
‘ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি, দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়, বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টি লাল পদ্ম’। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার কবিতায় একজন প্রেমিকপুরুষ তার ভালোবাসার মানুষের জন্য কী কী করতে পারে, তার বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন।
কিশোর কুমার গেয়েছেন, ‘ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী…’। সত্যিই তো ভালোবাসা ছাড়া এই জগৎ-সংসার অর্থহীন। আসলে পৃথিবীটা টিকে আছে ভালোবাসার ওপর। পৃথিবীতে এত হানাহানি, হিংসা-যুদ্ধ, সংঘাত। তার পরও পৃথিবী টিকে আছে কী করে? সে তো এই ভালোবাসার জোরেই।
যদিও প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে বছরের সব দিনই ভালোবাসার দিন। তার পরও ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ তাদের কাছে বিশেষ দিন হিসেবেই ধরা দেয়। ভালোবাসার মানুষকে আরেকটু বেশি করে ভালোবাসার, আরেকটু বেশি করে কাছে পাওয়ার জন্য যেন এই দিন। অনেক প্রেমিকপুরুষ এই দিনটির অপেক্ষা করে তার প্রেয়সীকে মনের কথাটি বলার জন্য।
আজ সেই ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইনস ডে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এই দিনটিকে খুব ঘটা করে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। এই দিনে প্রিয়জনকে সবাই ফুল ও বিভিন্ন সামগ্রী উপহার দিয়ে থাকে।
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস কয়েক বছর আগ পর্যন্তও বিশ্বব্যাপী ঘটা করে পালন করা হতো না। দিবসটি পাশ্চাত্য দেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশে আনন্দ-উন্মাদনার সঙ্গে পালন করা হয়।
প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেব-দেবীর রানি জুনোর সম্মানে ছুটির দিন। জুনোকে প্রেমের দেবী বলে লোকে বিশ্বাস করত। কারও কারও মতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হওয়ার কারণ ছিল এটিই। আবার কেউ বলেন, রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস ২০০ খ্রিষ্টাব্দে দেশে বিয়েপ্রথা নিষিদ্ধ করেন। তিনি ঘোষণা দেন, আজ থেকে কোনো যুবক বিয়ে করতে পারবে না। যুবকদের জন্য শুধুই যুদ্ধ।
তার মতে, যুবকরা যদি বিয়ে করে, তবে যুদ্ধ করবে কারা? সম্রাট ক্লডিয়াসের এ অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদ করেন এক যুবক। যার নাম ভ্যালেন্টাইন। অসীম সাহসী এ যুবকের প্রতিবাদে ক্ষেপে উঠেছিলেন সম্রাট। রাজদ্রোহের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা মাথা কেটে ফেলা হয় তার। ভালোবাসার জন্য ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে তখন থেকেই এই দিনটিকে পালন করা হয় ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে। তবে এটিও সর্বজনস্বীকৃত নয়। এখানেও দ্বিমত আছে।
কারও কারও মতে, প্রাচীন রোমে ভ্যালেন্টাইন নামে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি রোগীদের প্রতি ছিলেন ভীষণ সদয়। অসুস্থ মানুষের ওষুধ খেতে কষ্ট হয় বলে তিনি তেতো ওষুধ ওয়াইন, দুধ বা মধুতে মিশিয়ে খেতে দিতেন। সেই ডাক্তার খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন।
প্রাচীন রোমে খ্রিষ্টধর্ম তখন মোটেও জনপ্রিয় ছিল না। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের শাস্তি দেওয়া হতো। একদিন রোমের এক কারাপ্রধান তার অন্ধ মেয়েকে ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। ভ্যালেন্টাইন কথা দিয়েছিলেন তিনি তার সাধ্যমতো চিকিৎসা করবেন। মেয়েটির চিকিৎসা চলছিল এমন সময় হঠাৎ একদিন রোমান সৈন্যরা এসে ভ্যালেন্টাইনকে বেঁধে নিয়ে যায়।
ভ্যালেন্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন, খ্রিষ্টান হওয়ার অপরাধে তাকে মেরে ফেলা হবে। ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বা কারও মতে ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি রোম সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তার আগে ভ্যালেন্টাইন অন্ধ মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিলেন। তাকে হত্যার পর কারাপ্রধান চিরকুটটি দিয়েছিলেন মেয়েটিকে। তাতে লেখা ছিল, ‘ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন’। মেয়েটি চিরকুটের ভেতরে বসন্তের হলুদ ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রং দেখতে পেয়েছিল, কারণ এরই মধ্যে ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় মেয়েটির অন্ধ দুই চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছিল। ভালোবাসার এসব কীর্তির জন্য ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে পোপ জেলাসিয়ুস ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে এই দিবসটিকে মানুষেরা পালন করে আসছে।
ভ্যালেন্টাইনস ডের উৎপত্তির বিষয়ে কয়েকটি সম্পূর্ণ আলাদা মত রয়েছে। এই মতের লোকেরা বলেন, ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে প্রিয়জনকে ভালোবাসার বার্তা পাঠানোর আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিল, ১৪ ফেব্রুয়ারি হলো পাখিদের বিয়ের দিন। পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়তে বসে। আবার কেউ বলেন, মধ্যযুগের শেষ দিকে মানুষ বিশ্বাস করত এদিন থেকে পাখিদের মিলন ঋতু শুরু হয়। পাখিরা সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। পাখিদের দেখাদেখি মানুষও তাই সঙ্গী নির্বাচন করে এই দিনে।
৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন শুরু হলেও এটি বিশ্বব্যাপী প্রথম দিকে তেমন প্রচার ও প্রসার লাভ করেনি। পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সর্বক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য।
তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা বিরত থাকে না। খ্রিষ্টীয় চেতনা ভ্যালেন্টাইন দিবসের কারণে বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগে ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার ভ্যালেন্টাইনস উৎসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদযাপন করা নিষিদ্ধ করেছিল। এ ছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবসটি জনগণ ও সরকারিভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।
এখন কিন্তু ভ্যালেন্টাইনস দিবসের কদর প্রবল। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরা এ দিবস উপলক্ষে এই দিনে প্রায় কয়েক কোটি ডলার ব্যয় করে। যুক্তরাষ্ট্রে এই দিনে প্রায় তিন কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়।
ভালোবাসা দিবস পালন নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। এই দিবসের পক্ষে ও বিপক্ষে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। তার পরও সব বিতর্ক পেছনে ফেলে আজ অনেকে দিবসটি উদযাপন করবে, প্রকাশ করবে মনের মানুষের কাছে নিজের অনুভূতি। গাইবে ভালোবাসার জয়গান।
জয় হোক ভালোবাসার। জয় হোক ভালোবাসা দিবসের।