একদিকে অপর্যাপ্ত পরিষেবা কক্ষ, যথাযথ চিকিৎসাসরঞ্জামের স্বল্পতা, আবাসনের খারাপ অবস্থা, রোগীদের সুযোগ-সুবিধার অভাব, স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব, ল্যাবরেটরি পরিষেবার অভাব, অতিরিক্ত কাজের চাপ, অন্যদিকে নিরাপত্তার অভাব এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকদের অযাচিত চাপ, উচ্চশিক্ষা, পদায়ন, বদলি, পদোন্নতিসংক্রান্ত নীতির যথাযথ প্রয়োগের অনুপস্থিতি সরকারি পর্যায়ের উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে কর্মস্থলের বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন স্ব স্ব জায়গায় কর্মরত চিকিৎসকরা।
গত বুধবার (১৭ এপ্রিল) স্বাস্থ্য গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল ল্যানসেটের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংস্করণে এ-সংক্রান্ত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে আসে।
এই গবেষক টিমের অন্যতম সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. খালেকুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ইনফরমেটিক্স বিভাগ ২০২১ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে দেশের ১৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ৯টি জেলা হাসপাতালের ৫১ জন চিকিৎসকের ওপর এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
ওই গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হাসপাতালের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাগুলো ডাক্তারদের জন্য তাদের কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রচলিত চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত। এ ছাড়া দুর্বল অবকাঠামো, যথাযথ চিকিৎসা সরবরাহের স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় ওষুধের সীমিত সরবরাহ, ডায়াগনস্টিক সুবিধার অভাব, কর্মীদের অভাব এবং অতিরিক্ত কাজের চাপ বড় সমস্যা তৈরি করে।
এতে বলা হয়, হাসপাতালে চিকিৎসকদের পরামর্শ কক্ষ বা জরুরি কক্ষগুলো সাধারণত ছোট, যথাযথ প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাব এবং সব সময় রোগীর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উপচে পড়া ভিড় থাকে। কখনো কখনো, দুই বা ততোধিক মেডিকেল অফিসারকে একই রুম ভাগ করে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে হয়। রোগীর গোপনীয়তা রক্ষা করা যায় না। বসার এবং বিশ্রামের জায়গা অপ্রতুল।
এ ছাড়া রোগীদের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ চিকিৎসাসরঞ্জাম এবং প্রযুক্তির অভাব গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। একইভাবে কিছু হাসপাতালে শুধু কয়েকটি সাধারণ ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা করা হয়। অনেক হাসপাতালে ত্রুটিপূর্ণ আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন, এক্স-রে মেশিন এবং প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের কথাও উঠে আসে এই গবেষণায়।
পাশাপাশি হাসপাতালের প্রতিটি স্তরে কর্মীসংকট দেখা যায়। এতে ডাক্তার, নার্স, প্যাথলজিস্ট, ল্যাব টেকনোলজিস্ট, অফিস সহকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কোনো হাসপাতালেই পর্যাপ্ত সংখ্যক মেডিকেল অফিসার পাওয়া যায়নি। যেখানে রোগীর ভিড় অনুযায়ী নিয়োগ করা হয়নি, যার ফলে উপস্থিত জনবলের জন্য অতিরিক্ত কাজের চাপ ছিল। কিছু হাসপাতালে সুসজ্জিত ল্যাবরেটরি ছিল কিন্তু উপযুক্ত সোনোলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট এবং প্যাথলজিস্টের অভাব ছিল।
এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী প্রায় সব চিকিৎসক অত্যধিক কাজের চাপের কথা বলেন। তারা যথাযথ বিরতি বা ডিউটি রোস্টার ছাড়াই দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত কাজ করার কথা জানাতে গিয়ে উত্তেজিত ছিলেন। লোকবলের অভাবে অনেক ডাক্তার পরপর সকাল এবং সন্ধ্যা উভয় শিফটে কাজ করেন।
কোনো কোনো হাসপাতালে একজন ডাক্তার তিনজন ডাক্তারের সমান দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে, ডাক্তারদের অতিরিক্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব মোকাবিলা করতে হয়েছিল, যা তারা অত্যন্ত বিরক্তিকর বলে মনে করেছিল। তাদের দৈনন্দিন কাজের জীবনে অবাঞ্ছিত প্রভাবের পাশাপাশি, তাদের বর্তমান কাজের চাপও তাদের কর্মজীবনের অগ্রগতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
হাসপাতালগুলোতে বিদ্যুৎ, পানি, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস ইত্যাদির সীমিত সুবিধা রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্ন ঘটায় হাসপাতালের দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পানির সংযোগ থাকলেও তারা পানি ট্যাঙ্কে তুলতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহারে উচ্চ বিদ্যুতের বিলের ভয়ে ভীত থাকে। বিদ্যুতের বিলের উচ্চ ব্যয় তাদের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ ব্যবহার করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে বিশুদ্ধ পানীয়জলের অভাবও রয়েছে।
যদিও বেশির ভাগ উত্তরদাতা হাসপাতালে ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহের কথা উল্লেখ করেছেন। তবুও তারা বলেছেন, সংকটে ওষুধগুলো সবসময় সহজলভ্য থাকে না।
অন্যদিকে রাজনৈতিক চাপ, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রতিকূলতা এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাবের কারণে চিকিৎসকদের পেশাগত ঝুঁকির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বেশির ভাগ উত্তরদাতা। প্রভাবশালীদের দাবির মধ্যে ছিল অগ্রাধিকারভিত্তিক চিকিৎসা প্রদান, তাদের আত্মীয় ও বন্ধুদের জন্য প্রশাসনিক বিষয় পরিচালনা করা এবং অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রদান করা।
রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে সহায়ক কর্মী নিয়োগের বিষয়টিও কয়েকজন ডাক্তার উল্লেখ করেছেন। নিরাপত্তার অভাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্রে ডাক্তারদের সহিংসতার সমস্যাটি সব স্তরের উত্তরদাতারা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেন। তারা বেশ কয়েকবার রোগীর স্বজনদের মাধ্যমে শারীরিক ও মৌখিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
চিকিৎসকদের ক্যারিয়ারের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে গবেষণার প্রায় সব অংশগ্রহণকারীই সোচ্চার ছিলেন। উচ্চশিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত নীতিগুলোর প্রতি তাদের অসন্তোষ। উত্তরদাতাদের মধ্যে কয়েকজন কর্মক্ষেত্রে তাদের জ্ঞান প্রয়োগের সুযোগের অপর্যাপ্ততার কথা উল্লেখ করেছেন, যা তারা বিভিন্ন বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং কোর্স থেকে পেয়েছেন। পরিবর্তে, তাদের অন্য বিভাগে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যেখানে তাদের অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ তারা পাননি।
উত্তরদাতারা বদলি ও পদায়নসংক্রান্ত নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রায় সব উত্তরদাতাই একমত যে, স্থানান্তরের সমস্যাটি রাজনৈতিক লবিং দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে বৈষম্য, সমমানের গ্রেডে অন্যান্য বিসিএস ক্যাডারদের তুলনায় কর্মপরিবেশের বৈষম্য এবং পেশাগত বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে চিকিৎসকরা তাদের হতাশা প্রকাশ করেন। তারা মনে করেন, যোগদানের প্রথম দিন থেকেই তাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হচ্ছে। অনেক ডাক্তার উল্লেখ করেছেন যে, তারা ১০-১২ বছর সিনিয়র মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করার পরও পদোন্নতি পাননি, যেখানে অন্যান্য ক্যাডার পরিষেবাগুলোতে, তাদের নিয়মিতভাবে, প্রতি কয়েক বছর পরপর (ক্যাডার অনুসারে পরিসীমা পরিবর্তিত হয়) সময়সূচি অনুসারে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
এ ছাড়াও মেডিকেল অফিসারদের জন্য মানসম্মত বাসস্থানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
রাজধানী বা বড় শহর থেকে দূরে কর্মক্ষেত্রে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় তাদের সামনে আরেকটি সাধারণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, তাদের সন্তানদের জন্য মানসম্পন্ন স্কুলিং সুবিধা নিশ্চিত করা।