![চরে আবাদ হলে অর্থনীতিতে যোগ হবে ৫ লাখ কোটি টাকা](uploads/2024/02/12/1707713138.bogura-news.jpg)
নদ-নদীর চরাঞ্চলে অনাবাদি জমি প্রায় সাড়ে ৩৬ লাখ একর। এই জমিতে সঠিকভাবে শুধু ভুট্টা, মরিচ, পাট, ধান আর ঘাস চাষ করলেই বছরে জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হবে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) তাদের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, চরে পতিত ৩৬ লাখ ৪৪ হাজার একর জমির মধ্যে এখন ধান, পাট, মরিচ, ভুট্টাসহ নানা ধরনের ফসল চাষ হয় ৯ লাখ ১১ হাজার একর জমিতে। আর বছরের পর বছর অনাবাদি পড়ে আছে প্রায় ২৭ লাখ ৩৩ হাজার একর জমি। চরের মানুষের জীবন মান উন্নয়নে পল্লী উন্নয়ন একাডেমির সঙ্গে কাজ করছে মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর দ্য চরস (এমফোরসি) প্রকল্প। এমফোরসি ইতোমধ্যেই উত্তরাঞ্চলে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র আর যমুনার চরে থাকা প্রত্যক্ষভাবে ৭৯ হাজার মানুষের জীবন মানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পেরেছে।
চরাঞ্চলে পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনার ক্ষেত্রে বড় বাধা কী, এ প্রশ্নের জবাবে এমফোরসি পরিচালক ড. আব্দুল মজিদ বলেন, ‘সেচসংকট, উন্নত বীজ, সার ও প্রযুক্তির অভাবের পাশাপাশি যোগাযোগের সুব্যবস্থা না থাকার কারণে জমি অনাবাদি থাকে।’ এসব সমস্যা সমাধানে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যেই চর উন্নয়ন ও গবেষণা কেন্দ্র (সিডিআরসি) একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। সেচসংকট মোকাবিলার জন্য পোর্টেবল সোলার প্যানেল তৈরি করা হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে। পোর্টেবল প্যানেল যেখানে প্রয়োজন সেখানে নিয়ে সেচযন্ত্রে লাগানো সম্ভব হবে।’
বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) মহাপরিচালক মো. খুরশীদ ইকবাল রেজভী বলেন, ‘চর উন্নয়ন ও গবেষণা কেন্দ্র (সিডিআরডি) যে তথ্য দিয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা একটি প্রকল্প সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার পর সবুজ পাতায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্প গ্রহণ করা হলে কাজ শুরু হবে।’
মো. খুরশীদ ইকবাল রেজভী বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি ২০০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত এ প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগীদের সম্পৃক্ত করার।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রকল্পে কাজ শুরু হলে দেশের উত্তরাঞ্চলে চরাঞ্চলের মানুষের মতোই জীবন মানে পরিবর্তন আসবে দেশের অন্য এলাকার চরে থাকা মানুষের।’
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দেশের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ চর। আর এ চরাঞ্চলেই বাস করেন অন্তত ৮০ লাখ মানুষ। তাদের ৫ ধরনের ফসল ভুট্টা, মরিচ, পাট, ঘাস ও ধান চাষে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বছরে ওই সব ফসলের অতিরিক্ত ফলন হবে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মণ।’
শুধু উত্তরাঞ্চলেই তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র আর যমুনা নদের পতিত জমি থেকে বছরে পাওয়া যাবে ৪ লাখ ২০ হাজার মণ ঘাস, যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। চরের পতিত জমিতে ভুট্টা চাষ সম্ভব হলে বছরে পাওয়া যাবে প্রায় ১০ হাজার ৮০ কোটি টাকা মূল্যের অতিরিক্ত ১ লাখ ৪৪ হাজার মণ ভুট্টা। পাট ও ধানের চেয়ে মরিচ আর ভুট্টা চাষ করে চরের চাষিরা টাকা গুনছেন বেশি। ভুট্টার মতোই চরে পতিত জমিতে মরিচ চাষ করা হলে বছরে ১২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার মণ শুকনো মরিচ পাওয়া যাবে। একইভাবে চরের পতিত জমিতে পাট লাগাতে পারলে বছরে ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা মূল্যের অতিরিক্ত পাট পাওয়া যাবে ৯০ হাজার মণ। একই ভাবে ব্রি-২৪ ধানের বাড়তি উৎপাদন সম্ভব ৫৪ হাজার মণ আর তা করা সম্ভব হলে আয় হতে পারে বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী ৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। উত্তরাঞ্চলের নদনদীর চরাঞ্চলের এখন ফসলের ফলন যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে ওই ৩টি নদনদীর চরাঞ্চল থেকেই বছরে জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হবে প্রায় ৬২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। অনুরূপভাবে সারা দেশের চরের জমিতে পরিকল্পিতভাবে সম্ভাবনাময় ফসল আবাদ করা সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতিতে ৫ লাখ কোটি টাকা যোগ হতে পারে।
বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ)-র যুগ্ম পরিচালক ও মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দ্য চর (এমফোরসি) প্রকল্প পরিচালক ড. আব্দুল মজিদ বলেছেন, ‘ইতোমধ্যেই চরে ওই সব ফসলের ফলন বেড়েছে ২ থেকে ৪ গুণ পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি ফলন বেড়েছে ভুট্টা ও মরিচের।’ তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্পের আওয়তায় মূল ভূ-খণ্ডের সুযোগ-সুবিধা চরাঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই মূল ভূ-খণ্ডের কিছু সুবিধা চরাঞ্চলে নেওয়া সম্ভব হওয়ায় ফসলের ফলন বেড়েছে। আগে চরে প্রতি একরে ভুট্টা উৎপাদন হতো ৩০ মণ, সেখানে এখন হচ্ছে ১২০ মণ পর্যন্ত। মরিচের ফলন আগে একরে পাওয়া যেত ১৫ মণ আর এখন বেড়ে হয়েছে ৩০ মণ। পাটের ফলন একরে ৯ মণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ মণে আর ব্রি-ধান ২৪ এখন একরে হচ্ছে ৫৪ মণ পর্যন্ত। কিছু দিন আগেও চরে একরে এ ধানের ফলন ছিল ৩৬ মণের মধ্যেই। সবচেয়ে বেশি ফলন বেড়েছে ঘাসের। এখন পাওয়া যাচ্ছে গড়ে একরে ২১ মণ করে।
কথা হয় জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ঝালুর চরের কৃষক মো. জাহিদ হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে একরপ্রতি ধান উৎপাদন হয়েছে সর্বোচ্চ ৩০ মণ। এখন হাইব্রিড লাগিয়ে প্রতি একরে পাওয়া যাচ্ছে ৯৬ মণ পর্যন্ত। আগে একরে ভুট্টা পাওয়া যেত ৯০ মণ। এখন পাওয়া যচ্ছে ১২৬ মণ পর্যন্ত।’ পতিত জমিতে ঘাস চাষ করে কতটা উপকৃত হচ্ছেন এ প্রশ্নের জবাবে মো. জাহিদ হাসান বলেন, ‘কোনো চাষি যদি তার ১৫ শতাংশ জমিতে ঘাস চাষ করেন, তবে তার ৩/৪টি গরুর জন্য আর খড় কিনতে হবে না।’
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়ার চরের কৃষক শাহ ফিরোজ আহম্মেদ। তিনি গত বছর তার ১৫ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড মরিচ চাষ করেন। ফলন হয় ৪৬ মণ। কৃষক শাহ ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, ‘১৫ শতাংশে মরিচ চাষে খরচ হয় ১৯ হাজার টাকা আর আমি ৪৬ মণ বিক্রি করে পেয়েছি ৬৫ হাজার টাকা, লাভই হয়েছে ৪৬ হাজার টাকা।’ তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরেই চরে সব ধরনের ফসলের ফলন বেড়েছে। চরে এখন পাওয়া যায় ভালো বীজ, আছে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ফসল চাষের জন্য ঋণের সুযোগ।’