অবহেলা ছিল। পরে ঢাকা স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসক জাবিরকে মৃত ঘোষণা করেন।’

শহিদ জাবির ইব্রাহিমের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্দ ইউনিয়নের তুলাই শিমুল গ্রামে। তবে তাদের পরিবার ঢাকার উত্তরায় থাকত। জাবিরের বাবা উত্তরা এলাকায় ব্যবসা করেন। সেখানেই তাদের বসবাস। জাবির পড়ত উত্তরা কেসি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নার্সারি বিভাগে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে জাবির ইব্রাহিম ছিল সবার ছোট। জাবিরের মৃত্যুকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না তার পরিবার।

বাবা কবির হোসেন বলেন, ‘সন্তানকে কোনোভাবেই ভুলতে পারছি না। এই সময় তিনি সন্তান হত্যার বিচার দাবি করেন।’
জাবিরের বড় বোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবাইনা কবির নেহা বলেন, ‘আমি শুরু থেকে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম। গত ৫ আগস্ট বিজয়ের দিন বিকেলে আমার ছোট ভাই জাবিরকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিলাম বিজয় উৎসব করতে। বিজয়ের দিনে আমার ভাইকে আমি হারিয়েছি। এ দুঃখ ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমার ভাইটি বিজয় উদযাপন করতে পারল না।’

এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জেলার ২০ জন নিহতের একটি খসড়া তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। পরে যাচাই-বাছাই করা হয়। এর মধ্যে তালিকায় ৮ নম্বরে আছে আখাউড়ার শিশু জাবির ইব্রাহিম। তার নামটি শহিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি সুপারিশসহ গৃহীত হয়েছে।’ সূত্র: বাসস।

বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের দাম ছিল আকাশচুম্বী

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪০ এএম
আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৬ এএম
বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের দাম ছিল আকাশচুম্বী
ছবি: খবরের কাগজ

চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজারে বছরজুড়ে ছিল অস্থিরতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ডলারসংকট, ডলারের দাম বাড়া, ভারতের পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন কারণে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ, মসলার দাম ছিল আকাশচুম্বী।

বছরের শুরুতেই মসলার আমদানি বাড়লেও আমদানিতে শুল্ক অনেক বেশি, এমন অজুহাতে বিভিন্ন ধরনের মসলার দাম বাড়ানো হয়। চাক্তাই-পাহাড়তলি পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের কেজিতে ২ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত বাড়ে। বছরের শুরতেই পাইকারিতে কেজি প্রতি পেঁয়াজ ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়।

গত জুনে চোরাই পথে আসা ভারতীয় ভেজাল চিনিতে খাতুনগঞ্জ সয়লাব হয়ে যায়। খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি চোরাই চিনি বিক্রি হয় ১১৫ টাকায়। আর খুচরায় ১২৫ টাকায়। ঈদুল আজহা পরবর্তী সময়ে খুচরায় এক ডজন ডিম কিনতে গুনতে হয়েছে ১৬০ টাকা। জুলাইয়ে বন্যার অজুহাতে মোটা চালের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানো হয়। সেই সঙ্গে বাড়ানো হয় চিনি ও পাম অয়েলের দাম। তা ছাড়া সব ধরনের সবজির দাম বেড়ে যায়। 
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ও বুকিং রেটও বাড়ার অজুহাতে অক্টোবরের শুরুতে চার দিনের ব্যবধানে শুধু পাম অয়েলের দাম লিটারে ১৪ টাকা ৫৪ পয়সা ও সয়াবিন তেলে ৫ টাকা ২৫ পয়সা বাড়ানো হয়।

পাহাড়তলীতে অক্টোবরের শুরুতে পাইকারিতে প্রতিটি ডিম ১২ টাকা ৯০ পয়সায় বিক্রি হয়। খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হয় ১৫ টাকায়। বৃষ্টির অজুহাতে পাইকারিতেই কাঁচা মরিচের দাম কেজিতে ১১০ টাকা বাড়ানো হয়। সেদিন রিয়াজউদ্দিন বাজারে পাইকারি দোকানগুলোতে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হয় ২৭৫ টাকায় এবং খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৩৫০ টাকায়। কোথাও কোথাও খুচরায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়ও বিক্রি হয়।

নভেম্বরে এসে বিশ্ববাজারে বুকিং রেট বাড়ানোর খবরে বাজার থেকে ভোজ্যতেল উধাও হয়ে যায়। গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে খাতুনগঞ্জে আগের কেনা ভোজ্যতেলের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়। খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ সয়াবিন তেল ৬ হাজার ৮৫০ টাকায় ও পাম অয়েল ৬ হাজার ৪৪০ টাকায় বিক্রি হয়, যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। কৃষক পর্যায়ে ৩৫ টাকায় বিক্রি হওয়া আলু চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, রিয়াজউদ্দিন বাজার ও পাহাড়তলীর আড়তে বিক্রি হয় ৫৯ টাকায়। আর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হয় ৭০ টাকায়।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘২০২৪ জুড়েই নিত্যপণ্যের দাম ও সরবরাহ সংকট ছিল। প্রান্তিক আয়ের মানুষ বিশেষ করে সীমিত ও মধ্যবিত্তদের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে একের পর এক পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়েছেন। ব্যবসায়ীদের এই অতি মুনাফা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের ভোক্তা অধিকার, জেলা প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতা লক্ষণীয় নয়। নিত্যপণ্যের বাজার সংস্কারে সরকারের দৃশ্যমান উদ্যোগ, সরকারি উদ্যোগের যথাযথ নাগরিক নজরদারি নিশ্চিত, অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রকৃত কৃষক পর্যায়ে সরকারি সহায়তা পৌঁছানো গেলে কিছুটা সুফল পাওয়া যাবে।’

অরাজকতার বলি ১১৪ জন

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২৬ এএম
আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৭ এএম
অরাজকতার বলি ১১৪ জন
ছবি : সংগৃহীত

অভ্যুত্থানের ঠিক পর মাঠে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এই সুযোগে অনেকেই আইন হাতে তুলে নেওয়ার সাহস দেখায়। তাদের অনেকেই টার্গেট করে ব্যক্তি-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। দেশের অনেক প্রান্তেই গণপিটুনিতে মৃত্যুর খবর আসে গণমাধ্যমে। গণপিটুনিতে মৃত্যুর খবর এ দেশে নতুন না। এমন সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ ক্ষত রেখে বিদায় নিচ্ছে ২০২৪ সাল।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, বিদায়ী বছরের (২০২৪) জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১১৪টি। এর মধ্যে আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র চার মাসেই এ রকম ‘হত্যার’ শিকার হন অন্তত ৮২ জন। এর মধ্যে আগস্ট মাসে ২১ জন, সেপ্টেম্বরে ২৮ জন, অক্টোবরে ১৯ জন এবং নভেম্বরে নিহত হন ১৪ জন। তার আগের সাত মাসে তথা জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে মোট ৩২ জন নিহত হয়েছেন। 

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেছেন, এ রকম হত্যাকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরেই ঘটে আসছে। তবে গত জুলাই-পরবর্তী সময়ে দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতির সুযোগে অপরাধীরা এ ধরনের ঘটনায় বেশি যুক্ত হয়। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর খবরের কাগজকে বলেন, ‘মব জাস্টিস’ বা বিচারবহির্ভূত প্রতিটি হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এসব মামলায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ প্রতিটি ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে যাচ্ছে।’

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া, সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হোক আর সাধারণ মানুষের গণপিটুনিতে হোক- সব হত্যাকাণ্ডই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। মব জাস্টিসের নামে হত্যার অনেক ঘটনা ঘটছে। এসবও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ জাতীয় মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনোভাবে সরকারকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’
এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিগত সময়ে ব্যাপক সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। গত রবিবার (২৯ ডিসেম্বর) রাতে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আপাতত আর কোনো মন্তব্য করব না।’

এর আগে দুই দিনের সফর শেষে গত ৩১ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মব জাস্টিস’ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো ধরনের হত্যাকাণ্ডের দায়মুক্তি সমর্থন করে না জাতিসংঘ। প্রতিটি অপরাধের তদন্ত করতে হবে। ৫ আগস্টের আগে-পরে হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচার করতে হবে।’ 

বিদায়ী বছরের আলোচিত হত্যাকাণ্ডের কয়েকটি এখানে দেওয়া হলো। গত ১৩ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে এ বিষয়ে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চোর সন্দেহে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

এর আগে ৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে ‘গণপিটুনি’ দিয়ে হত্যা করা হয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পঙ্গু আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে চোর সন্দেহে আটক করে কয়েক দফা পেটানো হয়। রাতে হলের ক্যানটিনে বসিয়ে তাকে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর আবারও মারধর করা হয় তাকে। একপর্যায়ে মারা যান তোফাজ্জল। একই তারিখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।