দেশের পুঁজিবাজারে গত এক মাস ধরে পতনের যে ধারা অব্যাহত ছিল, তা কিছুটা কমেছে। এর আগে গত মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মূল্যসূচক ৩৪ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে যায়। দরপতনের আতঙ্কে এদিন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
বিক্ষোভের পর বুধবার (২০ মার্চ) ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৫৮ পয়েন্ট বাড়লেও লেনদেনে তেমন একটা গতি দেখা যায়নি।
টানা দরপতনের প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা ডিএসইর সামনে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন। এ সময় প্রতিবাদকারীরা লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন রয়েছে। মানববন্ধন কর্মসূচিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অংশ নেন। তারা বাজারে আস্থা ফেরাতে ও দরপতন ঠেকাতে আইসিবিসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থাকে সাপোর্ট দেওয়ার দাবি জানান।
বিক্ষোভ ও মানববন্ধনের পরের কার্যদিবস গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৪২২ কোটি ৮৩ লাখ টাকার। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৪৬৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকার। সে হিসাবে লেনদেন কমেছে ৪২ কোটি ৬৭ লাখ টাকার।
এই লেনদেনে সব থেকে বেশি অবদান রেখেছে ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার। কোম্পানিটির ২১ কোটি ৭৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ফু-ওয়াং সিরামিকের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৬ কোটি ৬২ লাখ টাকার। ১৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস।
ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে গোল্ডেন সন, ওরিয়ন ফার্মা, রবি, বেস্ট হোল্ডিং, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, মালেক স্পিনিং এবং মুন্নু ফেব্রিক্স।
ঢাকার বাজারের প্রধান সূচকটি গতকাল দিন শেষে আগের দিনের তুলনায় ৫৮ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছিল ৫ হাজার ৮৭২ পয়েন্টে।
গতকাল লেনদেন শেষে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে ৩০৫টি প্রতিষ্ঠান। বিপরীতে দাম কমেছে ৫২টি প্রতিষ্ঠানের। আর ৪৪টির দাম অপরিবর্তিত ছিল।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই বেড়েছে ১০৬ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ২০৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২৯টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৫৮টির এবং ২০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। লেনদেন হয়েছে ১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছে ১৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের পুঁজিবাজারে গতকাল সূচক বাড়লেও এখনই এ বাজার নিয়ে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এখনো লেনদেনে তেমন একটা পরিবর্তন নেই। লেনদেনে যখন ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি আসবে, তখন পুঁজিবাজারকে ইতিবাচক বলা যাবে।
এ বিষয়ে মিডওয়ে সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক লেনদেন বাড়লে ইতিবাচক বাজার বলা যাবে। গতকালের লেনদেন শেষে শুধু সূচকই বেড়েছে। সে তুলনায় লেনদেন তেমন একটা বাড়েনি। রমজান মাসে প্রতিবছরই বাজার একটু খারাপ থাকে। তবে এ অবস্থা থেকে বাজার শিগগিরই ভালো অবস্থানে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা দরপতন চলতে থাকায় বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে অনেক বিনিয়োগকারী এখন শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করছেন বেশি। ভালো শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায় চলে এলেও এসব শেয়ারের ক্রেতা কম। বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, সূচকের পতন হলে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দেন। তখন কোনো যৌক্তিক কারণ সেখানে আর কাজ করে না।
বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘বাজারে অস্বাভাবিক দরপতনের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। কারসাজি বা গুজব ছড়িয়ে কেউ বাজারে দরপতন ঘটাচ্ছে কি না, সেটি আমরা গভীরভাবে খতিয়ে দেখছি। এ জন্য বাজারে তদারকি জোরদার করা হয়েছে।’
বিনিয়োগকারীদের উচিত এখন ধৈর্য ধারণ করা। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বিনিয়োগকারীরা যাতে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি না করেন, সে জন্য আশ্বস্ত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
অব্যাহত দরপতনের কারণ
বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকের সুদের হার বেড়ে সাড়ে ১২ শতাংশ হয়েছে। বাজারে সাপোর্ট দেওয়ার দায়িত্বে থাকা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) যে ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছিল, সেগুলো পরিশোধের সময় চলছে এখন। ফলে আইসিবি বাজারে সাপোর্ট দিতে পারছে না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার বদলে বিক্রি করছেন। সবকিছু মিলিয়েই পুঁজিবাজারে টানা দরপতন চলছে।
জেড শ্রেণি নিয়ে নির্দেশনা
কিসের ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ‘জেড’ শ্রেণিতে যাবে, সে বিষয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এক নির্দেশনা জারি করেছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। ওই নির্দেশনার শেষ পয়েন্টে বলা হয়, তালিকাভু্ক্ত কোম্পানির পরবর্তী লভ্যাংশসংক্রান্ত ঘোষণা অথবা বার্ষিক/অন্তর্বর্তী লভ্যাংশসংক্রান্ত ঘোষণার দিন থেকে এ নির্দেশনা কার্যকর হবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন নির্দেশনা থাকলেও ডিএসই থেকে হুট করে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২২ কোম্পানিকে ‘জেড’ শ্রেণিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ঘোষণা আসে নতুন করে আর কোনো কোম্পানিকে ‘জেড’ শ্রেণিতে নেওয়া হবে না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি কোম্পানিকে ‘জেড’ গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়।
এভাবে কিছু কোম্পানিকে ‘জেড’ গ্রুপে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ধারাবাহিক দরপতনের মধ্যে পড়ে বাজার।