![ভারতের নির্বাচনে জটিল সমীকরণ](uploads/2024/05/20/Sukhronjon-Das-Gupto-1716183334.jpg)
আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি। কিন্তু তার আগেই ১ জুন সন্ধ্যা ৬টার পর টিভি চ্যানেলগুলো বুথফেরত সমীক্ষা দেখাবে। তাতেই একটা আঁচ পাওয়া যাবে ভারতে কারা এবার তখতে বসবে। সব সময় সব হিসাব না মিললেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সমীক্ষা একটা আভাস দিতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার তার নির্বাচনি কেন্দ্র উত্তর প্রদেশের বারানসীতে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে পূজা দিয়েছেন। মনোনয়নপত্র দাখিল করার পর তিনি এক জনসভায় বিরোধীদের কটাক্ষ করে বলেছেন, এবার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে তিনি ৪০০-এর বেশি পাবেন। ৪০০-এর বেশি পেয়ে প্রথম যে কাজটি তিনি করবেন, তাও তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিয়েছেন।
তার ঘোষণাটি হলো: কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী জোট যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাহলে সংবিধান সংশোধন করে মুসলিমদের জন্য শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ করে দেবে। আর তিনি যদি ৪০০-এর বেশি পান, তাহলে সংবিধান সংশোধন করে মুসলিমদের শিক্ষা, চাকরিসহ একাধিক বিষয়ে কোনো সুবিধা দেবেন না। তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে বিরোধী জোট বলছে, মোদি ৪০০ পার তো দূরের কথা, ২০০ আসনও পাবেন না। এদিকে গোটা বিশ্ব থেকে শত শত সাংবাদিক ভারতে এসে গেছেন। তারা শুধু দিল্লি নয়, গোটা ভারতবর্ষ চষে বেড়াচ্ছেন। তারাও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বলছেন, এই পরিস্থিতিতে মোদির পক্ষে ৪০০ আসন পাওয়া সহজ হবে না। কেউ কেউ বলছেন, মোদির দলের পক্ষে ২০০টি আসন বের করাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
শুধু তা-ই নয়, বিজেপি ও আরএসএসের একাধিক মহল থেকে বলা হচ্ছে, মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেও কতদিন থাকবেন? বিজেপির সংগঠনে বলা আছে, ৭৫ বছর বয়স হয়ে গেলে কেউ সরকারি পদে থাকতে পারবেন না। অনেকে উদাহরণ দিয়ে বলছেন, মোদি নিজেই পাঁচ বছর আগে এই আইনটি করেছিলেন। সেই আইনের বলেই আরএসএস বাবরি মসজিদ ধ্বংসের নায়ক লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলি মনোহর যোশি এবং মোদি জমানার প্রথমবারের স্পিকার সুমিত্রা মহাজনকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য টিকিট দেওয়া হয়নি।
আগামী নভেম্বরে মোদির ৭৫ বছর পূর্ণ হবে। তাহলে তিনি কি মাত্র ছয় মাসের জন্যই প্রধানমন্ত্রী হবেন? এই প্রশ্নে বিজেপির অন্দর মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা মোদির বক্তব্য শুনে নানা রকম কটাক্ষ শুরু করে দিয়েছেন। গত সোমবার দিল্লির একটি ইংরেজি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মোদি এক উদ্ভট মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতের সংবিধান তার পরিবারের জন্য রচনা করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। সংবিধান তৈরি করার সময় (১৯৪৭-৫০) জনসঙ্ঘ বা বিজেপির জন্ম হয়নি। হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধি হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি গণপরিষদে ছিলেন। তিনি নেহরু মন্ত্রিসভার মন্ত্রীও ছিলেন।
ভারতের ইতিহাসকে মোদি গত কয়েক মাসে নানাভাবে বিকৃত করছেন। গত সোমবার রাতেই একটি ইংরেজি চ্যানেলে আলোচনায় অংশ নিয়ে ভোট বিশেষজ্ঞ যোগেন্দ্র যাদব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বিজেপি-আরএসএস ভারতের ইতিহাস জানে না। যদি একটু পড়াশোনা করতেন, তাহলেই জানতে পারতেন ভারতের সংবিধান কীভাবে তৈরি হয়েছিল।
সেখানে সব দলের প্রতিনিধি ছিলেন। বাবা সাহেব আম্মেদকর, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিসহ একাধিক নেতা সংবিধান প্যানেলে ছিলেন। একা নেহরু সংবিধান কী করে রচনা করতে পারেন। আমার মনে আছে নয়ের দশকে জার্মানির নির্বাচন কভার করতে গিয়েছিলাম। যোগেন্দ্র যাদবের সঙ্গে সেখানে আমার পরিচয় হয়। সেই থেকে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ। যোগেন্দ্র যাদব নির্বাচনের ১৫ দিন আগে আমাকে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী চ্যান্সেলর হয়ে আসবেন কোল। তাই হয়েছিল। তার সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বর্তমানে ভারতে মোদি-বিরোধী হাওয়া চলছে। মোদি ২০১৪ এবং ২০১৯-এ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার একটাও পালন করেননি। তিনি সব বুঝতে পেরেই হিন্দু-মুসলমান মেরূকরণে জোর দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তার সহযোগী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রতিদিন বুলি আওড়ে যাচ্ছেন, নির্বাচনের পর অধিকৃত কাশ্মীর ভারত নিয়ে নেবে। কিন্তু কীভাবে নেবে তা তিনি বলছেন না। যোগেন্দ্র যাদবের প্রশ্ন, তাহলে কি তিনি যুদ্ধ করবেন?
বিজেপি-আরএসএস এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তাদের মূল বক্তব্যই হলো, সংখ্যালঘু মুসলমানদের যাতে এ দেশ থেকে উৎখাত করা যায়। গত চার দফা নির্বাচনে ভোটদানের যে হিসাব পেশ করা হয়েছে, তাতে কিছুটা জল মেশানো আছে বলে নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে।
কমিশন তার কোনো সদুত্তর না দিয়ে পাল্টা অভিযোগ করে বলেছে, খাড়গের আগ্রাসী মন্তব্য নির্বাচন-প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব ফেলেছে। কমিশনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কংগ্রেস। যে ভাষায় নির্বাচন কমিশন খাড়গের সমালোচনা করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রাজনৈতিক মহলে।
প্রথম দফার ভোটের ১১ দিন ও দ্বিতীয় দফার ভোটের ৪ দিন পর ওই দুটি পর্বে চূড়ান্ত ভোটদানের হার প্রকাশ্যে আনে কমিশন। দুটি পর্বেই দেখা যায়, প্রাথমিকের পর চূড়ান্ত পরিসংখ্যানে প্রায় ৬ শতাংশ ভোট বেড়েছে। এত বেশিসংখ্যক ভোট পড়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন বিরোধীরা।
খাড়গের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নির্বাচন কমিশন এক্স হ্যান্ডলে জানায়, নির্বাচন চলাকালীন আপনি যে ধরনের অভিযোগ তুলছেন তা অবাঞ্ছিত এবং দেখে মনে হয় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্পর্কে ভোটারদের মনে সংশয় তৈরি করতেই ওই কথা বলা হয়েছে। কমিশন মনে করছে, খাড়গের এ ধরনের মন্তব্য ভোটারদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী জনসভা থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বারবার বললেও অন্যদের তা বলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এ অভিযোগ করেছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের ডি দেবরাজন। দূরদর্শন ও আকাশবাণীর প্রচারে তিনি তার লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছিলেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন মুসলিমদের জন্য বৈষম্যমূলক। সরকারি গণমাধ্যমগুলো থেকে তাদের বলা হয়, বিবৃতিতে ‘মুসলিম’ শব্দটি রাখা যাবে না।
২০০৪ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ি যে হেরে যাবেন, তা কেউ কল্পনা করতে পারেননি। তার আগের পাঁচ বছরে অটলজি সবাইকে নিয়েই দেশ শাসন করেছিলেন। ২০০৪ সালে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী বাজপেয়িকে হারিয়ে দেন। তারপর দুবার কংগ্রেস দেশ শাসন করে। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, গুজরাট দাঙ্গার সময় এই বাজপেয়িই বলেছিলেন, মোদি রাজধর্ম পালন করছেন না। অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে অধ্যাপক মহল সবাই বলছেন, এবারও একবার পালাবদল হতে চলেছে।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক