রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে ক্যাম্পাসসংলগ্ন বিনোদপুর বাজার রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার এক বছরপূর্তি আজ (সোমবার)।
গত বছরের ১১ মার্চের ওই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এ ছাড়া সংঘর্ষ চলাকালে বিনোদপুর ফটক পুলিশ বক্সে আগুন দেন স্থানীয়রা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের আটটি মোটরসাইকেল। শিক্ষার্থীরাও বিনোদপুরের কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন। এই ঘটনায় এক বছরপূর্ণ হলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার জানিয়েছেন, তিনি ফাইল উপাচার্যের দপ্তরে পাঠিয়েছেন। তবে উপাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলছেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এদিকে নিয়মানুযায়ী উপাচার্যের স্বাক্ষরের পর সেটি সিন্ডিকেটে উত্থাপিত হওয়ার কথা থাকলেও প্রতিবেদন জমা হওয়ার ১০ মাস পার হলেও সেটি সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপিত হয়নি। ফলে ঘটনার রহস্য উন্মোচন হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা বলছেন, সত্য উদঘাটন ও তদন্তের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে সেটি সত্য ধামাচাপা দেওয়ার মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসন আন্দোলন থামানোর জন্যই তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু প্রতিবেদন আলোর মুখ না দেখায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা।
প্রতিবেদনের বিষয়ে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমরা ঘটনা তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করি। পরে সেটি রেজিস্ট্রার দপ্তরে জমা দেই।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আবদুস সালাম জানান, তদন্ত কমিটি তার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। তিনি সেটি উপাচার্য দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপিত হয়নি।
তদন্ত প্রতিবেদন কেন সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপিত হয়নি এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার মুঠোফোনে বলেন, ‘সবকিছুই সিন্ডিকেটে যায় না। ফাইল কোথায় আছে, আমি এই মুহূর্তে বলতে পারব না। দেখতে হবে আমার দপ্তরে আছে কি না।’
সত্য ধামাচাপা ও আন্দোলন স্তিমিত করার জন্যই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নামমাত্র তদন্ত কমিটি গঠন করে। তারা কোনো রকম একটা দায়সারা রিপোর্ট জমা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে আবার ভালো করে রিপোর্ট জমা দিলেও কর্তৃপক্ষ আলোর মুখ দেখান না।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১১ মার্চ সন্ধ্যায় রাবির এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে একটি বাসের সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা-কাটাকাটির জেরে বিনোদপুর বাজারে সংঘর্ষের সূত্রপাত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন এ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। হামলা-সংঘর্ষ ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেলে আহত হন দুই শতাধিক শিক্ষার্থী। এ সময় একটি পুলিশ বক্স ও রাস্তার পাশের অন্তত ৩০টি দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার প্রতিবাদে ১২ মার্চ সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা চারুকলাসংলগ্ন রেললাইন ও ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে অগ্নিসংযোগ করে সড়ক অবরোধ করেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে তিনটি পৃথক মামলা করে।
এদিকে ওইদিন পুলিশের গুলিতে আহত হন তিন শিক্ষার্থী। তাদের চিকিৎসার ব্যয় বহনের আশ্বাস দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে আহত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের আশ্বাসেই আটকা আছে সহায়তা।
ওইদিন চোখে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন আইন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আল আমিন। এখনো নিয়মিত ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে তাকে।
তিনি জানান, তার ডান চোখ স্প্লিন্টারের আঘাতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূলত এ চোখেই সার্জারি হয়েছে। চোখের রেটিনাতে এখনো ক্ষত রয়ে গেছে। আবার বাম চোখের নার্ভের পাশে একটা স্প্লিন্টার লেগে থাকার কারণে বাম চোখও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।