উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আদায়ে বিশাল ঘাটতি, ভতুর্কিসহ নানামুখী চাপে রয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। এই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে অর্থ উপদেষ্টাকে। দেশে একদিকে চলছে রাজনৈতিক সংকট, অন্যদিকে অর্থনীতির দুরবস্থা- এমন কঠিন বাস্তবতায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
আজ সোমবার নতুন অর্থবছরের বাজেট দেবেন অর্থ উপদেষ্টা। এটা হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেলা ৩টায় বাজেট বক্তৃতা শুরু করবেন অর্থ উপদেষ্টা। তার বক্তৃতা বেতার ও টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। এর আগে দুপুর ১২টায় যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন দেওয়া হবে। প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন অধ্যাদেশ জারি করে এই বাজেট উপস্থাপনের অনুমোদন দেবেন।
প্রচলিত বিধান অনুযায়ী রাজনৈতিক সরকারের অর্থমন্ত্রীরা সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না থাকায় এ বছর সেটি হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ দুই অর্থবছরেই টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দুটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
অর্থ উপদেষ্টার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই হবে অর্থ উপদেষ্টার বড় চ্যালেঞ্জ। কয়েক বছর ধরে দেশে বিনিয়োগে খরা চলছে। বেকারত্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে। এসব চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে তাকে। এ ছাড়া গতিহীন অর্থনীতিকে সচল করতে মনোযোগ দিতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, এবারের বাজেট হবে ব্যতিক্রম। আগের বছরের তুলনায় ছোট হবে। সম্পদের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে অর্থাৎ আয় বুঝে ব্যয় করে বাজেট সাজানো হচ্ছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অনুসরণ করা হবে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আগামী বাজেট উচ্চাভিলাষী হবে না। এটি হবে বাস্তবভিত্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য। এই বাজেটে কথামালার কোনো ফুলঝুরি থাকবে না। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসা-বাণিজ্য ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হবে। সম্প্রতি সচিবালয়ে খবরের কাগজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাজেটের আকারের চেয়ে ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ভালো নয়। অন্য ক্ষেত্রেও সরকারের আয় বাড়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। বৈদেশিক ঋণ-সহায়তার অবস্থাও ততটা ভালো নয়। কাজেই এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যদি একটা বড় বাজেট প্রণয়ন করে, তাহলে সরকারকে বেশি ঋণ নিতে হবে। শুধু বাজেট করলেই হবে না, অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। আমি মনে করি, এখন বড় বাজেট করার মতো বাস্তবতা নেই।’
বাজেটের আকার
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করছেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এটি জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি বা আয়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আসবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। কর ব্যতীত প্রাপ্তি থেকে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১৯ হাজার কোটি টাকা আসবে এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে। প্রস্তাবিত বাজেটে সামগ্রিকভাবে ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক- এই দুই উৎস থেকে ঘাটতি পূরণ করা হবে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা আসবে বিদেশি ঋণ থেকে। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংক থেকে অর্থায়নের প্রস্তাব করা হচ্ছে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ২১ হাজার কোটি টাকা। যে অর্থবছরটি শেষ হতে যাচ্ছে, তাতে মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
যেসব পরিবর্তন আসতে পারে
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কর প্রস্তাবসহ বেশ কিছু পরিবর্তনের ঘোষণা দেবেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, এসব পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব বাজেট দেওয়া, যার সুফল সবাই পাবেন।
গরিবরা যাতে কিছুটা স্বস্তি পান সে জন্য নতুন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় নজর দিচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা। এ জন্য বয়স্ক ও বিধবাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচির আওতা ও ভাতা বাড়াচ্ছেন তিনি। আওতা বাড়ছে আরও ১০ লাখ এবং ভাতা বাড়ছে বাড়তি ৫০ থেকে ১০০ টাকা। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবভিত্তিক করতে বাজেট আরও দরিদ্রবান্ধব করা হচ্ছে। গত জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে যারা শহিদ ও আহত হয়েছেন, তাদের পরিবারকে সহায়তা করা হবে। এ জন্য নতুন বাজেটে ৫৯৩ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের ঘোষণা থাকছে। সড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে নজর দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য থাকছে ২১০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ। দুস্থ মানুষকে সুরক্ষা দিতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতা আরও পাঁচ লাখ বাড়ানো ঘোষণা আসছে।
কর প্রস্তাব
বাজেটে কিছু ক্ষেত্রে করছাড় আবার কিছু ক্ষেত্রে নতুন করে করহার বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে আগামী বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। আয়কর, মূল্য সংযোজন কর ও আমদানি শুল্ক- এই তিন খাত থেকে ‘বাড়তি’ শুল্ক আদায় করা হবে। যে অর্থবছরটি শেষ হতে যাচ্ছে, তাতে মূল বাজেটে রাজস্বের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
আগামী বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমায় কোনো পরিবর্তন আসছে না। তবে করদাতারা যাতে আগাম হিসাব করে তাদের আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারেন, সে জন্য ২০২৬-২৭ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বিদ্যমানের চেয়ে ২৫ হাজার টাকা ছাড় দিয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে।
বেসরকারি খাতের জন্য করপোরেট কর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি কমালে বিনিয়োগ বাড়ে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে করপোরেট করহার কম। কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশে এই হার অত্যন্ত বেশি। বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোক্তারা এই করহার কমানোর দাবি জানালেও এবারের বাজেটে তা বাড়ছে না। বরং করপোরেট কর বাড়তে পারে। শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে করপোরেট কর সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হতে পারে। তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ২০ শতাংশ করপোরেট কর অব্যাহত থাকছে।
পুঁজিবাজার চাঙা করতে কিছু সুখবর দিচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা। এখন ব্রোকারেজ হাউসে শেয়ার লেনদেনের ওপর কর হার (টার্নওভার কর) শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। নতুন বাজেটে এই হার কমিয়ে শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশের ঘোষণা আসছে। পুঁজিবাজারে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার সাড়ে ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করার প্রস্তাবও করতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা।
বর্তমানে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি লাভ হোক আর লোকসান হোক ওই প্রতিষ্ঠানকে বছর শেষে মোট লেনদেনের ওপর শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। এই কর এবার বেড়ে দ্বিগুণ হতে পারে।
জমি-ফ্ল্যাট কেনাবেচায় নিবন্ধন ফি ও করহার কমতে পারে। কিছু খাতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের শর্ত শিথিল হতে পারে। যেমন নির্মাণ সংস্থা, জোগানদার, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের রিটার্ন দাখিলের মেয়াদ প্রতি মাসের পরিবর্তে ছয় মাস করার প্রস্তাব থাকছে। ছয় মাসের মধ্যে আগাম কর সমন্বয় করা যাবে- এমন বিধানের প্রস্তাব করা হচ্ছে, যা এখন আছে ৪ মাস। অনলাইনে পণ্য বিক্রি কমিশনের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় শুল্ক কাঠামো যৌক্তিক করা হচ্ছে।
ব্যাংকে জমা টাকায় শুল্কছাড়
বাজেটে আবগারি শুল্ক বসানোর সীমা বাড়তে পারে। বর্তমানে এক লাখ পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবের স্থিতিতে কোনো আবগারি শুল্ক দিতে হয় না। এটি বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। এ ছাড়া আবগারি শুল্ক আরোপের স্তরও পুনর্বিন্যাস করা হতে পারে।