
প্রকৃতির এক অন্যতম দান নিমগাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Azadirachta indica। এটি Meliaceae পরিবারের একটি বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ ও চিরহরিৎ বৃক্ষ। নিমের উৎপত্তি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকাতে। এর আদিবাস মায়ানমার। নিমগাছ আকৃতিতে ৪০-৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
কোনো কিছুর স্বাদ তেতো হলেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা নিমের সঙ্গে তুলনা করি। কিন্তু তেতো হলেও নিম খুবই উপকারী এক গাছ। এটি শুধু একটি গাছ নয় বরং স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং কৃষিক্ষেত্রের বিভিন্ন সমস্যার এক বিস্ময়কর সমাধান। হাজার বছর ধরে নিমগাছ তার ঔষধি গুণাগুণের জন্য পরিচিত। নিমগাছকে প্রকৃতির ‘ঔষধি ফার্মেসি’ বলা হয়। কারণ এর পাতা, ছাল, শিকড় এবং ফল নানা ধরনের রোগ নিরাময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এটি বিশেষ করে আয়ুর্বেদিক ও প্রাকৃতিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। নিমের এসব গুণাগুণের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘোষণা করেছে।
নিমের ডাল যেমন দাঁতন হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তেমনই প্রসূতিগৃহে, অসুস্থ রোগীর বিছানায় নিমের পাতা এখনো স্থান পায়। বাড়ির দক্ষিণে নিমগাছ থাকলে সে বাড়িতে কোনো রোগ-ব্যাধি ঢুকতে পারে না, এমন কথাও বহুল প্রচলিত।
নিমগাছের পাতা তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণে সিসা শোষণ করে। ধূলিকণা, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার অক্সাইড এবং নাইট্রোজেনের মতো দূষক শোষণ করার ক্ষমতা নিমগাছের রয়েছে। তাই বলা যায়, নিমগাছ শুধু স্বাস্থ্যরক্ষায় নয়; পরিবেশ দূষণ কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
নিমগাছের ফল দেখতে আঙুরের মতো। জুন-জুলাইতে ফল পাকে এবং কাঁচা ফল তেতো স্বাদের হয়। তবে পেকে হলুদ হওয়ার পর মিষ্টি হয়। এর বংশবিস্তার বীজ দিয়ে এবং শাখা কলমের মাধ্যমে করা যায়। নিমগাছ সারা বছর রোপণ করা যায়। তবে উপযুক্ত সময় হচ্ছে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। জুন-জুলাই মাসে বীজ সংগ্রহ করে ১০-১৫ দিনের মধ্যে বীজ বপন করতে হয় চারা উৎপাদন করার জন্য। চারার বয়স এক বছর হলে রোপণ করা যায়। বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে নিমগাছ খুবই সহজে বৃদ্ধি পায়।
নিমের পাতা থেকে বর্তমানে প্রসাধনীও তৈরি হচ্ছে। কৃমিনাশক হিসেবে নিমের রস খুবই কার্যকরী। নিম ছত্রাকনাশক হিসেবে, ব্যাকটেরিয়ারোধক হিসেবে, ভাইরাসরোধক হিসেবে, কীটপতঙ্গ বিনাশে, ছত্রাক রোধ ও নিয়ন্ত্রণে, ম্যালেরিয়া নিরাময়ে, দন্ত চিকিৎসায়, ব্যথা ও জ্বর কমাতে, জন্ম নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়। নিমের কাঠ খুবই শক্ত। এই কাঠে কখনো ঘুণ ধরে না। পোকা বাসা বাঁধে না। উইপোকা খেতে পারে না। এই কারণে নিম কাঠের আসবাবপত্রও বর্তমানে তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই বাদ্যযন্ত্র বানানোর জন্য এর কাঠ ব্যবহার করা হয়।
তবে অতিরিক্ত নিমপাতা খেলে পেটের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। অন্তঃসত্ত্বাদের নিমপাতা ব্যবহারে সাবধান থাকতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, নিমপাতা খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া, বিশেষ করে যারা কোনো ওষুধ সেবন করছেন।
নিমগাছ আমাদের পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। এর উপকারিতা শুধু স্বাস্থ্যগত ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি পরিবেশ সুরক্ষা, কৃষিকাজ এবং বাণিজ্যিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
তারেক