![ইসরায়েল-ইরান পরিস্থিতি: সংকটের শঙ্কা বাংলাদেশেও](uploads/2024/04/16/1713248044.Iran,-israil.jpg)
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধকল এখনো বাংলাদেশসহ বিশ্ব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এমন একটি পটভূমিকায় আবারও মধ্যপ্রাচ্যে বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধের ব্যাপ্তি বাড়লে বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও মূল্য দিতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ভুগছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে বেশ কয়েকবার সতর্ক করেছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা নির্ভর করছে যুদ্ধ কতটা ছড়িয়ে পড়ে সেটার ওপর। যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং অন্যান্য দেশ এতে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে নিঃসন্দেহে বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর উদ্বেগের ব্যাপার হবে। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ করেছি তেলের দাম কিছুটা বাড়তি। সমুদ্রপথ যদি বিপদসংকুল হয়ে যায়, তাহলে জাহাজে করে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে তেলের দাম অবশ্যই বাড়বে। যুদ্ধ বাড়লে আমাদের জনশক্তি খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং সম্ভাব্য সংকট উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু গতকাল সোমবার সচিবালয়ে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ে ঈদে স্বস্তি ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় অস্বস্তিতে আছি। কারণ আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব বাজারে পড়বে। এসব চ্যালেঞ্জ যাতে বাজারে না আসে, সেটা মোকাবিলা করতে হবে।’
যদিও অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত খবরের কাগজকে বলেন, ‘যতটা ভয়ের কারণ বলা হচ্ছে আমার মনে হয় না বেশি কিছু হবে। এই হামলা দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ইরান সীমিত আকারে কিছু অভিযান চালিয়েছে। ইসরায়েল হয়তো এর জবাব দেবে। কিন্তু খুব বড় ধরনের যুদ্ধ বেধে যাবে, এমন কিছু হবে না। বিশ্বের কোনো দেশ এই যুদ্ধ চাইবে না। আমার মনে হয় না উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু আছে। যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তা হলে অর্থনীতির ক্ষতি তো হবেই, পাশাপাশি পুরো বিশ্বের অস্তিত্ব নিয়ে সমস্যা হবে। কারণ যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মুশকিল। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে উদ্বিগ্ন নই। সবাই বোঝে যে যুদ্ধ বেধে গেলে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে। এই ঝুঁকি কেউ নিতে চাইবে না। তবে আপাতত আমি ভয়ের কোনো কারণ দেখছি না।’
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
ইসরায়েলে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার পর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য খাদের কিনারে। এ অঞ্চলের মানুষ একটি পূর্ণমাত্রার ধ্বংসাত্মক সংঘাতের মুখোমুখি। তারা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এখনই সময় তাদের খাদের কিনার থেকে ফিরিয়ে আনার। আর এ দায়িত্ব যৌথভাবে সবার।
ইরানের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের যুদ্ধবিষয়ক বিশেষ মন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে। বৈঠকের পর তারা জানিয়েছে যে ইরানে পাল্টা হামলা চালাবে।
মার্কিন প্রশাসন যদিও বলছে তারা ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ইরানে হামলা চালাবে না, তার পরও আশঙ্কা কাটছে না। কারণ ইসরায়েলকে পূর্ণমাত্রায় সহযোগিতা দিচ্ছে দেশটি। ইতোমধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ কংগ্রেসে পাস করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো পরাশক্তিগুলো ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় দেশ তিনটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে তেহরান।
গত শনিবার রাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের ‘বিশাল ঝাঁক’ ছোড়ে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের ৯৯ শতাংশ আকাশে ধ্বংস করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। যদিও ইসরায়েলের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে ইরানি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, তাদের হামলা শতভাগ সফল হয়েছে।
এর আগে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করে ইসরায়েল। হামলার ব্যাপারে ইসরায়েল কিছু না বললেও যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এই হামলা ইসরায়েল করেছে। নিহত ১১ জনের মধ্যে ইরানের শীর্ষস্থানীয় একজন কমান্ডারও রয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘যদিও আপাতত মনে হচ্ছে না যুদ্ধ বাড়বে, তার পরও এটা আমেরিকার নির্বাচনের বছর। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রচার চালাতে পারেন যে জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যে হেরে গেছেন। এ ধরনের একটা সিচুয়েশন তৈরি হলে বাইডেন যুদ্ধে জড়াতে পারেন। ইতোমধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ পাস করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।’
এক প্রশ্নের উত্তরে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবই আমরা এখনো কাটাতে পারিনি, তারপর যদি এই যুদ্ধ বাড়ে তাহলে অবস্থা ভয়ানক হবে।’
ইতোমধ্যে অপরিশোধিত তেলের বাজারে মন্দাভাব শুরু
ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের বাজারে মন্দাভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তেলের দাম কিছুটা বাড়তি। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানায়, বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি তেলের বৃহত্তম জোগান আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। তাই ওই অঞ্চলে অস্থিরতা শুরু হলে জ্বালানি তেলের সরবরাহ রুটে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। ফলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে এবং সেই অস্থিতিশীলতার প্রাথমিক লক্ষণ হলো সোমবারের মন্দাভাব।
অপরিশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে ইরান গুরুত্বপূর্ণ বিক্রেতা দেশ। জ্বালানি তেলের উত্তোলন ও বিপণনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাসের অন্যতম এই সদস্যরাষ্ট্র নিজেদের খনিগুলো থেকে প্রতিদিন কমবেশি ৩০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল উত্তোলন করে।
জ্বালানি পণ্যের বাজার বিশ্লেষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যানার্জি আসপেক্টসের কর্মকর্তা অমৃতা সেন বলেন, ‘যদি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা না কমে, তাহলে তার প্রভাব বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজারে পড়বে- তা খুবই স্বাভাবিক… এবং এই প্রভাবের মাত্রা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়েও অনেক বড় হবে।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘যুদ্ধ যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে। আগামী দিনগুলোতে নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব কতটুকু হবে সেটা যুদ্ধের ব্যাপ্তি কেমন হয় সেটার ওপরে নির্ভর করছে। সেটার জন্য আমাদের আরও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ইরানের মধ্যে সংযম দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও সংযত। দেখা যাক কী হয়।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যদি পরিপূর্ণ যুদ্ধ লাগে তাহলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে বিশ্বের তার শতগুণ বেশি ক্ষতি হবে। ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয় তাহলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি পরিবহনে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। সেই ক্ষতি সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও পোহাতে হবে। এখন পর্যন্ত যদিও মনে হচ্ছে না পরিপূর্ণ যুদ্ধ লাগবে কিন্তু এটা বলা মুশকিল।’
বাংলাদেশে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব সারা বিশ্বে পড়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব হয়েছে সুদূরপ্রসারী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অস্থির হয়ে ওঠে জ্বালানি তেলের বাজার। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হতে থাকে। মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া হয়ে যায়। ঝুঁকিতে পড়ে যায় খাদ্যনিরাপত্তা। অবস্থা এমন হয় যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে সতর্ক করেন। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশ যেহেতু গমের বিশাল রপ্তানিকারক দেশ, তাই যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের গমের বাজার অস্থির হয়ে পড়ে। ভারতও গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ ক্যালরি গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রায় ৬৮ শতাংশ চালের ওপর নির্ভর করে এবং প্রায় ৭ শতাংশ জোগান আসে গম থেকে। যুদ্ধের আগে যে প্যাকেটজাত আটার দাম কেজিপ্রতি ছিল ৩২ থেকে ৩৫ টাকা, সেটি বেড়ে হয়েছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা।
শুধু গম নয়, যুদ্ধের কারণে ভোজ্যতেলের বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে বছরে ২০ লাখ টনের মতো ভোজ্যতেল লাগে। এর মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদন হয় দুই থেকে তিন লাখ টন। আর বাকিটা অর্থাৎ চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করতে হয় আমদানি করে। এর পাশাপাশি যুদ্ধের কথা বলে ব্যবসায়ীদের সুযোগ নেওয়ার একটা বিষয় লক্ষ করা গেছে। এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গমের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের দামও প্রতিবেশী যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি হারে বেড়েছে। এই দাম বাড়ার কারণ চালের সরবরাহ ঘাটতি নয়। ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন বলেই আমার ধারণা। খাবারের দাম বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে মানুষের জন্য জীবনধারণ ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে।’
যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের মানুষের আমিষ গ্রহণের হার অনেক কমে গেছে। এ ক্ষেত্রে মুরগির খাবারের দাম বাড়ানোকে দায়ী করা হচ্ছে। বাংলাদেশে মুরগির খাবারের ৬০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে ভুট্টা। বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ১৬ শতাংশ ভুট্টা সরবরাহ করে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে তীব্র সারের সংকট দেখা দেয়। যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সার কারখানাগুলোতে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে। যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশে তখন সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। তেলের কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় একই পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বাড়তি ডলার খরচ করতে হচ্ছে অর্থাৎ আমদানি ব্যয় বেড়েছে।
কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি না বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি করে। যে কারণে ডলারসংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি।
এ ছাড়া হুমকিতে পড়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি। যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের অর্থনীতিতে একটি মন্দাভাব চলে আসায় ইউরোপীয়দের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে বাংলাদেশে নতুন অর্ডারের হারও কমেছে।