আড়াই বছর ধরে চলে আসা ডলারসংকট এই মুহূর্তে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যে এক অস্থিরতা তৈরি করেছে। এর প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় হয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। আর এ ক্ষয় ঠেকাতে আমদানি ব্যয়বহুল ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ফলে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা প্রত্যাবাসন করতে পারছেন না এবং নতুন বিদেশি বিনিয়োগপ্রবাহে ভাটা পড়েছে। এ সমস্যাকে এক্সটার্নাল সেক্টর ভলাটিলিটি বা বৈদেশিক খাতের অস্থিরতা নাম দিয়ে এটিকে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখতে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ডলারসংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজার, শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন জোর করে টাকার দর ধরে রাখা হয়েছিল। ভারতের মতো স্থিতিশীল অর্থনীতিতে যেখানে দরপতন হয়েছে ঢের বেশি, সেখানে বাংলাদেশে টাকার মান জোর করে ধরে রাখার পরিণতিতে বর্তমান দুঃসময় এসেছে।
এদিকে শীর্ষ অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মনে ডলারসংকট নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে কৌতূহল। সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও নীতিনির্ধারণীতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে সার্বিক পরিস্থিতি। শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরকালে গত বুধবার এ ব্যাপারে জানতে চান কবে নাগাদ তার দেশের ব্যবসায়ীরা এ দেশে আয়ের অর্থ নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করতে পারবেন।
এ সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকার কর্তৃক রেমিট্যান্সের দেওয়া প্রণোদনার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকেরও সমপরিমাণ প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ব্যাংকগুলো তাদের অফশোর হিসাবে সঞ্চিত ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রেখে টাকা নিতে পারার সুবিধা সৃষ্টি যা টাকা-ডলার বিনিময় করার মাধ্যমে তারল্য সুবিধা দেওয়া, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালার উদারীকরণ এবং সর্বশেষ ডলারের দর ৭ টাকা অবমুল্যায়ন করা হয়।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এসব ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সরবরাহ বাড়াতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গত বৃহস্পতিবার এফবিসিসিআই নেতাদের বলেছেন যে ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। তবে সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত।
শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম খবরের কাগজকে গতকাল শনিবার বলেন, ‘আমরা গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানিয়েছি যে ডলারের সংকটে ব্যবসা ও বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি (গভর্নর) আমাদের বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে মাহবুবুল আলম মন্তব্য করে বলেন, ‘আমি মনে করি এসব ব্যবস্থা কাজে আসবে এবং আগামী দিনে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে।’
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালের মে-জুন সময়ে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৬৩৯ কোটি বা ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। এরপর ২০২২ সালের মে-জুনে ওই রিজার্ভ কমে হয় ৪ হাজার ১৮২ কোটি বা ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের মে-জুনে এসে রিজার্ভ কমে হয় ৩ হাজার ১২০ কোটি বা ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের মে মাসে এসে রিজার্ভ আরও কমে গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অর্থাৎ ১ হাজার ৮২৩ কোটি বা ১৮ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারে এসে ঠেকেছে। শতকরা হিসাবে রিজার্ভ ক্ষয় হয়েছে ৬০ শতাংশের বেশি।
এ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালের মে-জুন মাসে প্রতি ১ ডলার পাওয়া যেত ৮৬ টাকায়। পরের বছর ২০২২ সালের মে-জুনে সেই দর বেড়ে হয় ৯৩ টাকা, ২০২৩ সালের একই সময়ে তা বেড়ে হয় ১০৮ টাকা এবং ২০২৪ সালের মে মাসে এসে ডলারের দর আরও বেড়ে হয় ১১৭ টাকা। শতকরা হিসাবে দরপতনের এ হার ২৭ শতাংশের মতো।
এতদিন এ পরিস্থিতিতে অংশীজনদের (স্টেকহোল্ডার) সঙ্গে নিয়ে শুধু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তা পুরোপুরি কাজে আসেনি। এবার ডলার সংগ্রহে সরাসরি অভিযানে নেমেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে এ লক্ষ্যে অফশোর ব্যাংকিং নীতিতে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টে দেশের শীর্ষ ব্যাংকারদের সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। এর একটি অনুষ্ঠান হলো অফশোর ব্যাংকিং জনপ্রিয় করার উদ্যোগ। আগামী ২৫ ও ২৬ মে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট (ওবিইউ) হিসাবে আমানতে উৎসাহিত করতে আয়োজিত ‘রোড শো’তে যোগ দেবেন তারা।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের আয়োজনে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধসংক্রান্ত অপর একটি কর্মসূচিতেও যোগ দেবেন বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যাংক কর্মকর্তারা। শীর্ষ ব্যাংক নির্বাহীরা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পাচার হওয়া অর্থ নির্ভয়ে দেশে ফেরত আনতেও ক্যাম্পেইন চালাবেন।
দেশের প্রচলিত সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার মাধ্যমে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উৎসাহিত করার বিষয়টিও এ সফরে গুরুত্ব পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান এ দুটি কর্মসূচিতেই উপস্থিত থাকবেন।
ডলারসংকট নিরসনে প্রথম উদ্যোগটি নেওয়া হয় গত বছরের (২০২৩ সালের) অক্টোবরে। এ সময় অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) মাধ্যমে রেমিট্যান্স আয় কিনতে আগে থেকে সরকারের দেওয়া আড়াই শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও সমপরিমাণ বা ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে ডলার সরবরাহ কিছুটা বাড়ে। কিন্তু ওই ব্যবস্থা টেকসই হয়নি। আবারও ভাটা পড়ে প্রবাসী আয়ে। দেশের বাজারে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার অনেকটা দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। মানি চেঞ্জারদের কাছেও ডলার দামি হয়ে ওঠে। কালো বা খোলাবাজারে ডলারের দর আরও বৃদ্ধি পায়। একপর্যায়ে খোলাবাজারে ১ ডলারের ক্রয়মূল্য হয় ১২৭-১২৯ টাকা পর্যন্ত। আমদানিতে প্রতি ডলার বেচাকেনা হয় ১২২-১২৩ টাকায়।
এপ্রিলে ঈদুল ফিতরের পর ডলারের দরে তেজিভাব সামান্য কমে ১১৫ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে নিত্যপণ্য আমদানি ও বেসরকারি খাতের প্রয়োজনীয় শিল্প আমদানি বাড়ায় ডলারের দর আবারও বাড়তে থাকে। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পেগ-ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং ১১০ টাকার নির্ধারিত মূল্যের ডলার একসঙ্গে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। অর্থাৎ প্রতি ডলারের ক্রয়মূল্য হবে ১১৭ টাকা। এর সঙ্গে সরকারের দেওয়া প্রণোদনা যোগ করলে রেমিট্যান্স ডলারের দর হয় ১২০ টাকা। এ বাড়তি দরের প্রভাব হিসেবে রেমিট্যান্স আয় বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মানি চেঞ্জারদের জন্য নির্দেশনা
বাংলাদেশ ব্যাংক গত মঙ্গলবার মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দকে ডেকে বলে দিয়েছেন, নির্ধারিত ১১৭ টাকার সঙ্গে সর্বোচ্চ ১ টাকা ৫০ পয়সা যোগ করে ডলারের দর সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা আদায় করতে পারবে। এর বেশি হলে লাইসেন্স বাতিল করার মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেছেন, দেশের বিমানবন্দরগুলোতে প্রতিদিন প্রায় দুই-তিন হাজার প্রবাসী যাতায়াত করে থাকেন। তারাই একটি বড় অংশের বৈদেশিক মুদ্রা স্থানীয় বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সরবরাহ করেন। এভাবে প্রাপ্ত ভাসমান ডলারের প্রভাব মুদ্রাবাজারে বিস্তর। এর প্রভাবেই বিনিময় হারের ওঠানামা হয় বারবার। যখন যেমন চাহিদা, তেমন দর।
অফশোর ব্যাংকিং উদারীকরণ
অফশোর ব্যাংকিং হিসাবে আমানত রাখা হলে তা করমুক্ত ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় বিভিন্ন মেয়াদি স্থায়ী আমানতের সুদহার ৬ দশমিক ৮ থেকে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত।
অফশোর আমানতের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের দেড় কোটি বা ১৫ মিলিয়ন প্রবাসী অফশোর হিসাবে অর্থ আমানত রাখতে পারেন। এটিকে বড় সম্ভাবনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেনসহ সরকারের সমালোচনা করা অর্থনীতিবিদরা সর্বশেষ ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনকে একটি বাজারমুখী উদ্যোগ হিসেবে ইতিবাচক বলে বর্ণনা করেছেন। তারা আরও বলেছেন, এ উদ্যোগ আরও আগে দরকার ছিল। দেরিতে হলেও এটি মন্দের ভালো।