দেশের অন্যান্য এলাকার মতোই উত্তরাঞ্চলেও বোরো মৌসুমে বৃষ্টি কম হয়েছে এবার। প্রতি বিঘায় এলাকাভেদে সেচ খরচ বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। তীব্র তাপের কারণে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁসহ আরও কয়েকটি জেলার বিভিন্ন এলাকায় এবার ধানের রোগবালাই কম হওয়ায় ফলন ভালো, বলছেন চাষিরা। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলসহ কয়েকটি উপজেলায় ধানের ফলন কম হবে বলে তাদের আশঙ্কা।
বগুড়া আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র অবজারভার মো. নূরুল ইসলাম জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর এপ্রিল ও মে মাসে বৃষ্টি হয়েছে অনেক কম। গত বছর এপ্রিলে বগুড়ায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৬০ মিলিমিটার। মে মাসের প্রথম পাঁচ দিনে বৃষ্টি হয়েছিল ৭ মিলিমিটার। এ বছর এপ্রিলে কোনো বৃষ্টি হয়নি। মে মাসের পাঁচ দিনে বৃষ্টি হয়েছে ১০ মিলিমিটার। তিনি আরও বলেন, গত এপ্রিলে অধিকাংশ দিনেই বগুড়ায় তাপমাত্রা ছিল ৩৫ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। একদিন সর্বোচ্চ রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র অবজারভার মো. রহিদুল ইসলাম জানান, গত বছর এপ্রিল মাসে রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ৪৮ দশমিক ৮ মিলিমিটার। এ বছর এপ্রিলে কোনো বৃষ্টিই হয়নি। তবে মে মাসের শুরুর দিকে এক রাত্রিতে মাত্র ৩০ সেকেন্ড বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পরিমাণ কত ছিল, তার রেকর্ড নেই। রাজশাহীতে ১০৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় গত বছরের মে মাসে।
বগুড়ার অন্যতম ধান উৎপাদনকারী এলাকা নন্দীগ্রাম। এ উপজেলার পাঠান মির্জাপুর গ্রামের চাষি জামাল উদ্দিন তার চার বিঘা জমিতে এবারও চাষ করেছেন সুগন্ধি কাটারিভোগ। তীব্র দাবদাহে তাকে সেচ নিশ্চিত করতে এবার বিঘায় অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ৩০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘গত বছর চার বিঘা জমিতে সুগন্ধি কাটারিভোগ চাষে সেচ বাবদ ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৪ হাজার ২০০ টাকা। এবার সেচে খরচ হয়েছে ৫ হাজার ১০০ টাকা। অর্থাৎ বিঘায় সেচে বাড়তি ব্যয় প্রায় ৩০০ টাকা।’ ধানের ফলন কেমন হয়েছে- এ প্রশ্নের উত্তরে জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ধানের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ফলন ভালো হবে।’
একই এলাকার সেচযন্ত্রের মালিক লুৎফর রহমান বলেন, ‘এবার বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতে খরচ বেড়েছে গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। তাই সেচের খরচও বেড়েছে। গত বছর বিঘায় সেচ খরচ নেওয়া হয় ১ হাজার ১৫৫ টাকা। এ বছর নেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৩২০ টাকা।’ তিনি দাবি করেন, তীব্র খরার কারণে তাকে মেশিন চালাতে হচ্ছে অনেক বেশি সময়।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাঝিড়া গ্রামের শ্যালো মেশিন মালিক আশিকুল ইসলাম টুটুল তার স্কিমে এবার ডিজেলচালিত দুটি মেশিন বসিয়ে সেচ দিচ্ছেন ৩৬ বিঘা জমিতে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ-চালিত আরেকটি অগভীর শ্যালো মেশিনে সেচ দিচ্ছেন ২০ বিঘায়। তিনি বলেন, ‘গত বছর এক বিঘায় পুরো বোরো মৌসুমে সেচ দিতে লাগত ৩২ লিটার ডিজেল। এ মৌসুমে এলাকাভেদে লাগছে ৬২ থেকে ৬৫ লিটার পর্যন্ত। কিন্তু তার পরও খুশি করা যাচ্ছে না জমির মালিকদের। কারণ মেশিনে পানি উঠছে কম।’ সিরাজগঞ্জের এ উপজেলায় এবার প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার বিঘায় বোরো ধান আবাদ হয়েছে। গড়ে ফলন পাওয়া যাচ্ছে ২৩ মণ। উচ্চফলনশীল জাতের ধানের ফলন আরও বেশি। বিঘায় হচ্ছে ৩০ মণ পর্যন্ত। গত বছর তাড়াশ এলাকায় বৃষ্টি আর পানিতে খেত ডুবে গিয়েছিল। সে কারণে অনেক এলাকাতেই ধানের ফলন হয়েছিল কম।
উত্তরাঞ্চলের যেসব এলাকায় তীব্র দাবদাহের কারণে ধানের ক্ষতি হয়েছে, তার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার ফতেপুর এলাকা অন্যতম। কথা হয় ওই গ্রামের চাষি বিপদ ভঞ্জনের সঙ্গে। তিনি জানান, দীর্ঘ সময় কোনো বৃষ্টি না হওয়ায় ধান নষ্ট হয়ে গেছে। ফলনও কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘খরায় ধান মরে গেছে অনেক এলাকায়। এ কারণে ফলন কম হবে। আমার ধারণা, গত বছর যে জমিতে বিঘায় ২০ থেকে ২২ মণ পর্যন্ত ধান পাওয়া গেছে, সেখানে এবার ১৬ থেকে ১৭ মণের বেশি পাওয়া যাবে না। যেসব জমিতে ধান মরে গেছে, সেখানে ফলন হবে আরও কম, ৮ থেকে ১০ মণের মধ্যে।’ তিনি জানান, বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এবার পানি কিনতে হয়েছে ১১০ টাকা ঘণ্টা। তিনি দাবি করেন, মাটির নিচ থেকে পানি কম ওঠায় ১ ঘণ্টার জায়গায় সেচ দিতে হয়েছে ২ ঘণ্টা পর্যন্ত। এ কারণে সেচে ব্যয় বেড়েছে।
উত্তরাঞ্চলের যেসব এলাকা খাদ্য উদ্বৃত্ত, তার মধ্যে জয়পুরহাট অন্যতম। এ জেলার অধিকাংশ এলাকায় আলুর পর লাগানো হয় বোরো ধান। কিন্তু তীব্র দাবদাহের কারণে এবার ধানে সেচ দিতে হচ্ছে অনেক বেশি। কথা হয় ক্ষেতলাল উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের গভীর নলকূপের মালিক নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, দুটি গভীর নলকূপ থেকে তিনি সেচ দিচ্ছেন ২৩৫ বিঘায়। গত বছর তার স্কিমে নিচু এলাকার যেসব জমিতে সেচ দিতে হয়েছিল ৯ বার, এবার সেখানে এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ১১ বার। আরও দিতে হবে। উঁচু এলাকার জমিতে সেচ দিতে হয়েছে এলাকাভেদে ১০-১১ বার। এবার এখন পর্যন্ত কোনো কোনো জমিতে সেচ দেওয়া হয়েছে ১৪ বার পর্যন্ত। আরও দিতে হবে।
নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে হিসাব করেছি, তাতে দেখা যায় গত বছরের তুলনায় বিদ্যুৎ বিল বেশি দিতে হচ্ছে ৩০ শতাংশ। এ অবস্থায় চাষিদের বিঘায় খরচ বাড়বে কমপক্ষে ২০০ টাকা।’ ক্ষেতলাল উপজেলার মুন্দাইল গ্রামের চাষি মাজহারুল ইসলাম জানান, ‘এবার বিঘায় সেচ খরচ বেড়েছে ২০০ টাকা। গত বছর ছিল ২ হাজার টাকা। এবার সেখানে নেওয়া হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকা। এই দরে পানি কিনে আমি ১০ বিঘা জমিতে গোল্ডেন আতপসহ দুই ধরনের আতপ ধান চাষ করেছি।’
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদিপুর ইউনিয়নের গোকুল গ্রামের চাষি সুব্রত কুমার জানান, ‘গত বছরের তুলনায় এবার চাষাবাদে খরচ বেড়েছে। পানিতেও বিঘায় খরচ বেড়েছে গড়ে ২০০ টাকা। গত বছর তিন বিঘায় সেচ দিতে আমার ব্যয় হয়েছিল ৩ হাজার টাকা। এবার ব্যয় ৪ হাজার টাকা।’
দিনাজপুর হাইড্রোলজি সাব-ডিভিশনের একটি সূত্র জানায়, রংপুরের অধিকাংশ এলাকাতেই এপ্রিল মাসে বৃষ্টি হয়নি। মে মাসেও এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য বৃষ্টির রেকর্ড নেই। তবে তিস্তায় পানির প্রবাহ গত বছরের তুলনায় বেশি। ওই সাব-ডিভিশনের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের ৬ এপ্রিল ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার নদীতে পানির প্রবাহ ছিল ৫ হাজার ২৩০ কিউসেক। এ বছর ৬ এপ্রিলে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫ হাজার ৩০৫ কিউসেক। গত বছর মে মাসের ৬ তারিখে ডালিয়া পয়েন্ট তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৪ হাজার ৪০০ কিউসেক, এ বছর ৫ মে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫ হাজার ৪০০ কিউসেক।
পাবনার ঈশ্বরদীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মায় পানির প্রবাহ কমেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানায়, গত বছরের ১৫ এপ্রিল ওই পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল ৩৬ হাজার ৬০০ কিউসেক। এ বছর একই দিন একই পয়েন্টে প্রবাহ ছিল ৩১ হাজার ৯১ কিউসেক। ওই একই পয়েন্টে গত বছর মে মাসের ২ তারিখে পানির প্রবাহ ছিল ৩৯ হাজার ১২ কিউসেক। এ বছর ২ মে সেখানে পানির প্রবাহ ১ হাজার ১৬২ কিউসেক কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৮৫০ কিউসেক।