![সম্পর্ক শক্তিশালী করতে ৩ ধারা নিয়ে এগোতে চায় ওয়াশিংটন](uploads/2024/02/27/1709010912.us-dept-of-state.jpg)
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও দুই পক্ষই এখন সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চাইছে। নির্বাচনের পর এখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহের কথা বলছে। এ লক্ষ্যে তারা সংলাপের তিনটি ধারা নিয়েই এগোতে চায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্বিপক্ষীয় সংলাপের তিনটি ধারা থাকে। এগুলো হলো নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং কূটনীতি ও রাজনীতি। ওয়াশিংটন এখন এই তিনটি ধারা নিয়েই ঢাকার সঙ্গে কাজ করতে চায়।
তিন দিনের সফর শেষে সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) ফিরে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলে উল্লিখিত তিন ধারাবিষয়ক কর্মকর্তাই ছিলেন। দলে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য যেমন ছিলেন, তেমন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা সংস্থা ইউএসএআইডির শীর্ষ কর্মকর্তাও।
প্রতিনিধিদলের নেতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ সহকারী ও দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জ্যেষ্ঠ পরিচালক এইলিন লুবাখার বলছেন, ‘অভিন্ন অগ্রাধিকার ও ভবিষ্যতে একযোগে কাজ করার পথ নিয়ে আলোচনা করতে পারা আমাদের জন্য আনন্দের, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়ার প্রেক্ষাপটে যেটির প্রতীক্ষা আমরা করছি।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র একমত হয়েছে। যেহেতু দুই দেশেরই সদিচ্ছা আছে, সুতরাং এই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, গভীরতর ও উন্নয়নের মাধ্যমে উভয় দেশ উপকৃত হবে।’
এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে যে একটা ধোঁয়াশা ছিল তা কেটে গেছে। নির্বাচন হয়ে গেছে। এখন হয়তো দেশটি সামনে তাকাতে চায়। এটা ভালো দিক।’
এক প্রশ্নের উত্তরে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশের এমন কোনো চুক্তিতে যাওয়া ঠিক হবে না, যাতে করে অন্য বড় শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়। চুক্তি আমাদের অন্য অনেক দেশের সঙ্গেই আছে। চীনের কাছ থেকে অস্ত্র কিনি, ঋণ নিই। যৌথ মহড়া হয়। এগুলো তো কোনো না কোনো চুক্তির অধীনেই হয়। এমন চুক্তি অনেকের সঙ্গেই হয়। মূল কথা হলো, চুক্তির ধারাগুলো কী হবে সেটা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তো স্পষ্ট করে বারবার বলা হয়েছে যে বিশেষ কোনো সামরিক জোটে আমরা যেতে চাই না।’
নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক সহযোগিতা
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে বড় অংশীদার। বাংলাদেশের সেনা ও পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণসহ নানা সহযোগিতা দেয় দেশটি। প্রায় চার-পাঁচ বছর ধরে সামরিক সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি নিয়ে কথা হচ্ছে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে।
দুই দেশের মধ্যে অস্ত্র ও সামরিক সহযোগিতাবিষয়ক দুটি চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিটি করতে চায়। বাংলাদেশও বলে আসছে তারা চুক্তি দুটির ব্যাপারে আন্তরিক। চুক্তি দুটি হলো জিসোমিয়া (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট) ও আকসা (অ্যাকুজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট)।
জানা যায়, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি দুটি আছে যুক্তরাষ্ট্রের। আকসার অধীনে মার্কিন বাহিনী খাদ্য, জ্বালানি, গোলাবারুদ ও সরঞ্জামাদি বিনিময় করে থাকে। জিসোমিয়া চুক্তির অধীনে সামরিক গোয়েন্দা তথ্যের বিনিময় হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সফরকালে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জিসোমিয়া চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে খুব বেশি আলোচনা হয়নি।’
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘কোয়াড’ নামে একটি জোট আছে। বর্তমানে এই জোটের সদস্যদেশ চারটি- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। এই জোটটি একটি সামরিক জোট এবং এটিকে এশিয়ার ন্যাটো বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দিক। তবে বাংলাদেশ যাতে জোটটিতে যোগ না দেয়, সে ব্যাপারে চীন কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেই নেওয়া উচিত। কিন্তু এই প্রতিনিধিদলের সফরকে এত কেন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জানি না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এলে বিষয়টা আলাদা ছিল। কাজেই কোনটা গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা গুরুত্বপূর্ণ না, সেটা আগে আমাদের বুঝতে হবে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বিশ্বায়নের যুগে, বহুমাত্রিক কাঠামোর যুগে এ ধরনের সফর স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অনেক কিছুই বোঝাবে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সবকিছু করতে হবে।’
সফরকালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র যাতে মায়ানমারের ওপর চাপ দেয়, সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মায়ানমার পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তাঝুকিঁ তৈরি করেছে সেটা তো ঠিক। এটা নিয়েও মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা করেছি।’
ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্য, বিনিয়োগ থেকে শুরু করে প্রবাসী আয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে অনেকগুলো বড় কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। সাগরে সবগুলো ব্লক চায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় তেল কোম্পানি এক্সন মোবিল। এ ছাড়া আরেক মার্কিন বিশাল কোম্পানি শেভরনও বাংলাদেশের সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান করতে চায়।
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের পর রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। জিএসপি প্লাস সুবিধা যাতে বহাল থাকে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেই প্রত্যাশা করে। সফরকালে এ বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগী। পণ্য রপ্তানির বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। সম্পর্কের নতুন যুগ সৃষ্টিতে কাজ করতে চায় দেশটি।’
কূটনীতি ও রাজনীতি
নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাজনীতি ও মানবাধিকার নিয়ে এক রকম সোচ্চার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার ইস্যুতে র্যাব ও এর ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে দেশটি।
তবে নির্বাচন হয়ে গেছে। এখন যদিও যুক্তরাষ্ট্র এগুলো নিয়ে কোনো কথা বলছে না, তবে র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে পাঁচটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশ এগুলো নিয়ে কাজ করছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তবে তিনি জানান, আলোচনায় বাংলাদেশের নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
সফরকালে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল। তবে তাদের মধ্যে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটি কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি।
আলোচনা হয়েছে শ্রম অধিকার ও শ্রমকল্যাণ নিয়েও। শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পরররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার।
এ ছাড়া সফরকালে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও বৈঠক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল। বৈঠক শেষে অবশ্য সাংবাদিকদের কিছু বলতে রাজি হননি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।