ঢাকা মহানগরীতে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সড়কে রংচটা বাস চলাচল করতে পারবে না বলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির গড়িমসিতে তা ভেস্তে যেতে বসেছে। এদিকে যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার সড়কে পরিবহনব্যবস্থা সমন্বয় না করে বিদ্যমান গণপরিবহনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলে নগরে পরিবহনসংকট আরও তীব্রতর হবে।
গত মার্চ মাসে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত একটি সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, বায়ুদূষণ রোধে ঢাকা শহরে চলাচলকারী ইকোনমিক লাইফ অতিক্রান্ত ২০ বছরের বেশি বয়সী বাস প্রত্যাহার করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে এপ্রিলের মধ্যে ঢাকা শহরে চলাচলকারী ওই বয়সী বাসের তালিকা পাঠাবে। পরিবহন মালিক সমিতিকে এপ্রিলের মধ্যে ২০ বছরের বেশি বয়সী বাস প্রত্যাহারের পরিকল্পনা দেওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
এসব নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ এপ্রিল বিআরটিএ ভবনে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠক করেন বিআরটিএর কর্মকর্তারা। ওই সভায় মালিক সমিতির নেতারা মে মাস পর্যন্ত সময় চেয়ে নেন। সভায় বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার তাদের সেই দাবি মেনে নেন। সড়কে রংচটা বাসগুলো তুলে নিতে তিনি ৩০ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। সেই সঙ্গে রংচটা বাসগুলোর কতটা নতুন করে রং করা হলো, আনফিট গাড়িগুলো ফিটকরণ প্রক্রিয়ায় কতটা এগিয়ে এসেছে, মালিক সমিতিকে তার তথ্য দেওয়ার তাগাদা দেন।
কিন্তু ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সদস্য ও বিআরটিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়ক থেকে রংচটা বাস উঠিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াতে খুব বেশি সাড়া নেই পরিবহন মালিকদের। বিভিন্ন কোম্পানির বাস মালিকদের অনেকের বাসে টেকসই রং করার মতো সামর্থ্য নেই বলে পরিবহন সমিতি দাবি করলেও জানা যায়, আসলে এতে আগ্রহই নেই বাস মালিকদের। কেননা সড়কে রেষারেষি করতে গিয়ে রংচটা হয়ে পড়া বেশ কয়েকটি বাস নতুন করে রং করা হলেও তার স্থায়িত্ব বড়জোর ২ মাস।
যাত্রাবাড়ী-টঙ্গী রুটে চলাচল করা তুরাগ পরিবহনের একজন বাসচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রংচটা বাসগুলোতে হালকা রং করতেও খরচ হয় ৫-৬ হাজার টাকা, যার স্থায়িত্ব বড়জোর ১ মাস। ২-৩ মাস স্থায়ী হবে এমন রং করতে গেলে খরচ পড়ে ২০-৩০ হাজার টাকা। মালিকরা সেই টাকা ব্যয় করতে রাজি নন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘গাড়ির যন্ত্রাংশ, জ্বালানির দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে আমাদের পরিবহন খাতের খরচ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক বাস মালিকের বাসে দীর্ঘস্থায়ী রং করার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। তা ছাড়া মেট্রোরেল চালু হওয়ার পরে বাসে যাত্রীসংকট তো আছেই। আমার বিকল্প অটো সার্ভিসে (যাত্রাবাড়ী-মিরপুর ১২ রুটে) গত ঈদে ৫৬ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।’
সড়ক থেকে আনফিট বাস তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়াতেও বাস মালিকরা নানা অনিয়ম করতে চান বলে জানা গেছে। বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, যাত্রীবাহী বাসগুলোর গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ যেমন ব্রেক, হেডলাইট ইত্যাদি বিকল থাকে। সেসব বিকল যন্ত্রাংশ মেরামত বা প্রতিস্থাপন না করেই দ্রুততম সময়ে গাড়ি ফিট করিয়ে নিতে চান। এ নিয়ে বিআরটিএর কর্মকর্তাদেরও চাপ দেওয়া হয় মালিক সমিতির পক্ষ থেকে- এমন অভিযোগও মিলেছে।
অভিযোগ আছে বিআরটিএর বিরুদ্ধেও। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা অভিযোগ করেন, ঢাকায় ৪২৮টি নতুন গাড়ি নামানোর সব প্রক্রিয়া শেষ করলেও এখনো বিআরটিএর রুট পারমিট বিভাগের অনুমোদন মিলছে না। তবে বিআরটিএর রুট পারমিট ও রোড সেফটি বিভাগের কর্মকর্তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, মালিক সমিতি যেসব গাড়ি নতুন বলে দাবি করছে তার অধিকাংশ পুরোনো বাস। তারা এগুলোকে নতুন করে রং করে, কিছু যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করে সড়কে নামাতে চায়।
গত রবিবার বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিআরটিএ কিন্তু নিজেরা কোনো সময় বেঁধে দেয়নি বাস মালিকদের। তারাই সময় নিয়েছে। এখন তারা যদি গড়িমসি করে আমরা আর সময় বাড়াব না। আমরা ১ জুন থেকেই সড়কে নামব। ঢাকার সড়কে রংচটা বাস চলতে দেওয়া হবে না। সিটি করপোরেশন, ডিএমপিসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের সহযোগিতায় আমরা জোরদার অভিযানে যাব।’
তবে ঢাকা নগর পরিবহনকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় রেখে এমন উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে এক করিডরে একাধিক বাস অপারেটরদের রেখে দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর যে উদ্যোগ নিচ্ছে বিআরটিএ, তাতে জনদুর্ভোগ বাড়বে। বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজিকে যদি কার্যকর করা না হয়, তবে সড়ক থেকে রংচটা বাস বা ফিটনেসবিহীন বাস উঠিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ ভেস্তে যাবে। আমাদের সামনে হাতিরঝিল আর গুলশানের বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজির উদাহরণ রয়েছে। সেই মোতাবেক আমরা ঢেলে সাজাতে পারি ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা।’
এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রাজিব সিদ্দিক জানান, মার্চ মাসের সিদ্ধান্ত কতদূর বাস্তবায়ন করেছে বিআরটিএ, তা নিয়ে শিগগিরই আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকের আয়োজন করবে মন্ত্রণালয়। এই সভায় বাস মালিকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হবে।