
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষকরা উদ্ভাবন করেছেন উচ্চফলনশীল বাউ মিষ্টিআলু-৫। এটি স্থানীয় জাতের তুলনায় তিন গুণ বেশি ফলনশীল এবং লাভজনক। প্রতিটি গাছে ১-১.৫ কেজি আলু ধরে। ৯০ দিনে ফলন পাওয়া যায়। এক হেক্টর জমিতে ৩০ টন ফলন হতে পারে। নতুন জাতটি চাষে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। এটি পুষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সারা বছর চাষ করা যায়।
শর্করার চাহিদা পূরণে পুষ্টিগুণে ভরপুর মিষ্টিআলু ভাতের বিকল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ২৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে মিষ্টিআলুর চাষ হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ, বি, সি ও বিভিন্ন খনিজ পদার্থ থাকায় এটি পুষ্টির অন্যতম ভালো উৎস। কিন্তু স্থানীয় জাতের উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়া, বাজারে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় মিষ্টিআলু চাষে কৃষকদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, মিষ্টিআলুর গড় উৎপাদন বাড়াতে এবং কৃষকদের লাভের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা উদ্ভাবন করেছেন ‘বাউ মিষ্টিআলু-৫’।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম আরিফ হাসান খান রবিনের নেতৃত্বে একদল গবেষক এ মিষ্টিআলুর উচ্চফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধী নতুন জাত বাউ মিষ্টিআলু-৫ উদ্ভাবন করেছেন।
প্রধান গবেষক অধ্যাপক এ বি এম আরিফ হাসান খান জানান, বাউ মিষ্টিআলু-৫ একটি উচ্চফলনশীল জাত। এটি সাধারণ আলুর চেয়ে তিন গুণ বেশি ফলনশীল, যার প্রতিটি গাছে এক থেকে দেড় কেজি আলু ধরে। চারা রোপণের ৯০ দিনের মধ্যে ফলন পাওয়া যায়। এ আলু সারা বছরই চাষ করার উপযোগী। বাউ মিষ্টিআলু-৫-এর প্রতিটি গাছ থেকে ১০০ দিনেরও বেশি বয়সে সর্বোচ্চ ফলন দেয়। সাধারণ আলু প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ২৫ টন ফলন দিলেও বাউ মিষ্টিআলু দেয় ৩০ টনের বেশি ফলন।
তিনি আরও জানান, চলতি মৌসুমে ময়মনসিংহ, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল ও খুলনায় বাউ মিষ্টিআলু-৫-এর চারা সরবরাহ করা হয়েছিল। আলু চাষ করে অধিক ফলন পেয়ে লাভবান হয়েছে চাষিরা।
ময়মনসিংহ সদর উপোজলার কৃষক হাসান বলেন, ‘এ জাতের আলু চাষ করে গড়ে আমরা প্রতি ১০ বর্গমিটারে ৩০ কেজি পর্যন্ত ফলন পেয়েছি। অন্যান্য স্থানীয় জাতের প্রতি গাছে ৭০০ থেকে ৭৫০ গ্রাম আলু ধরলেও এ জাতের আলুতে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত ফলন পেয়েছি।’
আরেকজন আলুচাষি বলেন, ‘আগে আমরা অনেক জমিতে আলু চাষ করতাম। তবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও বাজারে দাম কম পাওয়ায় চাষ করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বর্তমানে আবার এ নতুন জাতের আলু চাষ শুরু করেছি। একই উৎপাদন খরচে এর ফলন বেশি হওয়া আশা করছি লাভবান হতে পারব।’
ফুলপুরের কৃষক মনু মিয়া বলেন, ‘ফুলপুরে এ প্রথম বাউ মিষ্টিআলু-৫ নামের নতুন জাতের মিষ্টিআলু চাষে সফলতা পেয়েছি। প্রতি গাছে ২০০-৩০০ গ্রাম ওজনের ৬-৭টি আলু পর্যন্ত পেয়েছি।’
মিষ্টিআলুর জাত উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা দলের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মুন মোদক বলেন, ‘ক্রিম, বেগুনি ও কমলা- এ তিনটি রঙে আলুগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কমলা রঙের আলু গাজরের বিকল্প হিসেবে সালাদ হিসেবে খাওয়া যায়। বেগুনি রঙের আলু পুড়িয়ে খেলে দারুণ স্বাদ পাওয়া যায়। বিশেষ করে পোড়ানোর পর এতে গ্লুকোজ ও সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়। সাধারণ ক্রিম রঙের আলুগুলো সবজি হিসেবে রান্না করা যায়। আবার পুড়িয়েও খাওয়া যায়।’
প্রধান গবেষক অধ্যাপক এ বি এম আরিফ হাসান খান আরও বলেন, ‘বাউ মিষ্টিআলু-৫ কমবেশি প্রায় সারা বছরই চাষ করা যায়। তবে রবি মৌসুমে (১৬ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ) এর ফলন ভালো হয়। মিষ্টিআলু আমিষ, জিংক, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে ও পটাশিয়ামের জোগান দিতে সক্ষম। উপযুক্ত ও অনুকূল পরিবেশে বাউ মিষ্টিআলু-৫-এর উৎপাদন প্রতি হেক্টরে সর্বোচ্চ ৪০ টন হওয়া সম্ভব।’ তিনি আরও বলেন, ‘তবে রোগ সংক্রমণ, ইঁদুরের উৎপাতসহ কিছু প্রতিকূলতা থেকেই যায়। এমন অবস্থায় সর্বোচ্চ উৎপাদন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৩৩ টন পাওয়া গেছে। দেশে প্রচলিত মিষ্টিআলুর জাতীয় গড় উৎপাদন ১০ টনের মতো। সে হিসাবে এ আলুর উৎপাদন তিন গুণের বেশি। এ জাতের চারা রোপণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হলো নভেম্বরের শেষের সময়টা। মার্চের শেষের দিকে এ মিষ্টিআলু উত্তোলন করলে ফলন সবচেয়ে ভালো পাওয়া যায়।’ সূত্র: বাসস