যেখানে ভিডিওটি প্রথমে আপলোড হয়েছিল, অর্থাৎ ভিডিওটি যারা ধারণ করেছিলেন সেই চ্যানেলে এটির ভিউ হয়েছিল আট হাজার। কিন্তু অন্য ভাষার ওই ভিডিওটি যখন প্ল্যাটফর্ম বদলে অন্য রঙ ধারণ করল, তখন ঘটে গেল বিস্ফোরণ। এই ভিডিওটির ভিউ বেড়ে গেল ৯২ গুণ। কী ভিডিও ছিল এটি!
তথ্য যাচাই সংস্থা রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ এমনই একটি তথ্য প্রকাশ করেছে।
সংস্থাটি বলছে- চলতি বছরের ২ জানুয়ারি টিকটকে আরজে জিন্নাত ইসলাম নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে আইপিএলের দল চেন্নাই সুপার কিংসের ক্রিকেটার, ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনির একটি বক্তব্যের ভিডিও আপলোড করা হয়। ভিডিওর ওপর “সংবাদ সম্মেলনে এসে মুস্তাফিজুর রহমানকে অপমান করলো মাইনন্দ্রো ছীন ধনি” এই লাইন লিখে ভিডিওটিতে উপস্থাপক দাবি করেন, “এখানে ধোনি বলেছেন, ‘মোস্তাফিজকে নিয়ে বড় ভুল করেছি। সাম্প্রতিক সময়ে মোস্তাফিজ ফর্মহীনতায় ভুগছেন। এমন মুহূর্তে আমরা না বুঝতে পেরেই তাকে দলে নিয়েছি। আসলে মোস্তাফিজকে দলে নেওয়া আমাদের ঠিক হয়নি।”
রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ বলছে, ক্রিকেট সমঝদার যে কেউ বুঝতে পারবেন যে, ধোনির এমন মন্তব্য করার কথা নয়৷ ‘আমরাও ১ মিনিট ৭ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে ধোনিকে তার নিজের মুখে এমন মন্তব্য করতে দেখিনি। কিন্তু এই বিষয়টি যখন আমরা যাচাই করছি, সে সময়ের মধ্যে ভিডিওটি প্রায় ৭ লাখ ৩৩ হাজার বার দেখা হয়েছে। ভিডিওটি নেওয়া হয়েছে ইউটিউবে Desi Cricket News নামে একটি চ্যানেল থেকে। এই চ্যানেলে এক দিন আগে ভিডিওটি আপলোড করা হলেও সেখান থেকে ভিডিওটি দেখেছেন মাত্র আট হাজার মানুষ। কিন্তু টিকটকে গিয়ে একই ভিডিও প্রায় ৯২ গুণ বেশি দেখা হয়েছে।’
আইপিএলে চলতি বছরের একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে চেন্নাই সুপার কিংসে খেলেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। কিন্তু বিসিবির পক্ষ থেকে পুরো মৌসুম খেলার অনুমতি না মেলায় গত ২ মে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, আইপিএল-এ বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা খেলতে গেলে সাধারণত সংশ্লিষ্ট ক্রিকেটারদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৌসুমজুড়ে আলোচনা চলে, শেয়ার হয় ছবি-ভিডিও আর নানা তথ্য। এসবের অবাধ প্রবাহের মধ্যেই ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও গেল কয়েক বছর ধরেই দেখে এসেছে রিউমর স্ক্যানার। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম টিকটকে ভুয়া তথ্যের ছড়িয়ে পড়া আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।
মোস্তাফিজের এবারের আইপিএল জার্নির পুরোটা সময় পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট অন্তত ১০টি টিকটিক অ্যাকাউন্টের খোঁজ পেয়েছে। যেগুলোতে কমপক্ষে এক লাখ বার দেখা হয়েছে এমন ৪০টি ভুয়া তথ্যের ভিডিও ভিউ হয়েছে প্রায় দেড় কোটি বার। এসব ভিডিওর সবগুলোই নেওয়া হয়েছে ইউটিউবের একাধিক চ্যানেল থেকে, যারা নিয়মিতই খেলা নিয়ে ভুল তথ্য প্রচার করে আসছে৷
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট মোস্তাফিজের এবারের আইপিএল মিশনকে ঘিরে ভাইরাল ৪০টি ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখেছে, এসব ভিডিওতে পুরোনো কায়দাতেই ভুয়া তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পুরোনো কিংবা ভিন্ন ঘটনার সাম্প্রতিক ভিডিওকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এসব ক্ষেত্রে চেন্নাইয়ের ক্রিকেটারদের পুরোনো ভিডিও যেমন ব্যবহার করা হয়েছে তেমনি আইপিএলের অন্যান্য দলের মালিকসহ দলগুলোর ক্রিকেটারদের বিভিন্ন সময়ের মন্তব্যের ফুটেজও ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি আইপিএলের সঙ্গে এখন সংশ্লিষ্টতা নেই এমন সাবেক ক্রিকেটারের পুরোনো ভিডিওকেও মোস্তাফিজের বিষয়ে মন্তব্যের সাম্প্রতিক ভিডিও দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
তাছাড়া, দেখা গেছে চেন্নাই সুপার কিংসের বোলিং কোচ ডোয়াইন ব্রাভোর একটি ডায়মন্ড আউটলেট উদ্বোধন এবং দলটির অধিনায়ক রুতুরাজ গায়কোয়াড়ের নির্দিষ্ট ম্যাচের বিষয়ে করা মন্তব্যের সাম্প্রতিক ভিডিও ব্যবহার করেও ভুয়া তথ্যের প্রচার করা হয়েছে। এসব ভিডিওতে তারা মোস্তাফিজের বিষয়ে কথা বলেছেন বলে দাবি করা হলেও আসলে এর কিছুই ঘটেনি।
ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাইরে মোস্তাফিজ নিয়ে এসব ভিডিওতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুরোনো সাক্ষাৎকারের ভিডিও যুক্ত করতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট।
গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেসময় ওয়ানডে বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে নিজের প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
এই এক ভিডিওই দুই বার ব্যবহার করে একবার দাবি করা হয়েছে, শেখ হাসিনা ফিজকে পুরো আইপিএল খেলার অনুমতি দিয়েছেন। আরেকবার দাবি করা হয়েছে, তিনি আইপিএলে মোস্তাফিজের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে তাকে গাড়ি-বাড়িসহ পাঁচ কোটি টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ শেখ হাসিনা এ যাবতকালে কাটার মাস্টারকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করেছেন, এমন তথ্য মেলেনি গণমাধ্যমে।
মোস্তাফিজকে নিয়ে প্রচারিত ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট দেখেছে, ধোনির পুরোনো চারটি ভিডিও (১, ২, ৩, ৪) ব্যবহার করে দাবি করা হচ্ছে যে, তিনি মোস্তাফিজকে নিয়ে এসব ভিডিওতে কথা বলেছেন। কিন্তু ধোনিকে প্রকাশ্যে এখন পর্যন্ত মোস্তাফিজ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করার খবর গণমাধ্যমে আসেনি। এমনকী মাহেন্দ্র সিং ধোনি চলতি বছরের আইপিএলের কোনো ম্যাচেই এখনো সংবাদ সম্মেলনে আসেননি।
তবে শুধু যে পুরোনো ভিডিওকেই এসব ভুয়া ভিডিওকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হাতিয়ার বানানো হচ্ছে, তা নয়। অন্যের মুখমণ্ডলের ওপর আরেকজনের মুখমণ্ডল বসিয়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর সহায়তা নিয়েও এসব ভুয়া ভিডিও প্রচার হচ্ছে।
এমন বিষয়ও লক্ষ্য করা গেছে, এ বছর মোস্তাফিজ আইপিএলে নিজের প্রথম ম্যাচে সেরা হলেও সে ম্যাচ বা এরপরের কোনো ম্যাচেই তাকে ইন্টারভিউ বা সংবাদ সম্মেলনে আসতে দেখা যায়নি। কিন্তু ফিজ আইপিএলে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন এমন একটি ভিডিও এআই-এর মাধ্যমে বানিয়ে ভুয়া তথ্যের প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট মোস্তাফিজের এবারের আইপিএল মিশন নিয়ে যে ৪০টি ভিডিও বিশ্লেষণ করেছে তার মধ্যে ৩৯টিরই মূল উৎস ইউটিউব। বাকি একটি ভিডিওর উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ভিডিও স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম ইউটিউবের ১১টি চ্যানেল থেকে এসব ভিডিও সংগ্রহ করে টিকটকে প্রকাশ করা হয়েছে৷
এসব ভিডিও প্রথম প্রকাশের পর ইউটিউবে সর্বমোট ২৫ লাখ ৮৫ হাজারের কিছু বেশিবার দেখা হলেও টিকটকে গিয়ে এসব ভিডিও দেখার হার প্রায় ছয় গুণ বেড়ে হয়েছে এক কোটি ৫১ লাখ ১৫ হাজারের কিছু বেশি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়া বন্ধে প্লাটফর্মগুলোর কারিগররা সবসময়ই সচেষ্ট বলে দাবি করলেও সেটা ঠিক কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই প্লাটফর্মে যে পরিমাণ ব্যবহারকারী বেড়েছে সে তুলনায় ভুয়া তথ্যের প্রবাহ বন্ধের কার্যক্রম একেবারেই কম।
অমিয়/