ঢাকা ১ শ্রাবণ ১৪৩২, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
English

পাখি যখন নৃত্যশিল্পী

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ০৩:৫৬ পিএম
আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫, ০৩:৫৮ পিএম
পাখি যখন নৃত্যশিল্পী
ছবি: সংগৃহীত

প্রেয়সীকে কাছে পাওয়ার আশায় যেকোনো পুরুষই তার ভালো লাগা, মন্দ লাগার বিষয়টি মাথায় রেখে তাকে খুশি করার চেষ্টা করে। এই বিষয়টির ব্যত্যয় ঘটেনি পক্ষীকূলের মধ্যেও। ওয়েস্টার্ন প্যারোটিয়া পাখিদের মধ্যে অন্যতম, যে কিনা স্ত্রী প্যারোটিয়াকে আকৃষ্ট  করতে তার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করে।

পুরুষ প্যারোটিয়া স্ত্রী প্যারোটিয়াকে প্রেম নিবেদনের আগে পূর্বপরিকল্পনা করে। যাতে স্ত্রী প্যারোটিয়া তাকে প্রত্যাখ্যান করতে না পারে। পুরুষ প্যারোটিয়া স্ত্রী প্যারোটিয়াকে আমন্ত্রণের আগে নির্ধারিত স্থান নিখুঁতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। এরপর নিজেকে প্রস্তুত করে সুমধুর কণ্ঠে প্রেয়সীকে ডাকে। স্ত্রী প্যারোটিয়া আসার পর পুরুষ প্যারোটিয়া প্রথমেই তাকে মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন করে। এরপর অসাধারণ কলাকৌশলে নৃত্য প্রদর্শন করে।

ওয়েস্টার্ন প্যারোটিয়া আরফাক প্যারোটিয়া নামেও পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Parotia Sefilata। এটি প্যারাডাইস প্রজাতির একটি আকর্ষণীয় উজ্জ্বল ও দীপ্তিমান পাখি। ওয়েস্টার্ন প্যারোটিয়া Paradisaeidae পরিবারভুক্ত, যা ‘Birds of Paradise’ নামে পরিচিত। এই পরিবারের পাখিরা তাদের সৌন্দর্য, রং এবং বিবাহ প্রদর্শনীর জন্য বিখ্যাত।

এটি ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম পাপুয়া অঞ্চলের ভোগেলকপ উপদ্বীপের আরফাক পর্বতমালার কুয়াশাচ্ছন্ন গভীর পাহাড়ি অরণ্যে পাওয়া যায়। এখানে খাদ্য সহজলভ্য। এখানে প্রচুর মস, ফার্ন ও গাছ রয়েছে। ওয়েস্টার্ন প্যারোটিয়া সাধারণত ১২০০-২০০০ মিটার উচ্চতায় বসবাস করে।

ওয়েস্টার্ন প্যারোটিয়া সাধারণত সর্বভুক পাখি অর্থাৎ সব ধরনের খাবার খায়। এরা প্রধানত বিভিন্ন ধরনের ফল, বীজ, কীটপতঙ্গ ও মাকড়সা খায়।

প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় ও অনন্য সৌন্দর্যের অধিকারী পুরুষ প্যারোটিয়া আকৃতিতে ৩৩ সেমি হয়। এর পুরো শরীর গাঢ় চকচকে কালো রঙে আবৃত থাকে, যা সূর্যের আলোয় ঝলমল করে। বুকের সামনে সোনালি-সবুজ রঙের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। চোখের গাঢ় নীল রং যে কাউকেই আকৃষ্ট করে। মাথার দুই পাশে থাকে তারের মতো সরু মোট ছয়টি অ্যান্টেনা, যা সে নৃত্য শিল্পকর্মে ব্যবহার করে।

অন্যদিকে স্ত্রী প্যারোটিয়া পুরুষ প্যারোটিয়ার তুলনায় ফ্যাকাশে রঙের হয়ে থাকি। বাদামি রঙের ওপর গাঢ় দাগ যুক্ত, যা তাকে আত্মগোপন করতে সাহায্য করে।
ওয়েস্টার্ন প্যারোটিয়ার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রেমের নৃত্য। পুরুষ পাখিরা স্ত্রী পাখিদের মন জয় করতে এক নিখুঁত নৃত্য প্রদর্শন করে। তারা বনভূমির একটি ছোট অংশ পরিষ্কার করে ‘নাচের মঞ্চ’ তৈরি করে এবং সেই খোলা স্থানে স্ত্রী পাখি এলে শুরু হয় মূল নৃত্য।

নাচের সময় পুরুষ পাখি নিজের পালক ফুলিয়ে তোলে, উজ্জ্বল বক্ষের পালক উন্মুক্ত করে, মাথার পালক ছড়িয়ে দেয় এবং ধীরে ধীরে একটি গোলাকার ভঙ্গিমায় চলাফেরা করে- যা একটি রোমান্টিক টুটু স্কার্টের মতো দেখায়। সেই সঙ্গে সে মাঝে মাঝে মাথা নিচু করে চোখের নীল ঝলক এবং গলার রঙিন পালক দেখিয়ে আকর্ষণ বাড়ায়। এই জটিল ও সুনির্দিষ্ট নৃত্যের মাধ্যমে স্ত্রী পাখিকে প্রভাবিত করে।

মোহময় রূপের অধিকারী হওয়ায় পাখিটি প্রকৃতির সৌন্দর্য ও বিবর্তনের এক বিস্ময়কর উদাহরণ। তবে বন উজাড়, পাখি শিকার ইত্যাদি কারণে এর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। প্রকৃতির এসব অনন্য সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

 

তারেক

সমুদ্রের বিরল মাছ পাইপ ফিশ

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৪ পিএম
সমুদ্রের বিরল মাছ পাইপ ফিশ
ছবি: সংগৃহীত

মহাসাগরের বিশাল জলরাশিতে রয়েছে ২ লাখ ২৮ হাজার ৪৫০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদ। এর মধ্যে পাইপ ফিশ অন্যতম (Pipe Fish)। পাইপ ফিশ দেখতে ছোট মুখবিশিষ্ট সোজা দেহের সামুদ্রিক ঘোড়ার মতো। আবার একে দেখতে অনেকটা সাপের মতোও লাগে।

পাইপ ফিশ হলো দাঁতহীন, খুব সরু, লম্বা দেহের মাছ, যা হাড়ের বর্ম দিয়ে আবৃত। তাদের লম্বা নলাকার থুতনি এবং ছোট মুখ, একটি একক পৃষ্ঠীয় পাখনা এবং সাধারণত একটি ছোট লেজের পাখনা থাকে। পাইপ ফিশের বেশির ভাগ প্রজাতি সাধারণত ৩৫-৪০ সেমি (১৪-১৫.৫ ইঞ্চি) লম্বা হয়ে থাকে।

পাইপ ফিশ ছোট জলজ প্রাণীর ওপর আক্রমণ করে এবং দ্রুত মুখে পুরে নেয়। এ মাছ খাবার চুষে খেতে পছন্দ করে।

ভেলন সারিয়া নামে এক ধরনের ঘাস আছে সমুদ্রের জলরাশিতে। সেই ঘাসেই এদের বাসস্থান। বিশেষ করে ইলগ্রাস, প্রবাল প্রাচীরেও এদের দেখা মেলে। ভেলন সারিয়া ঘাসের আড়ালে পাইপ ফিশ লুকিয়ে থাকায় অন্যান্য জলজ ও মাছখেকো প্রাণীরা এদের খুব একটা দেখতে পায় না।

বেশির ভাগ পাইপ ফিশের জীবনযাপন সমুদ্র কেন্দ্রিক। তবে কয়েকটি পাইপ ফিশ মিঠা পানির প্রজাতি। এদের বসবাসের স্থান সাধারণত ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের উপকূলে এগুলো প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। কিছু প্রজাতির পাইপ ফিশের লেজ প্রিহেনসিল থাকে। বেশির ভাগ পাইপ ফিশের পুচ্ছ পাখনার কিছু রূপ থাকে, যা চলাচলের জন্য ব্যবহার করে থাকে। যদিও পাইপ ফিশ সামুদ্রিক প্রাণী তবুও এরা খুব ভালো একটা সাঁতার জানে না।

পাইপ ফিশের প্রজনন প্রক্রিয়াটি খুব অদ্ভুত এবং বিরল। আমরা জানি গর্ভধারণ করে স্ত্রী প্রজাতির প্রাণীগুলো। কিন্তু গর্ভধারণের ক্ষেত্রে পাইপ ফিশ ও সি-হর্স ফিশ পুরোই উল্টো। পাইপ ফিশ ও সি-হর্স ফিশের পুরুষরাই গর্ভধারণ করে এবং প্রসবের বেদনা সহ্য করেই বাচ্চা প্রসব করে।

মিলনের সময় স্ত্রী পাইপ ফিশটি তার শুঁড় দিয়ে পুরুষ পাইপ ফিশের শাবক থলিতে ডিম প্রবেশ করিয়ে দেয়। এ সময় পুরুষ পাইপ ফিশটি এস (S) আকৃতি ধারণ করে এবং ডিমকে ফার্টিলাইজ করতে থাকে। মিলনের একপর্যায়ে পুরুষ পাইপ ফিশটি সেই উর্বর ডিমে তার স্পার্ম নিক্ষেপ  করে। অতঃপর পুরুষ পাইপ ফিশটি কয়েক সপ্তাহ নিজের গর্ভে সন্তানকে ধারণ করে এবং বাচ্চা পাইপ ফিশ জন্ম দেয়। স্ত্রী পাইপ ফিশ পুরুষের জনন থলিতে ডিম পাড়ে। এটি থাকে তাদের মাথার কাছে। থলিতে ডিমগুলো নিষিক্ত হয় এবং দুই সপ্তাহ পর্যন্ত ডিমে তা দেয় পুরুষ পাইপ ফিশ। এরপরই বাচ্চা ফুটে বের হয়। পুরুষ পাইপ ফিশ তাদের জনন থলিতে ৫ থেকে ৪০টি ছানা ধারণ করতে পারে।

পুরুষ পাইপ ফিশ তার সঙ্গী যে স্ত্রী পাইপ ফিশের থেকে ডিম এনেছে, তাকে যদি পরবর্তী সময়ে আর পছন্দ না হয় তাহলে ছানাগুলোর খুব একটা যত্ন নেয় না পুরুষটি। অন্যদিকে বড়, আকর্ষণীয় স্ত্রী পাইপ ফিশের ডিম ও বাচ্চার জন্য পুরুষ পাইপ ফিশটি বেশি পুষ্টি সরবরাহ করে ও যত্ন নেয়।

বাচ্চারা জন্মের পর থেকেই স্বাধীনভাবে সাঁতার কাটতে শুরু করে। এবং তারা তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য খাওয়া শুরু করে। ডিম ফুটে বের হওয়ার পর থেকে বাচ্চা পাইপ ফিশরা তাদের বাবা-মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায়। স্বাধীন হয়ে চলাফেরা করে এবং খাদ্য খোঁজে। তবে এই পাইপ ফিশরা তাদের একেক বাচ্চার জন্য একেক ধরনের যত্নআত্তি করে থাকে। ছানা যদি সুস্থ-সবল হয় তাহলে সেটির প্রতি তেমন একটা নজর দেয় না। তবে যদি বাচ্চা দুর্বল হয় তাহলে তাকে চোখে চোখে রেখে যত্ন করে বড় করে বাবা পাইপ ফিশ।

পাইপ ফিশের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে জোড়া বন্ধন ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। যদিও কিছু একগামী, অন্যরা তা নয়। অনেক প্রজাতি বহু-পত্নীকতা প্রদর্শন করে। এ এমন একটি প্রজনন ব্যবস্থা যেখানে একজন স্ত্রী দুই বা ততোধিক পুরুষের সঙ্গে মিলন করে।

সাঁতার কাটার ক্ষমতা কম থাকার কারণে পাইপ ফিশ প্রায়শই অগভীর পানিতে পাওয়া যায়। নৌকা চলাচলের কারণে উপকূলীয় পলি সরে যায়। ফলে পাইপ ফিশের আবাসস্থলে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক ঘাস এবং ইলগ্রাসের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। পাইপ ফিশের স্বল্পতা ইঙ্গিত দেয় যে তারা আবাসস্থল পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম নয়।

ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধ তৈরিতে পাইপ ফিশের উচ্চ চাহিদা রয়েছে। পাইপ ফিশের ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাওয়ার জন্য এটিও অন্যতম একটি কারণ।

 

তারেক

পাঠকের লেখা : জীবনের নকশা

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৫ পিএম
পাঠকের লেখা : জীবনের নকশা

সেদিন ভূমি অফিসে গিয়েছিলাম জীবনের নকশা বের করতে। বের করতে তো পারলামই না, উল্টো জলি ম্যাডাম আমার কথা শুনে এমন অবাক হলো, যেন বোবার মুখে কথা ফুটেছে। আমাকে দেখার পিয়াস যেন ওনার মিটছেই না, স্থিরচোখে আমার মুখের দিকে শুধু তাকিয়ে রইল। হয়তো পাগল মনে করেছে।

তিনি জীবনের নকশা দিতে পারলেন না এবং দেখাতেও পারলেন না। ফিরে এসে, পরে ভাবতে ভাবতে আমিই পেয়ে গেলাম আমার জীবনের নকশা। স্থির করলাম, আমার জীবননকশার ওপর থাকবে একটি গাছ। গ্রামবাংলার হিজল গাছ। আর তার নিচে শুয়ে থাকব আমি। এটাই হবে আমার জীবননকশা, জীবনের ভূমি।

জীবননকশার ওপরে হিজল গাছটি লাগানোর জন্য যেই গর্ত খুঁড়তে যাব, আমারই মতো দেখতে, আমারই অন্তরাত্মা হবে হয়তো। ও পেছন থেকে বলল-
– এই দুপুরবেলা কেউ গাছ লাগায়?

আমি গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তেই বললাম,

– দুপুরেই লাগায়।

– পাগলের যেই কথা।

– পাগল-পাগল কইরো না তো।

– পাগল রে তো পাগলই কইতে হয়। শোন এইসব পাগলামি বাদ দিয়ে সংসারমুখী হ। 

– সংসার কইরা কোন হালায় ভালো রইছে? সংসার করার পর সব হালায় কয়, আহারে যদি আগের জীবনটা পাইতাম!

– তবুও সংসার করতে হয়, বিশ্রামের জন্য একটা ঘর তৈরি করতে হয়।

– আমি ঘরই তৈরি করতাছি।

– কী ঘর তৈরি করতাছত?

– এই যে।

– এই যে কী?

গাছটি লাগিয়ে পানি ছিটিয়ে দিতে দিতে আমি বললাম,

– সবাই তো বাড়ি করে, গাড়ি করে, সুন্দর একটা নারীও আনে। আমি না হয় ভিন্ন কিছু করলাম।

– আরে কী কইতাছত তুই?

ওর কথায় কান না দিয়ে বললাম,

– দেখো কী সুন্দর জায়গা এটা। শীতের সময় চারপাশে সরিষা, হেমন্তকালে চারপাশে পাকা ধান, তার মধ্যে একটা হিজল গাছ। আর তার নিচে একটা কবর। দেখো কল্পনা করে দেখো, কী সুন্দর! এর চেয়ে সুন্দর বাড়ি আছে কও?

– কী কছ তুই?

– আমি ঠিকই কই।

– এই জায়গা তর নামে আছে তো? 

– না, এহনো আমার নামে করি নাই।

হাহা হিহি, ও হাসল।

– হাসো কেন?

– এই পৃথিবীতে এক ইঞ্চি জায়গা কেউ ছাড়ে না, তর নামে যদি না দেয়?

–   বাকি যেইগুলা আমার নামে আছে, সবগুলা তাদের নামে লেইখা দিমু, তাইলেই তো দিব। বিনিময়ে আমি শুধু এই জায়গাটুকু চাই। 

আমি বাঁশের খুঁটি গেড়ে, গাছটি বেড়া দিতে লাগলাম। ও আমার সামনাসামনি একটু দূরে ঘাসের ওপরে বসল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কী জানি দেখল, হয়তো প্রকৃতির সৌন্দর্য। রোদের তাপে ওর কপালে পিঁপড়ের সারির মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। তীব্র রোদের কারণে পুরোপুরি চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না। তাই ভ্রু কুঁচকে ও বলল,

– খারাপ হবে না। 

– কী?

– তর জীবননকশা, জীবনের ভূমি।

– আমি জানি তো খারাপ হইব না। দেইখো একদিন ওই কাঁচা রাস্তার ধারে সাইকেল রেখে, প্রিয়তমা-প্রিয়তমরা বসে বসে আমার জীবননকশা দেখব। ডুবন্ত সূর্য দেখব। আর বাদাম খাইব। অনেক কবি-সাহিত্যিক কবিতা-গল্পও লেখার চেষ্টা করব আমার জীবনী এবং কবর নিয়া।

– সব রেখে কবর গড়ার শখ হলো কেন?

– আমি অনেক কবরস্থান ঘুইরা দেখছি, জঙ্গলে ঢাইক্কা রইছে। বন্যপ্রাণী মল ত্যাগ কইরা থুইছে কবরের ওপরে। তারা দুনিয়ায় থাকতে খুব নামি-দামি ছিল, অথচ তাদের কবরে বন্যপ্রাণীর মল। তারা কি ভাগ্যবান বলো?  ‘সে জীবনে চরম ব্যর্থ, যে সুন্দর একটা কবর পায় না।’

– তুই যে এইহানে কবরস্থ হবি গ্যারান্টি কী? 

– কোনো গ্যারান্টি নাই।

– তাইলে এই পাগলামি করতাছত কেন?

– হুনো, দয়াময় মানুষের অন্তর দেখে। সুতরাং আমি দিন-দুনিয়া ত্যাগ করে, দয়াময়কে ভালোবেসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, এটাই আমার কাছে অনেক বড়। আমি মরার পর মানুষ আমাকে এইহানে কবরস্থ না করলে, আমি ঠকমু না, বরং ওরাই ওগো ঠকাইবো। 

অনেকক্ষণ হয় আমরা দুজনের কেউই কোনো কথা বলছি না, দুজনেই চুপ। আমি বেড়া দেওয়া শেষ করে বললাম, দেইখা যাও কেমন হইল। ও এসে দেখল, আমার পিঠে হাত দিয়ে কিছু বলতে চেয়েও না বলে চলে যেতে লাগল। ও রাস্তায় উঠেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমিও চলে যেতে লাগলাম। কিছুদূর এসে আবার পেছন ঘুরে দাঁড়ালাম।

চৈত্রের ভীষণ রোদ, খাঁ খাঁ করছে চারদিক। রাস্তার এপাশে-ওপাশে কোনো কৃষক, কিংবা পথচারী নেই। আমি কল্পনা করতে লাগলাম জায়গায় দাঁড়িয়েই। গাছটি বড় হয়ে গেছে, তার নিচে আমার কবরটি। ওই তো কবরটি। কল্পনা করলাম হেমন্তকালে পাকা ধানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি, আমার কবর নিয়ে। দাঁড়িয়ে আছে সরিষার মধ্যেও, আমার কবর নিয়ে হিজল গাছটি। পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তাটিও মিলছে গিয়ে ওই গ্রামে, কী অসাধারণ দৃশ্য। সূর্যটিও ডুবতে শুরু করেছে, সাইকেল চালিয়ে ডাকপিয়নটিও হচ্ছে বাড়িমুখী। প্রিয়তমা প্রিয়তমরা রাস্তার পাশে বসে বাদাম খাচ্ছে আর ডুবন্ত সূর্য দেখছে। ওই তো আমার জীবননকশা, জীবনের ভূমি। আমার মৃত্যুর পর কেমন হবে, তা এখানে দাঁড়িয়েই কল্পনা করে দেখে নিলাম। ‘সবাই বাড়ি করে, গাড়ি করে। আমি না হয় সুন্দর একটা কবর গড়ার স্বপ্নই দেখলাম।’

 

বিলাসপুর, জাজিরা
শরীয়তপুর

 

তারেক

জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে উদ্ভাবন

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৭ পিএম
আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৮ পিএম
জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে উদ্ভাবন
গ্রেট গ্রিন ওয়াল হলো আফ্রিকান নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ, যা মরু অঞ্চলজুড়ে মরুকরণ এবং ভূমি অবক্ষয় মোকাবিলা করার লক্ষ্যে কাজ করে। ছবি: সংগৃহীত

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সারা বিশ্বে স্পষ্ট। তবুও মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা ঠেকাতে সারা বিশ্বে বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রকল্প চলছে। তেমনি কিছু প্রকল্প এখানে তুলে ধরা হলো, যা সব দেশে অনুকরণীয় হতে পারে।

সবুজ দেয়াল: আফ্রিকা মহাদেশের সবুজের হাহাকার এবং উত্তপ্ত মরুর কথা আমরা জানি। যেখানে সজীবতার বড়ই অভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাহারা মরুভূমির মরুকরণ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এই মরুকরণ ঠেকাতে ‘গ্রেট গ্রিন ওয়াল’ নামে এক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগে মরুভূমিতে বিশাল উদ্ভিদের সবুজ দেয়াল তৈরি করা হবে। গ্রেট গ্রিন ওয়াল হলো আফ্রিকান নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ, যা মরু অঞ্চলজুড়ে মরুকরণ এবং ভূমি অবক্ষয় মোকাবিলা করার লক্ষ্যে কাজ করে। এটি পশ্চিমে সেনেগাল থেকে পূর্বে জিবুতি পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০০৭ সালে আফ্রিকান ইউনিয়নের চালু করা এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ মিলিয়ন হেক্টর অবক্ষয়িত জমি পুনরুদ্ধার করা, ২৫০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত করা এবং ১ কোটি সবুজ কর্মসংস্থান তৈরি করা। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার। ২০টি দেশে বিস্তৃত এই কার্যক্রম ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি হেক্টর জমি পুনরুদ্ধার করেছে, যা তার লক্ষ্যমাত্রার ৩০% অর্জন করেছে। তবে এর লক্ষ্য কয়েক বিলিয়ন গাছ লাগানো এবং আফ্রিকা থেকে শুষ্কতা দূর করা। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এই উদ্যোগ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে বিশ্বে। জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটে ভোগা অন্যান্য দেশের জন্য এটি অনুকরণীয় হতে পারে।

জীবন্ত উপকূল রেখা: ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে এই উদ্যোগ। যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড়ের ক্ষতি থেকে বাঁচতে জীবন্ত উপকূল রেখা তৈরি করা হয়েছে। জীবন্ত উপকূল রেখা হলো প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান, যা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে ক্ষয় এবং ঝড়ের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয়েছে; যা একই সঙ্গে প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণ এবং উন্নত করে। সমুদ্রের প্রাচীরের মতো ঐতিহ্যবাহী শক্ত কাঠামোর বিপরীতে, জীবন্ত উপকূল রেখাগুলো উপকূল রেখাকে স্থিতিশীল করার জন্য গাছপালা, বালু এবং পাথরের মতো প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে, যা প্রাকৃতিক উপকূলীয় প্রক্রিয়াগুলোকে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে। জীবন্ত উপকূল রেখায় গাছপালা, ঝিনুকের প্রাচীর এবং জৈব-অবিচ্ছিন্ন পদার্থের মতো উপাদান রয়েছে, যা একটি স্থিতিশীল এবং স্থিতিস্থাপক উপকূলীয় প্রান্ত তৈরি করে। এ ধরনের উদ্যোগ শুধু উপকূলকে ঝড় থেকে রক্ষা করে না, বরং সেখানকার বাস্তুতন্ত্রকেও ভালো রাখে। এই প্রাকৃতিক উপকূল সমুদ্রের বিশাল তরঙ্গ স্তিমিত করে দেয়। যার ফলে ক্ষয়ক্ষতি কমে আসে। যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লোরিডা, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বৃক্ষ সুনামি: দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশাল উদ্যোগ নিয়েছে। দেশটি বৃক্ষ সুনামি বা ট্রি সুনামি নামে একটি উদ্যোগ নিয়েছে। পাকিস্তানের ১০ বিলিয়ন ট্রি সুনামি প্রকল্প ২০১৮ সালে শুরু হওয়া একটি উচ্চাভিলাষী বনায়ন উদ্যোগ, যার লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, অবনমিত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং দেশজুড়ে জীববৈচিত্র্য উন্নত করা। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে বিলিয়ন ট্রি সুনামি ৩ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর বন এবং ক্ষয়প্রাপ্ত জমি পুনরুদ্ধার করেছিল। তাই দেশটির সরকার সারা দেশে ১০ বিলিয়ন গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেছে। ৭০০ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পের লক্ষ্য- পাকিস্তানের প্রাকৃতিক অবক্ষয় রোধ করা, যা ১৯৯০ 
থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং ৮৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান তৈরি করা।

 

তারেক

কানাত: প্রাচীন পারস্যের এক অনন্য নিদর্শন

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৬:০৩ পিএম
আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৬:০৩ পিএম
কানাত: প্রাচীন পারস্যের এক অনন্য নিদর্শন
ছবি: সংগৃহীত

এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ইরান। দেশটিকে আগে পার্সিয়া বা পারস্য বলে ডাকা হতো। তবে ১৯৩৫ সালে পারস্যের নাম হয় ইরান।

সভ্যতার ইতিহাসে ইরান বেশ প্রাচীন এবং অত্যন্ত শক্তিশালী স্থান দখল করে আছে। মানবসভ্যতার দিক থেকে সাড়া জাগানো বেশ কিছু প্রাচীন নিদর্শনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে এই দেশে।

প্রাচীন ইরান ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানে এক সমৃদ্ধশালী অঞ্চল। ইরান কিন্তু কোনো সমভূমির দেশ নয়। এর ভূপ্রকৃতি রুক্ষ এবং বন্ধুর। ইরানের চারপাশে প্রচুর পাহাড়-পর্বত রয়েছে। সেসব পর্বতমালা পারস্য উপসাগর আর ওমান সাগরের তীরে এসে আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে বিরাট মরুভূমির প্রান্তে এসে মিশেছে। ইরানের মরুভূমি শুষ্ক আর দুর্গম। দেশটির মোট আয়তনের মধ্যে মরুভূমি প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো, এমন দুর্গম মরুভূমি ও পাহাড়-পর্বতের বেষ্টনীর মাঝেও ইরান ছিল বেশ উন্নত ও প্রভাবশালী দেশ।

এখনো ইরানের অনেক প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে, যা জাতি হিসেবে তাদের আজও পৃথিবীর বুকে গর্বের আসনে আসীন করে রেখেছে। যার প্রমাণ, ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া ইরানের ২১টি প্রাচীন স্থাপনা ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। যার অন্যতম হচ্ছে প্রাচীন ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের আশ্চর্যকর নিদর্শন ‘কানাত’। 

আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগের ঘটনা। প্রাচীন ইরানে মরুভূমিগুলোতে পানীয় জলের অভাব ছিল ভীষণ। পানির অভাবে জনজীবন ছিল নিদারুণ কষ্টের। আর তাই তৎকালীন শাসক তার সাম্রাজ্যের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে বসলেন। যার ফলশ্রুতিতে তৎকালীন শাসকের সহযোগিতা আর বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হলো- কানাত। বৈপ্লবিক আবিষ্কার কানাত পাহাড়ের পাদদেশ থেকে মরুভূমির নিচ দিয়ে খাল খননের মাধ্যমে মূল শহর পর্যন্ত পানির ব্যবস্থা করে পুরো ইরানের চেহারাই পাল্টে দিয়েছিল। তবে পরিকল্পনার পর, পুরো বিষয়টিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া ছিল বেশ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। কারণ ইরানের পাহাড়-পর্বতগুলোর বেশির ভাগই কঠিন শিলা পাথরের। পাথুরে মাটি খনন করা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। আবার পাহাড়ি অঞ্চল থেকে মূল শহরের দূরত্বও ছিল অনেক।

তবে পারস্যের সম্রাট সব বাধা উপেক্ষা করে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছিলেন অনড়। অতঃপর শুরু হলো পরিকল্পনামাফিক কাজ। মরুভূমির বুক চিরে অনেক গভীরে গর্ত করে পরপর নির্দিষ্ট দূরত্বে তৈরি করা হয়েছে একই রকম গর্ত। ইংরেজি ভাষায় এদের পোশাকি নাম চ্যানেল। চ্যানেলগুলোর মধ্যে মানুষ ঢুকে নিচে তলদেশে গিয়ে মাটি খুঁড়ে একটি সরু খাল খনন করত। সেই খাল শহরের মধ্যে বিভিন্ন নির্দিষ্ট স্থানে ছড়িয়ে পড়ত। বালু ও নুড়ি পাথরের মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো বলে এই পানি ছিল বেশ পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ। পান করা, রান্নাবান্না ছাড়াও কৃষি কাজে ব্যবহার হতো কানাতের পানি। এসব চ্যানেলে পানি সরবরাহের পাশাপাশি ধরে রাখারও ব্যবস্থা ছিল। তবে শঙ্কা ঠিকই ছিল, এই পদ্ধতি কতটা কাজ করবে তা নিয়ে। তবে ভয়কে জয় করা সম্ভব হয়েছিল বলেই তৎকালীন মরুভূমির বুকে গড়ে ওঠা পারস্য সভ্যতার দেশ ইরান আজ দাপটের সঙ্গে বিশ্ব দরবারে দাঁড়িয়ে আছে।

তবে কাজ শুরু করার প্রথম ধাপটি ছিল বেশ কঠিন। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে মাটি খনন করতে হতো, তৈরি করা হতো সুড়ঙ্গ। যতক্ষণ না পানির দেখা মিলছে, ততক্ষণ পাথুরে মাটি খনন চালিয়ে যেতে হতো। স্বাভাবিকভাবেই প্রাচীনকালে এখনকার মতো আধুনিক ড্রেজিং যন্ত্রপাতির চিন্তাই করা যেত না। তাই প্রাচীন হাতুড়ি-শাবল ছিল বলা চলে একমাত্র সম্বল। খনন করা সুড়ঙ্গ দিয়ে নিচে নামার জন্য ব্যবহার করা হতো একটি বাঁশ-কাঠের তৈরি চরকার চাকার মতো প্রযুক্তি। তাতে করে শ্রমিকদের সুড়ঙ্গে নামানো হতো, আবার নিচ থেকে মাটিও তুলে আনা হতো। পানির সন্ধান পাওয়ার পর আরেকটি সুড়ঙ্গ কাটা হতো, যেটি চলে যেত পাহাড়ের ঠিক অপর পাশে। আড়াআড়ি সুড়ঙ্গটি এমনভাবে তৈরি করা হতো, যাতে করে পানি মাটির নিচের দিকে ভালোভাবে প্রবাহিত হওয়ার ব্যবস্থা থাকে। আর মাঝের চ্যানেলগুলোর কাজ ছিল, পানি প্রবাহের ধারায় বাতাসের পর্যাপ্ত চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

চ্যানেলগুলো এতই গভীর থাকত যে, কোনো ধরনের দূষণের ভয় থাকত না। এমনকি মরু তাপের কারণে নিচে পানি শুকিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকত না। কঠোর পরিশ্রমে নির্মিত কানাতগুলো ঠিকঠাক রাখার জন্য নিয়মিত দেখভালের পাশাপাশি বছরে বছরে মেরামত করতে হতো। এই পানি এতটাই পরিষ্কার এবং বিশুদ্ধ ছিল যে, লোকজন নিঃসংকোচে পান করত এবং পানিবাহিত কোনো রোগবালাইয়ের ভয়ও ছিল না। মাটির নিচে প্রবহমান খালগুলোর শেষ মাথায় পানি সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকত। লোকজন চাইলেই তাদের প্রয়োজনীয় পানি ব্যবহার করতে পারত। পানি নিয়ে শাসকশ্রেণি থেকে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। তবে পানির অপচয় রোধে সবাই যথেষ্ট সচেষ্ট ছিল। অনেক ধনী ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে মূল চ্যানেল থেকে নিজেদের ঘরে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন।

সবচেয়ে প্রাচীন ও দীর্ঘতম কানাতের অবস্থান ইরানের কেন্দ্রে অবস্থিত খোরাসান প্রদেশের জার্ক শহরে। তবে গোনাবাদের কানাত সবচেয়ে প্রসিদ্ধ, যেটি ইউনেসকো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে অন্তর্ভুক্ত হয় ২০০৭ সালে। আর ২০১৬ সালে আরও ১০টি কানাতকে বিশ্ব ঐতিহ্য বলে ঘোষণা করা হয়। তাই এই সংখ্যা এখন ১১টি। অন্য ১০টি কানাত হলো- হাসাম আবাদ-ই মশির, বালাদেহ, জারচ, ইবরাহিম আবাদ, ভাজভান, মোজদ আবাদ, দি মুন, গোওহারিজ, কাসেম আবাদ এবং আকবর আবাদ।

তবে কানাতের শুরু প্রাচীন ইরানে হলেও পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি দেশ পানির চাহিদা মেটাতে এই যুগান্তকারী পদ্ধতি অনুসরণ করে। যার মধ্যে ছিল বর্তমান মরক্কো, স্পেন, আলজেরিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তানের মতো মরু ও পাহাড়বেষ্টিত দেশ। 

আশঙ্কার কথা হচ্ছে, পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিছু কানাত। ইউনেসকোর একটি দল এই কানাতগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কাজে সার্বিকভাবে সহায়তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। তাদের মতে, এটি শুধু একটি প্রাচীন ব্যবস্থাই নয়, বরং এটি এক ঐতিহাসিক নিদর্শন, যা আমাদের সবার টিকিয়ে রাখা উচিত।

 

তারেক

যে অনুষ্ঠানে হবু দম্পতিরা জঞ্জাল সাফ করেন

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ০২:১৮ পিএম
যে অনুষ্ঠানে হবু দম্পতিরা জঞ্জাল সাফ করেন
ছবি: সংগৃহীত

কল্পনা করুন, কোনো এক সুনসান শান্ত শুক্রবার সন্ধ্যায় জার্মানির একটি উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছেন। খলবলিয়ে হাসি-ঠাট্টার শব্দ শোনা যাচ্ছে। হবু বর ও কনে একসঙ্গে হাঁটু গেড়ে ঝাড় দিয়ে সাফসুতরো করছে উঠোনময় চীনামাটির ভাঙা থালাবাসনের জঞ্জাল। না, এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি হচ্ছে পোল্টেরাবেন্ড, জার্মানির সবচেয়ে প্রাণবন্ত প্রতীকী ঐতিহ্যবাহী বিয়েপূর্ব আচারানুষ্ঠান। 

শুধু হুল্লুড়েপনার নিছক এক আনন্দময় বিয়ের অনুষ্ঠান নয়, পোল্টেরাবেন্ড আরও অনেক বেশি কিছু। এ অনুষ্ঠানে পুরো সম্প্রদায়কে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং এটি সহযোগিতা, সমস্যা সমাধান ও হাস্যরসের এক ঐকতানে পরিণত হয়।

পোল্টেরাবেন্ড কী? 

পোল্টেরাবেন্ড (পোল্টার্ন, যার অর্থ ‘শব্দ করা’ এবং অ্যাবেন্ড, অর্থ ‘সন্ধ্যা’) হলো একটি বিয়েপূর্ব অনুষ্ঠান, যা সাধারণত নাগরিক অনুষ্ঠানের আগের রাতে অনুষ্ঠিত হয়। এটি বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, সহকর্মী এবং সম্প্রদায়ের সব পরিবারের জন্য উন্মুক্ত। অতিথিরা পুরোনো চীনামাটির বাসনকোসন নিয়ে আসেন এবং হবু দম্পতির সামনে আছড়ে আছড়ে সেসব ভেঙে ফেলেন। মহা আনন্দের এক ধুন্ধুমার হই-হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। ভাঙা চীনামাটির বাসনকোসনে সয়লাব হয়ে যায় পুরো উঠোন। হবু বর ও কনেকে তখন একসঙ্গে সেসব জঞ্জাল সাফ করতে হয়। নতুন দম্পতি হিসেবে এটি তাদের প্রথম যৌথ কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা।

পোল্টেরাবেন্ডের উৎপত্তি এবং সাংস্কৃতিক শিকড়

পোল্টেরাবেন্ডের ঐতিহ্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে এবং ইতিহাসবিদদের বিশ্বাস, এর শেকড় রয়েছে খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, যা হুল্লুড়ে শব্দের মাধ্যমে মন্দ আত্মাদের তাড়ানোর বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। চীনামাটির বাসনকোসন ভাঙার রয়েছে গভীর তাৎপর্য। যেমন-ক) অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা, খ) দুর্ভাগ্য দূর করা এবং গ) জীবনের অনিবার্য বিপর্যয়ের জন্য হবু দম্পতিকে প্রস্তুত করা। এর উদ্দেশ্য কখনোই ধ্বংসাত্মক ছিল না। বরং এর উদ্দেশ্য ছিল স্থিতিস্থাপকতা অর্জন, নবজীবন বিনির্মাণ এবং একাত্মতার চর্চা।

কী কী ভাঙা হয় আর কী কী একেবারেই ভাঙা হয় না

একটি যথার্থ পোল্টেরাবেন্ডে অতিথিরা ভাঙার জন্য আনেন পুরোনো চীনামাটির বাসনকোসন, সিরামিকের মগ বা ফুলদানি, মাটির পাত্র, মাটির ফুলদানি, টয়লেটের বাটি (হ্যাঁ, সত্যিই! তবে যদি পরিষ্কার থাকে)। কাচ, আয়না এবং স্ফটিক ভাঙা নিষিদ্ধ। কেন? জার্মান লোককাহিনী অনুযায়ী কাচ ভাঙা দুর্ভাগ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে চীনামাটির বাসনকে ইতিবাচক প্রতীকী শক্তির পাত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাসনকোসন ভাঙা জঞ্জালের স্তূপ যত পুরু হয় পোল্টেরাবেন্ডকে ততই সফল বলে বিবেচনা করা হয়। এর কোনো নির্ধারিত পোশাক থাকে না।

এই জঞ্জাল সাফসুতরো হচ্ছে হবু দম্পতির প্রথম যুগল পরীক্ষা। জঞ্জালের পরিমাণ খুব বেশি থাকে বলে এসব পরিষ্কার করা খুবই পরিশ্রমসাপেক্ষ। হবু বর ও কনের এই যৌথ পরিশ্রম যেসব তাৎপর্য তুলে ধরে তা হচ্ছে- একে অন্যের পাশে থেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া; দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়া এবং বিশৃঙ্খলাকে সহযোগিতায় রূপান্তর করা। দম্পতির ধৈর্য এবং পারস্পরিক সমঝোতা পরীক্ষার জন্য অতিথিরা বেশি বেশি থালাবাসন ভেঙে এবং নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে তাদের নাজেহাল করার চেষ্টা করেন।

 

তারেক