বাংলাদেশে দিন দিন বাড়ছে স্কুটারের জনপ্রিয়তা। এক সময় স্কুটারকে নারীদের বাহন হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এখন নারী-পুরুষনির্বিশেষে স্কুটার ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন। শহুরে জীবনে যানজট এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো, সহজ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও জ্বালানিসাশ্রয়ী হওয়ায় স্কুটারের ব্যবহার বাড়ছে।
কেন স্কুটারের চাহিদা বাড়ছে?
স্কুটারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে হালকা ওজন ও সহজ ব্যবহার। স্কুটারে স্বয়ংক্রিয় গিয়ার সিস্টেম থাকায় শহরের ব্যস্ত রাস্তায় এটি চালানো সহজ। পার্কিংয়ের জন্য স্কুটারের কম জায়গা লাগে। এতে জ্বালানি খরচও কম।
নগরায়ণের কারণে ব্যক্তিগত পরিবহনের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে স্কুটার সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী বাহন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নিরাপদ ও আরামদায়ক হিসেবে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার কাছে স্কুটারের চাহিদা বাড়ছে।
এ ছাড়া স্কুটারের ডিজাইন ও ফ্যাশনেবল লুক তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আকর্ষণ বাড়াচ্ছে। নারী চালকদের মধ্যেও স্কুটারের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ এটি মোটরসাইকেলের তুলনায় সহজতর ও নিরাপদ।
কাদের মধ্যে স্কুটারের চাহিদা বেশি?
কর্মজীবী নারীরা যানজট এড়িয়ে অফিসে যাতায়াত ও ব্যক্তিগত কাজে বেছে নিচ্ছেন স্কুটার। যানজটপূর্ণ শহরে এটি তাদের দৈনন্দিন যাতায়াতে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যেও স্কুটারের জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার জন্য এটি একটি সাশ্রয়ী ও কার্যকর বাহন হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর চাহিদা বাড়ছে।
বর্তমানে অনলাইন ডেলিভারি সেবায় স্কুটারের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন ফুড ডেলিভারি ও ই-কমার্স ডেলিভারি কর্মীদের জন্য এটি একটি আদর্শ বাহন হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে তারা দ্রুত ও সহজে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য পৌঁছে দিতে পারছেন। শহরের অলিগলি ও যানজটপূর্ণ রাস্তায় দ্রুত পণ্য পৌঁছে দিতে স্কুটারের বিকল্প নেই।
মোটরসাইকেলের তুলনায় স্কুটারের গঠন ও স্বয়ংক্রিয় গিয়ার এটিকে আরও বেশি নিরাপদ ও আরামদায়ক করে তুলেছে। তাই যারা মোটরসাইকেলের চেয়ে নিরাপদ ভ্রমণ পছন্দ করেন, তারাও এখন স্কুটারের দিকে ঝুঁকছেন।
শহুরে জীবনে যানজট একটি নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা। এই যানজট এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য স্কুটার একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, স্কুটারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা শহুরে পরিবহন ব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। ব্যক্তিগত ব্যবহারের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশের বাজারে কোন ধরনের স্কুটার পাওয়া যায়?
বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে ৫০ সিসি থেকে ১৬০ সিসি পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষমতার স্কুটার পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৮০ সিসি থেকে ১২৫ সিসির স্কুটারগুলো বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ব্র্যান্ডভেদে স্কুটারের দাম পড়বে ৮০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। রানার, হিরো, টিভিএস, ইয়ামাহা, হোন্ডা, সুজুকি ও ভেসপাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্কুটার এখানে পাওয়া যায়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের স্কুটারগুলো বিভিন্ন মডেল ও ডিজাইনে উপলভ্য।
কমিউটার স্কুটার
কমিউটার স্কুটার সাধারণত দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য উপযোগী হয়ে থাকে। এগুলো সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য, হালকা ও জ্বালানি খরচ কম। এ ধরনের স্কুটার অফিসগামী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়।
জনপ্রিয় মডেল: ইয়ামাহা রে জেডআর, সুজুকি আ্যাকসেস ও হোন্ডা ডিও।
ইলেকট্রিক স্কুটার
পরিবেশবান্ধব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ইলেকট্রিক স্কুটার, যেগুলোয় ব্যবহার করা হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। এ ধরনের বাহনের রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কম হয়ে থাকে। শহরের ছোট দূরত্বে চলাচলের জন্য পরিবেশসচেতন ব্যক্তিরা ইলেকট্রিক স্কুটারের দিকে ঝুঁকছেন।
জনপ্রিয় মডেল: হিরো ইলেকট্রিক অপটিমা, ওয়ালটন টাকাইন।
স্পোর্টি স্কুটার
তরুণ প্রজন্মের কাছে স্কুটার ফ্যাশন ও ব্যক্তিত্বের একটি অংশ হয়ে উঠছে। এই চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাজারে এসেছে স্পোর্টি স্কুটার। আধুনিক ডিজাইন, বেশি গতি ও স্টাইলিশ লুকের জন্য এই স্কুটারগুলো তরুণ এবং ফ্যাশনপ্রিয় চালকদের মধ্যে খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
শক্তিশালী ইঞ্জিন ও উন্নত ট্রান্সমিশন থাকার কারণে স্পোর্টি স্কুটারগুলো সাধারণ স্কুটারের চেয়ে বেশি গতিতে চলতে পারে। আধুনিক হেডলাইট, টেললাইট, অ্যালয় হুইল ও বিভিন্ন রঙের ব্যবহার এই স্কুটারগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। উচ্চ গতিতে চলার জন্য উন্নত ব্রেকিং সিস্টেম ও আরামদায়ক রাইডের জন্য উন্নত সাসপেনশন ব্যবহার করা হয়। আধুনিক তথ্য প্রদর্শনের জন্য ডিজিটাল কনসোল বা ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেল থাকে।জনপ্রিয় মডেল: ইয়ামাহা অ্যরোক্ম ১৫৫, এপ্রিলা এসআর ১৫০।
হেভি ডিউটি স্কুটার
দেশে হেভি ডিউটি স্কুটারের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শক্তিশালী ইঞ্জিন ও ভারী জিনিস বহনের সুবিধার কারণে পেশাদার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে এসব স্কুটার দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
হেভি ডিউটি স্কুটারগুলোয় সাধারণত ১২৫ সিসি বা তার চেয়েও শক্তিশালী ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। এর ফলে স্কুটারগুলো কেবল দৈনন্দিন যাতায়াতেই নয়, ভারী পণ্য পরিবহনের কাজেও সমান কার্যকর। এসব স্কুটারে স্থিতিশীল চেসিস, উন্নত ব্রেকিং সিস্টেম ও বড় লোড ক্যারিয়ার যুক্ত থাকে, যা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বিশেষভাবে সহায়ক হয়।
জনপ্রিয় মডেল: হোন্ডা অ্যাকটিভা ১২৫, টিভিএস জুপিটার।
ছোট আকারের স্কুটার
আকারে ছোট, হালকা ও সহজ নিয়ন্ত্রণযোগ্য হওয়ায় ছোট আকারের স্কুটার নতুন চালক ও নারীদের জন্য আদর্শ পরিবহন মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
ছোট আকারের স্কুটারগুলো সাধারণত আকারে কমপ্যাক্ট হয়। ফলে ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে চালানো কিংবা পার্কিং করা সহজ হয়। স্কুটারগুলোর স্টাইলিশ ডিজাইন, জ্বালানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তি এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় আসন নতুন চালকদের জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। ছোট আকারের স্কুটারগুলো শিক্ষার্থী, গৃহিণী কিংবা অফিসগামী নারী চালকরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চালাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
জনপ্রিয় মডেল: সুজুকি লেটস, হিরো প্লেজার।
স্কুটার ব্যবহারের মাসিক খরচ কেমন?
স্কুটার সাধারণত প্রতি লিটার জ্বালানিতে ৩৫ থেকে ৪৫ কিলোমিটার মাইলেজ দেয়। ফলে জ্বালানি খরচ মোটরসাইকেলের তুলনায় সাশ্রয়ী হয়। মাসিক খরচ নির্ভর করে দৈনিক ব্যবহারের ওপর। এ ছাড়া স্কুটারের রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তুলনামূলক কম।
বর্তমান বাজারে প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম প্রায় ১৩০ টাকা। প্রতি কিলোমিটার খরচ হয় ২.৮০ থেকে ৩.৫০ টাকা পর্যন্ত। ২০ কিলোমিটার চললে প্রতি মাসে জ্বালানির জন্য খরচ হবে প্রায় ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা।
ইঞ্জিনকে সচল রাখতে ও পারফরম্যান্স ঠিক রাখার জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন করতে হয়। এর খরচ স্কুটারের মডেল ও ব্যবহৃত অয়েলের গ্রেডের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত ১ হাজার কিলোমিটার চললে একবার ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন করতে হয়। এতে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা খরচ হয়। টায়ার ও ব্রেক প্যাড বছরে এক থেকে দুবার পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে।
টায়ারের প্রেশার, ব্রেক চেক ও স্পার্ক প্লাগ পরিবর্তনের মতো ছোটখাটো সার্ভিসিং প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ফ্রি সার্ভিসিং সেবা দিয়ে থাকে।
মোটরযান আইন অনুযায়ী, রাস্তায় স্কুটার চালাতে হলে বিমা করানো বাধ্যতামূলক। বাৎসরিক প্রিমিয়াম দিতে হয়। রোড ট্যাক্স বাৎসরিক বা দ্বিবার্ষিক হতে পারে, যা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়।
বৈদ্যুতিক স্কুটার
যারা বৈদ্যুতিক স্কুটার ব্যবহার করেন, তাদের জন্য জ্বালানি খরচ আরও কম। প্রতি চার্জে স্কুটার ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার চলে। বৈদ্যুতিক স্কুটারের প্রতি কিলোমিটার খরচ প্রায় ১ টাকা।