![সংরক্ষিত নারী আসনে তারকাদের দৌড়ঝাঁপে নাখোশ দুর্দিনের নেত্রীরা](uploads/2024/02/12/1707708610.bangladesh-perliament-02.jpg)
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইছেন শো-বিজ অঙ্গনের বহু তারকা। তারা আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও তদবির করছেন। আগামী বুধবার দলের সভাপতি শেখ হাসিনা সব মনোনয়নপ্রত্যাশীর সাক্ষাৎকার নেবেন। তার আগেই দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা নাটক ও চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়তে শুরু করেছেন দলের দুর্দিনের নেত্রীরা। গত তিন দিন ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এমনটি দেখা গেছে।
কার্যালয়ে আসা নেত্রীদের ভাষ্য, দলের কঠিন সময়ে আওয়ামী লীগের নেত্রীরা বহু ত্যাগ শিকার করেছেন। আর দলের সুসময়ে মধু খেতে অনেকে দলে ভিড় করছেন। ২০০৮ সালেও এদের আওয়ামী লীগ করতে দেখা যায়নি। এখন দলের মনোনয়ন ফরম কিনে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে লবিং-তদবির করছেন। ত্যাগী নেত্রীদের বাদ দিয়ে যদি অভিনেত্রীদের সংসদ সদস্য করা হয় তাহলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী মনোনীত করার ক্ষেত্রে অবশ্যই দলের ত্যাগী নেত্রীদের মূল্যায়ন করা হবে।
রাজশাহী বিভাগের সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি-প্রত্যাশী মহিলা আওয়ামী লীগের এক নেত্রী গত শনিবার সন্ধ্যায় শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে সালাম দিতে আসেন। কিন্তু অনেকের ভিড়ে তিনি কেন্দ্রীয় শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকে সালাম দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা দল থেকে কিছু পাওয়ার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করিনি। তখন এত নেতানেত্রী দেখা যায়নি। এখন দল ক্ষমতায়, সবাই মধু খেতে দলে ভিড় করছেন। দুঃসময়ে দলের ত্যাগ, আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে দলীয় মূল্যায়নে একজন এমপি হন। অনেক সংগ্রাম আর কাঠখড় পুড়িয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। আজ যেভাবে রঙিন পর্দার নারীরা সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হতে চাইছেন, সেটাকে ধিক্কার জানাই।’
গত বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশী অভিনেত্রীর ভিড় দেখে প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দেন দুঃসময়ের নেত্রী হিসেবে পরিচিত যুব মহিলা লীগের নেত্রী আসমা আক্তার রুনা। বর্তমানে সংগঠনটির সহসভাপতি পদে থাকা এই নেত্রী বলেন, রাজনীতিতে এসে জীবন-যৌবন নষ্ট করছি। জেল খেটেছি, নিজের পাঁচটা বাড়ি বিক্রি করছি। স্বামীও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কী লাভ হলো, এতসব ত্যাগ করে? তিনি বলেন, ‘দলের দুর্দিনে রাজপথে ছিলাম। সেই অধিকার নিয়ে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন ফরম কিনতে এসেছি। এসেই হতাশ হয়ে পড়লাম। নায়িকাদের বেল দেখে হতাশ না হয়ে পারছি না। এই নায়িকারা কই ছিল এতদিন? রাজপথে তো তাদের কাউকেই দেখিনি কোনো দিন। এরা যদি আমাদের মতো কর্মীদের ভাগ্য নষ্ট করতে আসে, তাহলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব।’
ঢাকা মহানগর উত্তর যুব মহিলা লীগের সাবেক সভাপতি সাবিনা আক্তার তুহিন বলেন, ‘এখন ভুঁইফোঁড় অনেকেই সংরক্ষিত আসনে এমপি হতে চাইছেন, যা দলের অনেকেই ভালোভাবে নিচ্ছেন না। দৃষ্টিকটুও বটে। এমপি হওয়ার এত শখ থাকলে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসতেন। নেত্রীও তাদের মূল্যায়ন করতেন। জাতীয় নির্বাচনের সময়ও এদের দেখা যায়নি। শুধু নারী আসনের এমপি হতে চান। আমাদের মনোনয়ন ফরমে প্রার্থীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জানতে চাওয়া হয়েছে, তবে অনেকেই সেখানে নিজের সঠিক কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে পারেননি বলেও অভিমত দেন দলের ত্যাগী এই নেত্রী।’
যুব মহিলা লীগের সভাপতি আলেয়া সরোয়ার ডেইজী বলেন, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলের জন্য জেল-জুলুমের শিকার হয়েছি। রাজপথে থেকে আন্দোলন করেছি, তাই আমাদের প্রত্যাশাও বেশি। তবে আমাদের নেত্রীর শেখ হাসিনার ওপর শতভাগ আস্থা রয়েছে, তিনি যা করবেন ভালো জন্যই করবেন। তিনি যা চিন্তা করেন আমরা তার ধারেকাছেও যেতে পারি না।’
এবার দলের মনোনয়ন পেতে ফরম কিনেছেন ১ হাজার ৫৪৯ জন নারী। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসনের প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ হবে আগামী বুধবার। এর মধ্যে ৪৮টি আসনে মনোনয়ন দিতে পারবে আওয়ামী লীগ। বাকি দুটি জাতীয় পার্টির। আওয়ামী লীগের দপ্তর থেকে জানিয়েছে, আগামী বুধবার দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হতে পারে।
সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হতে কমপক্ষে ১৫ জন অভিনেত্রীসহ অন্য পেশাজীবী সংগঠনের নেত্রীরা আওয়ামী লীগের ফরম সংগ্রহ ও জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে আলোচিত মনোনয়ন সংগ্রহকারী অভিনেত্রীরা হলেন- সুবর্ণা মোস্তফা, রোকেয়া প্রাচী, শমী কায়সার, নিপুণ আক্তার, সোহানা সাবা, শামিমা তুষ্টি, অপু বিশ্বাস, তানভিন সুইটি, মেহের আফরোজ শাওন, শাহনূর, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, জাকিয়া মুন, তারিন জাহান, মাহিয়া মাহি, সিমলা প্রমুখ। এদের মধ্যে সুবর্ণা মোস্তফা গত সংসদে (একাদশ সংসদ) সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি ছিলেন। আর মাহি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেন।
রোকেয়া প্রাচী সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ছাড়াও সাংস্কৃতিক জগতের মধ্যে অভিনেত্রী তারানা হালিম, চিত্রনায়িকা জ্যোতিকা জ্যোতি, গায়িকা মমতাজ বেগম দলটির সক্রিয় রাজনীতি করেন। তারানা হালিম দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য। চিত্রনায়িকা জ্যোতিকা জ্যোতি বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপকমিটির সদস্য। সাবেক এমপি মমতাজ বেগম মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। বাকি প্রার্থীদের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিচয় জানা যায়নি।
মনোনয়ন কেনার পর নিজেদের প্রতিক্রিয়ায় এসব অভিনেত্রীর মধ্যে কয়েকজন সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছিলেন, তারা আওয়ামী লীগের অনুসারী বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান কিংবা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ছাত্রজীবন থেকেই জড়িত।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নের আশা-প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিনেত্রী শমী কায়সার বলেন, নেগেটিভ-পজিটিভ ফলাফল যাই আসুক, পরে কথা বলব। আগেই এসব নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।
সংরক্ষিত নারী আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত মঙ্গলবার বলেন, ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের মনোনয়ন দেবে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের পর থেকেই পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে কাজ শুরু করে দেন। জেলা সফরে গিয়েও যোগ্য কাউকে দেখলে তার নাম লিখে রাখেন। সময়মতো সেটা কাজে লাগান।
সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য মনোনয়নের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীর যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়া হয়। দলের দুঃসময়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রয়াত নেতাদের পরিবারের সদস্যরাও থাকেন। এবারও এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নেত্রী (আওয়ামী লীগ সভাপতি) মনোনয়ন দেবেন।