ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

ইসরায়েল-ইরান পরিস্থিতি: সংকটের শঙ্কা বাংলাদেশেও

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৪ পিএম
আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৪, ০৬:৫৪ পিএম
ইসরায়েল-ইরান পরিস্থিতি: সংকটের শঙ্কা বাংলাদেশেও
ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধকল এখনো বাংলাদেশসহ বিশ্ব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এমন একটি পটভূমিকায় আবারও মধ্যপ্রাচ্যে বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধের ব্যাপ্তি বাড়লে বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও মূল্য দিতে হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ভুগছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে বেশ কয়েকবার সতর্ক করেছেন। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা নির্ভর করছে যুদ্ধ কতটা ছড়িয়ে পড়ে সেটার ওপর। যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং অন্যান্য দেশ এতে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে নিঃসন্দেহে বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর উদ্বেগের ব্যাপার হবে। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ করেছি তেলের দাম কিছুটা বাড়তি। সমুদ্রপথ যদি বিপদসংকুল হয়ে যায়, তাহলে জাহাজে করে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে তেলের দাম অবশ্যই বাড়বে। যুদ্ধ বাড়লে আমাদের জনশক্তি খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং সম্ভাব্য সংকট উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু গতকাল সোমবার সচিবালয়ে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ে ঈদে স্বস্তি ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় অস্বস্তিতে আছি। কারণ আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব বাজারে পড়বে। এসব চ্যালেঞ্জ যাতে বাজারে না আসে, সেটা মোকাবিলা করতে হবে।’

যদিও অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত খবরের কাগজকে বলেন, ‘যতটা ভয়ের কারণ বলা হচ্ছে আমার মনে হয় না বেশি কিছু হবে। এই হামলা দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ইরান সীমিত আকারে কিছু অভিযান চালিয়েছে। ইসরায়েল হয়তো এর জবাব দেবে। কিন্তু খুব বড় ধরনের যুদ্ধ বেধে যাবে, এমন কিছু হবে না। বিশ্বের কোনো দেশ এই যুদ্ধ চাইবে না। আমার মনে হয় না উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু আছে। যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তা হলে অর্থনীতির ক্ষতি তো হবেই, পাশাপাশি পুরো বিশ্বের অস্তিত্ব নিয়ে সমস্যা হবে। কারণ যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মুশকিল। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে উদ্বিগ্ন নই। সবাই বোঝে যে যুদ্ধ বেধে গেলে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে। এই ঝুঁকি কেউ নিতে চাইবে না। তবে আপাতত আমি ভয়ের কোনো কারণ দেখছি না।’ 

যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা 

ইসরায়েলে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার পর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য খাদের কিনারে। এ অঞ্চলের মানুষ একটি পূর্ণমাত্রার ধ্বংসাত্মক সংঘাতের মুখোমুখি। তারা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এখনই সময় তাদের খাদের কিনার থেকে ফিরিয়ে আনার। আর এ দায়িত্ব যৌথভাবে সবার।
ইরানের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের যুদ্ধবিষয়ক বিশেষ মন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে। বৈঠকের পর তারা জানিয়েছে যে ইরানে পাল্টা হামলা চালাবে। 

মার্কিন প্রশাসন যদিও বলছে তারা ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ইরানে হামলা চালাবে না, তার পরও আশঙ্কা কাটছে না। কারণ ইসরায়েলকে পূর্ণমাত্রায় সহযোগিতা দিচ্ছে দেশটি। ইতোমধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ কংগ্রেসে পাস করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। 

পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো পরাশক্তিগুলো ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় দেশ তিনটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে তেহরান। 

গত শনিবার রাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের ‘বিশাল ঝাঁক’ ছোড়ে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের ৯৯ শতাংশ আকাশে ধ্বংস করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। যদিও ইসরায়েলের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে ইরানি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, তাদের হামলা শতভাগ সফল হয়েছে। 

এর আগে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করে ইসরায়েল। হামলার ব্যাপারে ইসরায়েল কিছু না বললেও যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এই হামলা ইসরায়েল করেছে। নিহত ১১ জনের মধ্যে ইরানের শীর্ষস্থানীয় একজন কমান্ডারও রয়েছেন। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘যদিও আপাতত মনে হচ্ছে না যুদ্ধ বাড়বে, তার পরও এটা আমেরিকার নির্বাচনের বছর। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রচার চালাতে পারেন যে জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যে হেরে গেছেন। এ ধরনের একটা সিচুয়েশন তৈরি হলে বাইডেন যুদ্ধে জড়াতে পারেন। ইতোমধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ পাস করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।’

এক প্রশ্নের উত্তরে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবই আমরা এখনো কাটাতে পারিনি, তারপর যদি এই যুদ্ধ বাড়ে তাহলে অবস্থা ভয়ানক হবে।’

ইতোমধ্যে অপরিশোধিত তেলের বাজারে মন্দাভাব শুরু

ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের বাজারে মন্দাভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তেলের দাম কিছুটা বাড়তি। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানায়, বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি তেলের বৃহত্তম জোগান আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। তাই ওই অঞ্চলে অস্থিরতা শুরু হলে জ্বালানি তেলের সরবরাহ রুটে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। ফলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে এবং সেই অস্থিতিশীলতার প্রাথমিক লক্ষণ হলো সোমবারের মন্দাভাব।

অপরিশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে ইরান গুরুত্বপূর্ণ বিক্রেতা দেশ। জ্বালানি তেলের উত্তোলন ও বিপণনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাসের অন্যতম এই সদস্যরাষ্ট্র নিজেদের খনিগুলো থেকে প্রতিদিন কমবেশি ৩০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল উত্তোলন করে।

জ্বালানি পণ্যের বাজার বিশ্লেষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যানার্জি আসপেক্টসের কর্মকর্তা অমৃতা সেন বলেন, ‘যদি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা না কমে, তাহলে তার প্রভাব বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজারে পড়বে- তা খুবই স্বাভাবিক… এবং এই প্রভাবের মাত্রা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়েও অনেক বড় হবে।’

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‌‘যুদ্ধ যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে।  আগামী দিনগুলোতে নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব কতটুকু হবে সেটা যুদ্ধের ব্যাপ্তি কেমন হয় সেটার ওপরে নির্ভর করছে।  সেটার জন্য আমাদের আরও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।  ইরানের মধ্যে সংযম দেখা যাচ্ছে।  যুক্তরাষ্ট্রও সংযত।  দেখা যাক কী হয়।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যদি পরিপূর্ণ যুদ্ধ লাগে তাহলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে বিশ্বের তার শতগুণ বেশি ক্ষতি হবে। ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয় তাহলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি পরিবহনে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে।  সেই ক্ষতি সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও পোহাতে হবে। এখন পর্যন্ত যদিও মনে হচ্ছে না পরিপূর্ণ যুদ্ধ লাগবে কিন্তু এটা বলা মুশকিল।’ 

বাংলাদেশে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব সারা বিশ্বে পড়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব হয়েছে সুদূরপ্রসারী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অস্থির হয়ে ওঠে জ্বালানি তেলের বাজার। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হতে থাকে। মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া হয়ে যায়। ঝুঁকিতে পড়ে যায় খাদ্যনিরাপত্তা। অবস্থা এমন হয় যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে সতর্ক করেন।  রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশ যেহেতু গমের বিশাল রপ্তানিকারক দেশ, তাই যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের গমের বাজার অস্থির হয়ে পড়ে। ভারতও গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। 

ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ ক্যালরি গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রায় ৬৮ শতাংশ চালের ওপর নির্ভর করে এবং প্রায় ৭ শতাংশ জোগান আসে গম থেকে। যুদ্ধের আগে যে প্যাকেটজাত আটার দাম কেজিপ্রতি ছিল ৩২ থেকে ৩৫ টাকা, সেটি বেড়ে হয়েছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা। 

শুধু গম নয়, যুদ্ধের কারণে ভোজ্যতেলের বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে বছরে ২০ লাখ টনের মতো ভোজ্যতেল লাগে। এর মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদন হয় দুই থেকে তিন লাখ টন। আর বাকিটা অর্থাৎ চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করতে হয় আমদানি করে। এর পাশাপাশি যুদ্ধের কথা বলে ব্যবসায়ীদের সুযোগ নেওয়ার একটা বিষয় লক্ষ করা গেছে। এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গমের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের দামও প্রতিবেশী যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি হারে বেড়েছে। এই দাম বাড়ার কারণ চালের সরবরাহ ঘাটতি নয়। ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন বলেই আমার ধারণা। খাবারের দাম বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে মানুষের জন্য জীবনধারণ ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে।’

যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের মানুষের আমিষ গ্রহণের হার অনেক কমে গেছে। এ ক্ষেত্রে মুরগির খাবারের দাম বাড়ানোকে দায়ী করা হচ্ছে। বাংলাদেশে মুরগির খাবারের ৬০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে ভুট্টা। বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ১৬ শতাংশ ভুট্টা সরবরাহ করে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে তীব্র সারের সংকট দেখা দেয়। যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সার কারখানাগুলোতে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে। যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশে তখন সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। তেলের কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় একই পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বাড়তি ডলার খরচ করতে হচ্ছে অর্থাৎ আমদানি ব্যয় বেড়েছে।

কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি না বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি করে। যে কারণে ডলারসংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। 

এ ছাড়া হুমকিতে পড়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি। যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের অর্থনীতিতে একটি মন্দাভাব চলে আসায় ইউরোপীয়দের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে বাংলাদেশে নতুন অর্ডারের হারও কমেছে।

‘কিছু বোঝার আগেই গুলি লাগে কোমরে’

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০৪:২০ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০৩:৫৪ পিএম
‘কিছু বোঝার আগেই গুলি লাগে কোমরে’
গুলিতে আহত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসারত কয়েকজন। ছবি : খবরের কাগজ

২০ জুলাই শনিবার, তখন কারফিউ জারি হয়েছে, অবস্থা শান্ত দেখে মিলন বেগম তার চৌদ্দ বছরের ছেলে মিরাজকে ঘরের পাশের সবজির দোকানে পাঠান কাঁচা মরিচ আর ধনেপাতা কিনতে। ঘর থেকে বের হয় মিরাজ। কিন্তু কিছুদূর যেতেই গুলি লাগে তার শরীরে। ঠিক বুঝতে পারে না মিরাজ কী হলো, অচেতন হয়ে পড়ে যায় রাস্তায়। পরে রাতে তাকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। দ্রুত রক্ত বন্ধ করে ভর্তি করা হয়। রবিবার অস্ত্রোপচারের পর এখন সার্জারি ওয়ার্ডে আছে সে। তবে আন্দোলনে না গিয়েও এমন আঘাতে এখনো আতঙ্কিত মিরাজ। তাই স্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে।

বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) সকালে সরেজমিনে ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা পাই মিরাজের। হাসপাতালের বেডে ছেলের শিহরে উদ্বিগ্ন মুখে বসে ছিলেন মা মিলন বেগম। তার কাছ থেকেই জানতে পারি মিরাজের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি।

মিরাজের মতো কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গুলিতে আহত আরও অনেকেই এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন ঢামেক হাসপাতালে। এদের একজন জিহাদ। গত শুক্রবার সে জুমার নামাজ পড়ে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল বন্ধুদের সঙ্গে। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে তার কোমরে। এরপর বেরিয়ে যায় পেট দিয়ে। রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে জিহাদ। তার বড় ভাই জাহিদ জানান, জিহাদের অবস্থা এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। তবে চিকিৎসকরা আশা করছেন আর কয়েক দিন পরে পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত হবে জিহাদ।

সার্জারি বিভাগের একই ওয়ার্ডে মিরাজের পাশের বেডে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন নার্গিস। তার পিকআপচালক স্বামী কাজল গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নার্গিস বলেন, পিঠ দিয়ে ঢুকে গুলি পেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। এখন একটু ভালো, আল্লাহই বাঁচাইছে...।

তিনি জানান, ফকিরাপুল থেকে যাত্রাবাড়ী দিয়ে যাচ্ছিলেন কাজল। রাস্তায় গোলমাল দেখে গাড়ি থামিয়ে একটু এগিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন যে সামনে আর যাওয়া ঠিক হবে কি না। কিন্তু সামনে এগোনোর আগেই গুলি লাগে কাজলের শরীরে। কে বা কারা গুলি করেছে তা বলতে পারেননি কাজল।

ঢামেক হাসপাতালের কেবল সার্জারি বিভাগের ৬টি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায় প্রতি ওয়ার্ডে গড়ে ৫ থেকে ৭ জন রোগী ভর্তি আছে গুলিবিদ্ধ হয়ে।

বৃহস্পতিবারের প্রতি ওয়ার্ডের হিসাব বলছে, বেলা ১১টা পর্যন্ত ২১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ২৭টি সিটের বিপরীতে আছে ৫৬ জন রোগী, ২১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ২৮টি সিটের বিপরীতে রোগী আছেন ৫০ জন, ২১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৩০ সিটে রোগী আছেন ৪১ জন, ২১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৩০ সিটে রোগী আছেন ৩৪ জন, ২১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৫টি সিটের বিপরীতে রোগী ৪৬ জন, ২২০ নম্বর ওয়ার্ডে ৩১টি সিটের বিপরীতে রোগী আছেন ৪৩ জন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন নার্স খবরের কাগজকে বলেন, আমরা প্রতি সিটের বিপরীতে ৪ জন করে রোগীকে সেবা দিচ্ছি। পরিস্থিতির কারণে রোগী বেশি। সুতরাং সবাইকে সেবা তো দিতেই হবে। এখন আমাদের নতুন রোগী ভর্তি নেওয়ার সময় তাই কিছুক্ষণ পর রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে।

সব নথি পুড়ে ছাই, লুণ্ঠিত ৪৬ অস্ত্র নিয়ে উৎকণ্ঠা

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:১০ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:১০ পিএম
সব নথি পুড়ে ছাই, লুণ্ঠিত ৪৬ অস্ত্র নিয়ে উৎকণ্ঠা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা, ভাঙচুর, ফটক ভেঙে বন্দি পালানো ও লুটপাটের ঘটনায় দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে ছাই কারাগারের সব নথি। গত চার দিনে পলাতক ৮২৬ বন্দির মধ্যে ৪৬৮ জন আত্মসমর্পন করেছেন বা থানাপুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন। লুট হওয়া ৮৫ অস্ত্রের মধ্যে ৩৯টি, ১ হাজার গুলি ও অনেক হাতকড়া উদ্ধার করা হয়েছে। নাশকতার ঘটনায় কারাগারের ১১ কোটি ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কারা অধিদপ্তর সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। 

সূত্র অনুসারে, দেশের ইতিহাসে এর আগে এমনভাবে কোনো কারাগার থেকে সব আসামি পালানো ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি।

এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে দেশের সব কারাগারে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ র‌্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি কারাগারগুলোতে সেনা টহল  অব্যাহত রয়েছে। 

কারা সূত্র জানায়, এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে বিচার বিভাগীয় দুটি তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে যুগ্ম সচিব ফারুখ আহম্মেদকে প্রধান করে ৬ সদস্যের কমিটি ও কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমানকে প্রধান করে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া নরসিংদী কারাগারের জেল সুপার, জেলারসহ সেখানে দায়িত্বরত সবাইকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ওই কারাগারে এখন দায়িত্ব পালন করছেন নতুন একজন জেল সুপার ও দুজন ডেপুটি জেলার। অগ্নিকাণ্ডের ফলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে নরসিংদীর কারাগারটি। সেখানে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। 

সূত্র আরও জানায়, ১৫ হাজার সন্ত্রাসী হামলা চালায় কারাগারে। পালিয়ে যাওয়া ৮২৬ জন কয়েদির মধ্যে ছিল ৯ জন জঙ্গি ও হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। এদের অনেকে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। কারাগারে হামলার প্রাথমিক কারণ হিসেবে জানা গেছে, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে যে নাশকতা চলছিল তাতে অস্ত্র ও বন্দিদের ব্যবহার করা।

এ ঘটনায় ২৩ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগার পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া দেশকে বিপর্যস্ত করতে এ আক্রমণ হয়েছে। নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের ধরে আইনের আওতায় আনতে যা যা করা দরকার সরকার সবই করবে। নরসিংদী কারাগারের যে জায়গাকে আমরা সেফ জোন মনে করি, সেখানে তারা ভাঙচুর তো করেছেই, অগ্নিসংযোগও করেছে। অস্ত্রাগার লুট করেছে। যেসব জঙ্গি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল, আমাদের পুলিশ বাহিনী যাদেরকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আটক করেছিল, এখান থেকে তাদেরকে সন্ত্রাসীরা মুক্ত করে নিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘তাদের উদ্দেশ্য দেশকে একটা বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়া। তাদেরকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কেন এই ঘটনা ঘটল, কারও গাফিলতি আছে কি না, কেউ এখানে সহযোগিতা করেছে কি না, এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তিন সদস্যের কমিটি করেছেন আইজি প্রিজন। আর ৬ সদস্যের কমিটি করেছে সুরক্ষা সেবা বিভাগ। যদি কারও গাফিলতি থাকে, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’

এ বিষয়ে গতকাল দুপুরে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘কারাগারের ফটক ভেঙে বন্দি ও অস্ত্র লুটের ঘটনা দেশের ইতিহাসে নেই। বিষয়টি নিয়ে আমরা বিব্রত। এখনো উদ্ধার হয়নি ৪৬টি অস্ত্র। এ নিয়ে আমরা উৎকণ্ঠায় রয়েছি। এ ধরনের ঘটনা আর যেন না ঘটে সে জন্য দেশের কারাগারগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি সেনা টহল অব্যাহত রয়েছে।’

নথি পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় তিনি বলেন, ‘আগুন দেওয়ায় কারাগারের সব নথি পুড়ে গেছে। এখন আসামিদের ডিজিটাল যে ডেটাবেজ তৈরি করা হয়েছে সেই তথ্যের ভিত্তিতে মামলা ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় মামলা হয়েছে ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত চলছে, এই সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে তাদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া হবে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।’ 

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ১৯ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় কারাগারে অগ্নিসংযোগ ও সেলের তালা ভেঙে ৯ জঙ্গিসহ ৮২৬ কয়েদি পালিয়ে যান। পাশাপাশি অস্ত্র-গোলাবারুদ ও খাদ্যপণ্য লুট এবং ব্যাপক ভাঙচুর করেন হামলাকারীরা। এতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় নরসিংদী জেলা কারাগার। 

‘বাবা তুই বেঁচে আছিস এটাই বড় পাওয়া’

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৫০ এএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০৫:২৬ পিএম
‘বাবা তুই বেঁচে আছিস এটাই বড় পাওয়া’
বাড্ডা এলাকায় সহিংসতায় পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থী রিফাতের একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। ছবি: খবরের কাগজ

গুলি লাগায় মো. রিফাত হাওলাদারের ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছে। হঠাৎ এক পা হারিয়ে এখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে তাকে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কথা বলতে বলতেই গলা জড়িয়ে আসে তার। দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে পানি।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার আলাতুন্নেছা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এই ছাত্র বলছিল, ‘এখন আমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলার মাঠে থাকার কথা। কিন্তু এক গুলিতেই আমার সব স্বপ্ন শেষ।’

ক্ষোভ ঝেড়ে বলে, ‘একদিন আমার এই পা সাক্ষী দেবে কত বড় অন্যায় হয়েছে আমার সঙ্গে। বড় হয়ে অফিসার কি আর হতে পারব?’ পাশে থাকা এই কিশোরের বাবা ট্রাভেলস ব্যবসায়ী মো. রিয়াজ ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে যারপরনাই দুর্ভাবনায় পড়েছেন। তবু সন্তানকে সাহস দিয়েছেন এই বলে যে, ‘কতজনের তো প্রাণ-ই চলে গেছে। তুই বেঁচে আছিস এটাই বড় পাওয়া।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর রামপুরা ও বাড্ডা রোডে সংঘর্ষের সময় গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রিফাতের পায়ে গুলি লাগে। পরে রিকশায় করে তাকে মেরুল বৌদ্ধ মন্দিরের কাছে এক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে নিয়ে যাওয়া হয় এএমজেড হাসপাতালে। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শে ভর্তি করা হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগে। 

বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) সরেজমিন এই হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগে গুলিবিদ্ধ ৩৬ জন ভর্তি রয়েছেন। এখানেই বেশির ভাগ আহতের চিকিৎসা চলছে। তাদের সবার শরীরের কোনো না কোনো অংশে গুলি লেগেছে। কমপক্ষে চারজনের পা অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়া আরও কয়েকজনের পা-হাত কেটে ফেলতে হতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। বাকিরা অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ক্যাজুয়ালটি-১, ক্যাজুয়ালটি-৩ বিভাগ ও নতুন ভবনেও কয়েকজন আহত ভর্তি আছেন বলে একজন নার্স জানান। 

ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগের ১৯ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন ১৬ বছরের মো. নাদিমও এক পা হারিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে একটি এমব্রয়ডারি কারখানায় কাজ করা নাদিম কাজ শেষ করে শনিবার বিকেলে বাসায় ফেরার পথে চিটাগাং রোডে তার পায়ে গুলি লাগে। পরে তিনটি হাসপাতাল ঘুরে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। তার মা মরিয়ম জানান, একটা গুলি ছেলের হাঁটুর মধ্য দিয়ে ঢুকে যায়। পুরো পায়ের মাংস কালো হয়ে পচন ধরায় সোমবার চিকিৎসকরা তার পা কেটে ফেলেন। এই কিশোরের মা আরও জানান, তার স্বামী অটোরিকশাচালক। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে নাদিম সবার বড়। মাসে ৭ হাজার টাকা আয় করত। দরিদ্র এই পরিবারের এখন চিকিৎসার খরচ চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।

কাঁদতে কাঁদতে মরিয়ম বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেটা এখন বেঁচে থেকেও মরার মতো। ওর জীবনের কোনো দাম আর নেই।’ 

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে এই হাসপাতালে এসেছে গুরুতর আহতরা। বিশেষ করে চিটাগাং রোড, কুড়িল, রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, নারায়ণগঞ্জ এলাকা থেকে আহতদের নিয়ে আসা হয়। আহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী ছাড়াও সিএনজিচালক, গাড়িচালক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন।

চিটাগাং রোড এলাকায় গত শনিবার (২০ জুলাই) সন্ধ্যায় গুলিবিদ্ধ হন সেলুনে কাজ করা রাকিব। এই কিশোরেরও বাম পা কাটতে বাধ্য হয়েছেন চিকিৎসকরা। অন্যদিকে পঙ্গুতে চিকিৎসাধীন ডেমরার দনিয়া এলাকার সিএনজিচালক মো. আমিরুল ইসলামের ডান পায়ে গত শনিবার গুলি লাগে। কোথা থেকে কীভাবে গুলি লাগল বুঝতেই পারেননি তিনি। ইয়াসিন নামের ১১ বছরের এক শিশু কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়। বাড্ডা-নতুনবাজার এলাকা থেকে ডান হাতে গুলি লেগে পঙ্গুতে ভর্তি আছেন মো. সজিব খান।

তিনি দাবি করেন, ‘পুলিশ আমাদের বলল এখন রাস্তা পার হতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই। এমন অবস্থায় কোথা থেকে গুলি এসে আমার হাতে লাগল, জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, এমন এলোপাতাড়ি গুলি করা হয়েছে যে রাস্তার পাগল, এমনকি কুকুরের মতো অবুঝ প্রাণীরাও এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেছে। আমি হাসপাতালে থাকায় আমার সাত বছরের সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে।’

ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ক্যাজুয়ালটি বিভাগ-১-এ ভর্তি টঙ্গীর মো. রাজুর মা জানান, ব্যথায় দিনরাত চিৎকার করছে তার ছেলে। এই প্রতিবেদককে উদ্দেশ করে প্রশ্ন রাখেন, ওর স্ত্রী, দুই বাচ্চার কী হবে এখন?

এদিকে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আহতদের তথ্য নিতে গতকাল দুপুরে হাসপাতালে যান পুলিশ সদস্যরা। তারা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, হাতের ছাপ নেওয়ায় আতঙ্ক দেখা দেয় আহত ব্যক্তি ও তাদের স্বজনদের মাঝে। 

নিটোরের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে এ পর্যন্ত আড়াই শর বেশি রোগী এসেছেন সহিংসতার ঘটনায় আহত হয়ে। এর মধ্যে বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তবে সবাই এখন শঙ্কামুক্ত। ছয়জনের পা কেটে ফেলতে হয়েছে।’

তিনি জানান, গুলিবিদ্ধ যারা এসেছেন তাদের মধ্যে ১৮ জুলাই আসা ১৭ জন শিক্ষার্থী। পরে যারা এসেছেন তাদের মধ্যে কোনো শিক্ষার্থী নেই।

কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে ইসির ৩০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০১:৩৩ পিএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৬:১৭ পিএম
কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে ইসির ৩০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প
নির্বাচন কমিশন (ইসি)

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বাড়াতে ২৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকার নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইসি। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের নাম এনহেন্সিং ইফিসিয়েন্সি অব এপ্লয়িজ অব ইলেকশন কমিশন সেক্রেটারিয়েট (ইইইইসিএস)। এর মূল লক্ষ্য- প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইসির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো। প্রকল্পের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয়েছে চলতি ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (ইটিআই) মাধ্যমে যেসব প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্ভব হয় না, সে ধরনের প্রশিক্ষণ আয়োজন করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। বিশেষ করে তাদের ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বাড়ানো, যাতে বিদেশে গিয়ে কমিউনিকেশন ও নেগোসিয়েশনের দক্ষতা বাড়ে। এ ছাড়া বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানোর নানা উদ্যোগ রয়েছে প্রকল্পে। ইসির প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্পটি বর্তমানে অনুমোদনের অপেক্ষায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। চলতি মাসে এটি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাস হওয়ার কথা রয়েছে।

প্রকল্পের জনশক্তি কেমন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই প্রকল্প পরিচালনায় ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে না। মোট জনবল থাকবে মাত্র ছয়জন। তার মধ্যে নতুন করে একজন হিসাবরক্ষক, একজন গাড়িচালক ও একজন অফিস সহকারী নিয়োগ দেওয়া হবে। বাকি পদগুলোতে কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারাই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন এবং এই কাজের জন্য তাদের বাড়তি সম্মানীও থাকবে না। 

এর আগে গত ৩০ জুন শেষ হয় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণ (এসসিডিইসিএস) প্রকল্পের কার্যক্রম। ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ওই প্রকল্পেরও মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। লক্ষ্য ছিল- প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেবার মান বাড়াতে কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানো এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা পেতে সাধারণ নাগরিকদের ভোগান্তি কমানো। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওই প্রকল্পের আওতায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্ষমতা বাড়াতে বিদেশে প্রশিক্ষণের ৫০ শতাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। 

ওই প্রকল্পের অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘প্রকল্পের ৯৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা আমরা পূরণ করতে পেরেছি। তবে প্রকল্প চলাকালে বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতিসহ নানা কারণে ১০০ জন কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানোর কথা থাকলেও সেখানে ৫০ জনকে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। আর নির্ধারিত বাজেটের তুলনায় ব্যয় সাশ্রয় হওয়ায় ১০ শতাংশ অর্থ উদ্ধৃত হয়েছে, যা ফেরত দেওয়া হয়েছে।’ ওই প্রকল্পের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারের নতুন প্রকল্প আরও বেশি কার্যকর ও সফল হবে, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন অতিরিক্ত সচিব। 

এ ছাড়া ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে ‘নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় আইসিটি ব্যবহারে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয় ইসি। গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া প্রকল্পটির পরিচালক করা হয়েছে সংস্থার প্রশাসন ও অর্থ শাখার যুগ্ম সচিব মো. মনিরুজ্জামান তালুকদারকে। এ ছাড়া পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও প্রকাশনা শাখার উপপ্রধান মুহাম্মদ মোস্তফা হাসানকে উপপ্রকল্প পরিচালক এবং সিনিয়র সহকারী প্রধান মো. রাজীব আহসানকে সহকারী প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি ৩৭ কোটি ৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকার এই প্রকল্পের ব্যয়ের ৪০টি খাত নির্ধারণ করা হয়। খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে প্রশিক্ষণে- ১৯ কোটি ৮৬ লাখ ১৭ হাজার টাকা। এরপর রয়েছে সেমিনার, আউটসোর্সিং এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি খাতের ব্যয়। প্রকল্পের অধীনে বর্তমানে নির্বাচন কমিশন কার্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ফলাফল ব্যবস্থাপনা সিস্টেম, স্মার্ট নির্বাচনি ব্যবস্থাপনা অ্যাপ, অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সিস্টেম, ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম, এনআইডি সার্ভার প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে সেবা ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের চেষ্টা করছে।

রোগীতে ঠাসাঠাসি জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০১:২৫ পিএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৪:২৯ পিএম
রোগীতে ঠাসাঠাসি জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

জালাল উদ্দীন বোন ক্যানসারের রোগী, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কথা বলছিলেন কেমোথেরাপি কবে দিতে পারবেন তা নিয়ে। তার কেমো দেওয়ার তারিখ ছিল গত ২০ ও ২১ জুলাই। কিন্তু চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে গত ২০ জুলাই শনিবার থেকে কারফিউ ও রবি-সোম-মঙ্গলবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় বন্ধ থাকে কেমোথেরাপি দেওয়ার কার্যক্রম। কারণ স্বাভাবিক সময়েও সাধারণ ছুটিতে এখানে কেমো দেওয়া বন্ধ থাকে। ফলে জালালের কেমো দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিন্তু বুধবার (২৪ জুলাই) পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় তিনি এসেছেন কেমো নিতে।

খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘আমার নিয়মিত কেমো চলছে। তাই হাসপাতালের পাশেই বাসা নিয়ে থাকি। এ জন্য আমার এখানে পৌঁছতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু কারফিউ ও সাধারণ ছুটি থাকায় কেমো দেওয়া হয়নি।’ গতকাল দুপুরে রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চলমান আন্দোলনের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জালালের মতো অনেকেই পড়েছেন নানা ভোগান্তিতে। কেউ সেবা নিতে ঢাকার বাইরে থেকে হাসপাতালে আসতে পারেননি সময়মতো, আবার কারও চিকিৎসা শেষ হলেও বাড়ি ফিরতে পারেননি।

তেমনই একজন ফরিদপুরের বাসিন্দা কাদের মোল্লা, আক্রান্ত ফুসফুসের ক্যানসারে। চিকিৎসা নিতে ভর্তি ছিলেন এই হাসপাতালে, দুই দিন আগে ছুটি দিলেও চলমান পরিস্থিতির কারণে তিনি যেতে পারেননি বাড়িতে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘শুনলাম এখন বাস চলছে, এখন বাড়ি যাব।’ 

অন্যদিকে পায়ের টিউমার থেকে ক্যানসার হয়েছে সিলেটের কিশোর সালমান খানের। অবরোধ, কারফিউ আর সাধারণ ছুটির কারণে গতকাল রাতে এই হাসপাতালে এসে পৌঁছলেও এখনো তার চিকিৎসা ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। আর পরীক্ষা চলার সময় তাকে ভর্তিও করা হচ্ছে না। তাই হাসপাতালের কোরিডরে ঠাঁই নিয়েছে সে ও তার পরিবার। 

হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক ডা. আশফিকা জিনি বলেন, ‘আমাদের জরুরি বিভাগে আজ (বুধবার) সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ৪৮ ঘণ্টা একজন ডাক্তারই ডিউটি করেছেন। কারণ তিনি বাসায় ফিরতে পারছিলেন না। আবার অন্য কেউ ডিউটিতে আসতেও পারছিলেন না। তবে এখন সব স্বাভাবিক।’ তিনি জানান, বুধবার (২৪ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ২২ জন রোগী এসেছেন জরুরি বিভাগে।

হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সাতটি অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। ফলে সাতজন আছেন পোস্ট-অপারেটিভে। মহিলা ওয়ার্ডগুলোতে পেইড-আনপেইড মোট ১২১টি সিটে রোগী আছেন ১১৬ জন। অন্যদিকে পুরুষ ওয়ার্ডগুলোতে মোট ১২২টি সিটের বিপরীতে ভর্তি আছেন ১০৬ জন। জানা গেছে, সাধারণ ছুটিতে তিন দিন বন্ধ ছিল ডে-কেয়ার কেমোথেরাপি ও আউটডোর। গতকাল থেকে আবার সব কার্যক্রম চালু হয়েছে।