
প্রকল্প গ্রহণে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতায় গচ্চা গেছে ৭৫ কোটি টাকা! দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা তিতাস গ্যাস ফিল্ডের ১৪ নম্বর কূপটি ওয়ার্কওভার শেষে মাত্র ৪৮ দিন গ্যাস তোলার পর কারিগরি ত্রুটির কারণে ফের বন্ধ হয়ে গেছে। কবে নাগাদ পুনরায় চালু করা যাবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। এ ছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে কূপ বন্ধের বিষয়ে জবাবাদিহির আওতায় আনা হয়নি সংশ্লিষ্টদের। অভিযোগ উঠেছে, ভালো করে যাচাই না করেই ‘অর্থ লুটের উদ্দেশ্যে’ বন্ধ কূপটি ওয়ার্কওভার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ফলে দুই মাসও গ্যাস তোলা যায়নি কূপটি থেকে।
এদিকে তিতাসের প্রায় সব কটি কূপেই গ্যাসের মজুত এবং চাপ কমছে। ফলে জাতীয় গ্রিডের চাপের সঙ্গে সমন্বয় করে গ্যাস উত্তোলনে বেগ পেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। এ অবস্থায় তিতাস গ্যাস ফিল্ডের কয়েকটি লোকেশনে বিপুল অর্থ ব্যয় করে ওয়েলহেড কম্প্রেসর স্থাপন করছে কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে ‘ই’ এবং ‘জি’ লোকেশনে ৬টি কম্প্রেসর স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রকল্পের কাজ করছে সাবেক জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর আশীর্বাদপুষ্ট প্রতিষ্ঠান ‘জিকম ইক্যুইপমেন্ট পিটিই লিমিটেড’।
তবে অভিযোগ রয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ‘জিকম’কে দেওয়া ৫০০ কোটি টাকার কম্প্রেসর স্থাপন প্রকল্পের কাজ যাতে বন্ধ না করা হয় সে জন্য প্রকল্প পরিচালকসহ বিজিএফসিএলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়েছে। মূলত, গ্যাসের মজুত এবং চাপ কমার কারণে তিতাসের ‘সি’ লোকেশনে ইতোপূর্বে বসানো ৩টি কম্প্রেসরের মধ্যে কাজে লাগছে ২টি। অপর কম্প্রেসরটি কাজে না লাগলেও এটির রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে কূপে গ্যাসের মজুত কম থাকলেও নতুন করে নেওয়া কম্প্রেসর স্থাপনের প্রকল্পটি বিজিএফসিএল কর্তৃপক্ষের অদূরর্শিতার জন্য ‘লস প্রজেক্ট’ হতে পারে। প্রকল্পের আওতায় তিতাসের লোকেশন ‘ই’তে ৩টি এবং ‘জি’তে ৩টি ওয়েলহেড কম্প্রেসর স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। যদিও বর্তমানে ‘ই’ এবং ‘জি’ লোকেশনের বেশির ভাগ কূপে গ্যাসের চাপ প্রায় ৭০০ পিএসআইজি রয়েছে, যা জাতীয় গ্রিডের চাপের সমপরিমাণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিজিএফসিএল পরিচালিত তিতাস গ্যাস ফিল্ডের ২৭টি কূপের মধ্যে বর্তমানে ৫টি কূপ বন্ধ রয়েছে। বাকি ২২টি কূপ থেকে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। কূপগুলোতে মজুত কমতে থাকায় ক্রমাগত কমছে গ্যাসের উৎপাদন। গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে ৫২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বিজিএফসিএল পরিচালিত বিভিন্ন গ্যাস ফিল্ডের ওয়ার্কওভার প্রকল্পের আওতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল-বিশ্বরোড এলাকায় অবস্থিত তিতাস গ্যাস ফিল্ডের ১৪ নম্বর কূপটির ওয়ার্কওভার শুরু হয় গত বছরের ১৯ মার্চ।
প্রথমদিকে ১৪ নম্বর কূপ থেকে দৈনিক ২৯ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উত্তোলন হতো। তবে গ্যাসের সঙ্গে অতিমাত্রায় পানি ওঠার কারণে ২০০৯ সালে কূপটি ওয়ার্কওভার করে দৈনিক ১৯ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উৎপাদন করা হয়। তবে গ্যাসের সঙ্গে পানি উৎপাদনের হার বৃদ্ধির কারণে ২০২১ সালের নভেম্বরে কূপটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ওয়ার্কওভার শেষে গত বছরের ২১ মে কূপটি থেকে পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়। এরপর ২৫ মে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয় কূপটি থেকে।
জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন তৎকালীন জ্বালানি সচিব মো. নুরুল আলম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ওয়ার্কওভার প্রকল্পের পরিচালক ইসমাইল মোল্লা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, কূপটি থেকে আগামী ১০ বছর পর্যন্ত ৪০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৬০০ কোটি টাকা। প্রতিদিন গড়ে ১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলেও জানানো হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তবে উদ্বোধনের পর সব মিলিয়ে ৪৮ দিনে মাত্র ২৫৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয় ১৪ নম্বর কূপ থেকে।
ওয়ার্কওভার প্রকল্পের পরিচালক মো. ইসমাইল মোল্লা জানান, কারিগরি ত্রুটির কারণে ১৪ নম্বর কূপটি বন্ধ হয়ে গেছে। এত দ্রুত কারিগরি ত্রুটি হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি মিটিংয়ে আছেন জানিয়ে অপরেশন বিভাগের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে বিজিএফসিএলের অপারেশন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, দায়িত্ব এড়ানোর জন্যই প্রকল্প পরিচালক অপারেশন বিভাগে কথা বলার জন্য বলেছেন। ১৪ নম্বর কূপটি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই সংশ্লিষ্ট কমিটির অনুমোদন নিয়ে ওয়ার্কওভার প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। কূপ বন্ধ হওয়ার বিষয়টি তাই অন্যভাবে দেখার সুযোগ নেই। কূপটি থেকে ২৫৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা গেছে।
এদিকে ১৪ নম্বর কূপের ব্যর্থতার মধ্যেই ১৬ নম্বর কূপের ওয়ার্কওভার করেছে বিজিএফসিএল কর্তৃপক্ষ। যদিও কূপটি আগে থেকেই সচল রয়েছে। এই কূপে আগে থেকেই প্রতিদিন ১৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হলেও ওয়ার্কওভার শুরুর পর তা এখন গড়ে ৪ মিলিয়নে নেমে এসেছে। ত্রুটিপূর্ণ ওয়ার্কওভারের কারণে এখন আবার ওয়ার্কওভারের জন্য নতুন করে আরও ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বিজিএফসিএলের একটি সূত্র বলছে, সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ঘনিষ্ঠজন হওয়ার সুবাদে জ্যেষ্ঠতা ভেঙে বাপেক্সের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তা ফজলুল হককে বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগ দেয়। নিয়োগ পাওয়ার পর নিজের পছন্দের এবং আওয়ামী লীগপন্থি কর্মকর্তাদের নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। ৭টি কূপের ওয়ার্কওভার প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া কর্মকর্তা কার্ত্তিক চন্দ্র ঘোষকে বিজিএফসিলের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেন ফজলুল হক। কোম্পানিতে নিজের আধিপত্য ধরে রাখতেই তিনি কার্ত্তিক চন্দ্র ঘোষকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রেখেছেন বলে সূত্রটি জানিয়েছে। পাশাপাশি কম্প্রেসর স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন নিজের পছন্দের আরেক কর্মকর্তা- পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মামুন আজাদকে।
বিজিএফসিএলের সিবিএ সভাপতি নূর আলম বলেন, শুধু কোম্পানির এমডির অদক্ষতায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সুফল মিলছে না। ১৪ নম্বর কূপের ওয়ার্কওভার কাজটি ভালোভাবে করা হয়নি বলে বেশি দিন গ্যাস উত্তোলন করা যায়নি। এখানে বাপেক্সের অদক্ষতা রয়েছে।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী ফজলুল হক বলেন, ‘আমার সঙ্গে নসরুল হামিদ বিপুর কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিল না। আমি কোনো সিন্ডিকেট করিনি। আমার মাথাতে এগুলো কখনো আসেইনি। আমি এমডি হয়ে আসার পর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা ব্যক্তিস্বার্থে কিছুই করিনি। এ ছাড়া কম্প্রেসর স্থাপনের প্রকল্প ২০১৮ সালে নেওয়া হয়েছিল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০২১ সালে। কূপগুলোতে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ার কারণে কম্প্রেসর ব্যবহার করতে হচ্ছে।