দেশব্যাপী সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। এরই ধারাবাহিকতায় যৌথ বাহিনী সারা দেশে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে। পুলিশ জানায়, গত ১০ দিনে সারা দেশে ৫ হাজারের বেশি দুষ্কৃতকারীকে আটক করা হয়েছে।
এর মধ্যে শুক্রবার (২৬ জুলাই) পর্যন্ত ২ হাজার ৩৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
এদিকে শুক্রবার রাতে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তি, কড়াইল বস্তি, আরজতপাড়া, শাহিনবাগ, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, গোপীবাগ, বাড্ডা, শাহবাগ, কুড়িল, ধানমন্ডিসহ বেশ কিছু জায়গায় ব্লক রেড অভিযান পরিচালনা করেছে পুলিশ।
এসব এলাকায় হেলিকপ্টার দিয়ে সার্চ করেও আসামিদের শনাক্ত করা হয়। এ ছাড়া ঢাকার প্রবেশপথে তল্লাশি করা হয় এবং কাউকে সন্দেহ হলেই পুলিশ আটক করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর থেকে গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে রাজধানী ও প্রবেশপথ থেকে চার শতাধিক দুষ্কৃতকারীকে আটক করা হয়েছে।
শুক্রবার ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কে এন রায় নিয়তি জানান রাজধানীতে সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় ২০৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গতকাল পর্যন্ত ২ হাজার ৩৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় দুষ্কৃতকারীরা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের ধরা হচ্ছে এবং এই অভিযান চলমান থাকবে। বাংলাদেশ পুলিশের অকুতোভয় সদস্যদের মনোবল অটুট রয়েছে। তারা দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা প্রদানে বদ্ধপরিকর।
পুলিশের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘একটি গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রকে অকার্যকর করা ও সরকারকে উচ্ছেদ করা। অর্থাৎ সেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজটাই তারা করেছে। এর সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্ররা এসব জ্বালাও-পোড়াও করেনি। কোটাবিরোধী যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, প্রকৃত পক্ষে সেই আন্দোলন হাইজ্যাক করা হয়েছে। যারা নাশকতাকারী, রাষ্ট্রবিরোধী, সরকার এবং রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, রাষ্ট্রকে অচল করে দিতে চায় তারাই মূলত ছাত্র আন্দোলন হাইজ্যাক করেছিল। এই নৈরাজ্য পরিস্থিতি যারা সৃষ্টি করেছে তারা রেহাই পাবে না। তা ছাড়া আমাদের কাছে তথ্য আছে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা জেলা পুলিশের উদ্যোগে মহাসড়কে মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে হকারদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। সেই হকাররাও এই নৈরাজ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য জ্বালাও-পোড়াও করেছে।’
ঢাকার সহিংসতায় অংশ নেয় দেড় শতাধিক জেএমবি সদস্য
রাজধানীতে চালানো নাশকতা ও তাণ্ডবে অংশ নেন রাজশাহী বিভাগের জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া রয়েছে জঙ্গি সংগঠন জেএমবির দেড় শতাধিক সদস্য। তাণ্ডব চালিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফেরার পথে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা এসব স্বীকার করেছেন। পুলিশ বলছে, তারা স্বীকার করেছেন, শীর্ষ নেতাদের নির্দেশেই সরকার পতনের জন্য এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও জেএমবির জঙ্গিরা।
এ বিষয়ে র্যাব-৫-এর অধিনায়ক ফিরোজ কবির খবরের কাগজকে জানান, জেএমবির সদস্যরা ঢাকা, গাজীপুর ও নরসিংদী এলাকায় সংঘটিত নাশকতায় অংশ নিয়েছে। বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে এবং এ বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এদের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে র্যাব অধিকতর তদন্ত চালাচ্ছে এবং অন্যান্য জঙ্গিকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
৭৮ পুলিশ বক্সে আগুন-লুটপাট, নথিপত্রসহ মূল্যবান জিনিস গায়েব, ‘আশ্রয়হীন’ ট্রাফিক পুলিশ
এদিকে গত কয়েক দিনের নাশকতায় রেহাই পায়নি ট্রাফিক পুলিশও। রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশের ৭৮টি বক্সে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। চালানো হয়েছে নজিরবিহীন লুটপাট। এতে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক সদস্যরা।
মিরপুর-১০-এর মোড়ে ডিউটিরত মো. তছিমুর নামের একজন ট্রাফিক সদস্য খবরের কাগজকে জানান, ঘটনার দিন তারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন। ট্রাফিকের প্রতিটি সদস্য মাঠে ওই দিন আন্দোলনকারীদের সামাল দিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর ফাঁকে তাদের ট্রাফিক বক্সে আগুন দেওয়া হয়। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ওভারব্রিজে। আন্দোলনকারীদের ভিড় এতটাই ছিল যে, দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসাটাও ছিল দুরূহ ব্যাপার। এতে চোখের সামনেই পুড়ে যায় সব। তিনি আরও জানান, হামলাকারীরা শুধু ট্রাফিক বক্সে আগুন দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি। তারা ট্রাফিক বক্সের জানালা, দরজা, এসিসহ মূল্যবান জিনিসপত্র, চুরি লুটপাট করেছে।
জানা গেছে, শুধু মিরপুর ও মোহাম্মদপুরেই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহাখালী পুলিশ বক্স, গুলশান ট্রাফিকের ডিসি অফিসও। গুলশান ট্রাফিকের ডিসি অফিসে ভাঙচুরের পাশাপাশি লুটপাট চালানো হয়েছে। অফিসের সামনে পার্ক করা ৯টি মোটরসাইকেল, টেলিভিশন, কম্পিউটার, এলইডি মনিটরসহ প্রায় ৬২ লাখ টাকার জিনিসপত্র লুট করা হয়েছে। এমনকি ট্রাফিক সদস্যদের ব্যবহার করা লেগুনাটি নিয়ে গেছে লুটকারীরা।
গুলশান ট্রাফিকের এডিসি হাফিজুর রহমান বলেছেন, কেসের রেকর্ডসংক্রান্ত কাগজপত্রসহ মূল্যবান জিনিস খোয়া গেছে। এতে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে এটা বলে বোঝানো যাবে না। এরা সুযোগসন্ধানী ও তৃতীয় পক্ষের কেউ বলে মনে করছেন তারা। ট্রাফিকের সদস্যরা বলছেন, তারা চাকরিজীবনে এমন তাণ্ডব দেখেননি। এই অবস্থা থেকে তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। আপাতত তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডিউটি করছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মনিবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের পুরো ঢাকায় ৭৮টি ট্রাফিক বক্সে আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব ট্রাফিক বক্সে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। খুব শিগগির আমরা ট্রাফিক বক্সগুলো নতুন করে মেরামত করব। আপাতত ট্রাফিক সদস্যরা বক্স ছাড়াই দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের এখন বসার জায়গাটুকুও নেই।’
সূত্র জানায়, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসারের ৩১৩ স্থাপনায় হামলা করে চার বাহিনীর প্রায় ৩০০টি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নথি চুরি ও লুটপাট করা হয়। ভাঙচুর করা হয়েছে তাদের সাঁজোয়া যানসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, বিক্ষোভ ও সংঘাত ঘিরে চার বাহিনীর প্রায় ৩০০টি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে পুলিশের সাঁজোয়া যান আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ারেও (এপিসি)। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের কার্যালয়ের পাশাপাশি থানায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর বেশ কয়েকটি থানার মূল্যবান নথি পুড়ে গেছে এবং চুরি হয়েছে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর খবরের কাগজকে বলেন, এবার নাশকতার চিত্র ছিল ভিন্ন। সবার আগের পুলিশকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা করা হয় এবং আগুন ও নথিপত্রসহ অনেক কিছু গায়েব করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান খবরের কাগজকে জানান, নতুন করে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করলে শক্তভাবে দমন করা হবে।