বিদেশ গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে কম-বেশি অনেকেরই থাকে। এই তালিকায় পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হারই বেশি। তবে দিন দিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের মধ্যেও এই প্রবণতা বাড়ছে। কেউ কেউ তো উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েই দেশের বাইরে উড়াল দেন। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পছন্দের সারিতে প্রথমেই থাকে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো। ইউনেসকোর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে থেকে যত শিক্ষার্থী (২৪,১১২ জন) উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়েছেন, ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা ছিল দ্বিগুণেরও বেশি (৫২,৭৯৯ জন)। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ আবার ভিনদেশেই স্থায়ীভাবে থাকার বন্দোবস্ত করে ফেলেন। বাইরে থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের এই উৎসাহের আসলে কারণটা কি? দেশের শিক্ষাব্যবস্থাতেই বা কিসের অপ্রতুলতা রয়েছে? এসব বিষয়ে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন মাহমুদ শাকিল
হাসিবুল হাসান ধ্রুব
যন্ত্রকৌশল বিভাগ, সেশন: ২০১৮-১৯
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের দেশে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিদ্যার চর্চা থাকলেও এর বাস্তবিক প্রয়োগের ক্ষেত্র এখনো সীমিত। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নত শিক্ষার মান, গবেষণার সুযোগ এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতি ও প্রশাসনিক জটিলতা হতাশা সৃষ্টি করলেও উন্নত দেশগুলোর জীবনমান, নিরাপত্তা এবং সামাজিক সুরক্ষা শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী করছে। বাংলাদেশে প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে বিশ্বমানের ডিগ্রি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা বৈশ্বিক চাকরির বাজারে প্রবেশকে সহজ করে তোলে এবং ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। সব মিলিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উন্নতির লক্ষ্যে বিদেশে পড়াশোনা এখন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি লোভনীয় সুযোগ।
মো. আবির হোসেন
যন্ত্রকৌশল বিভাগ,সেশন: ২০১৮-১৯
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
উন্নয়নশীল দেশের একজন ছাত্র হিসেবে উন্নত দেশের উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার ইচ্ছা অনেক দিন ধরেই অন্তরে লালন করছি। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখেছি, আরও গভীর জ্ঞান আর আধুনিক টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশে গিয়ে পড়াশোনা করলে নতুন টেকনোলজি, গবেষণা আর ভিন্নধারার কাজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। এটা আমার জন্য একদিকে যেমন নিজের স্কিল বাড়ানোর সুযোগ, তেমনি নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনেরও একটা বড় মাধ্যম। আশা করছি, এই অভিজ্ঞতা আমাকে ভবিষ্যতে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে। এসব জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার ক্যারিয়ারে আরও ভালো কিছু করতে চাই। দেশে ফিরে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে কিছু অবদান রাখারও ইচ্ছা আছে।
মো. ইমরান নাজির
অর্থনীতি বিভাগ, সামার ২০২০
ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পড়ালেখার গুণগত মান এবং গ্রহণযোগ্যতা এ দুটি বিষয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বলে আমি মনে করি। শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্বমানের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি লাভ পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনে অধিকতর মূল্যায়ন এবং পেশাগত দক্ষতা তৈরিতে সাহায্য করে। তা ছাড়া উন্নত নাগরিক সুবিধা, জীবনমানের উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা এগুলোও শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আকৃষ্ট করে। এজন্য অনেকেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশে না ফিরে বিদেশেই কর্মজীবন শুরু করে, যাকে আমরা মেধা পাচার বলে থাকি। অথচ বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে দেশের প্রয়োজনে সেই জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের মানুষের জন্য মঙ্গলজনক হবে। এ জন্য দেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত সেই অনূকূল পরিবেশ তৈরি করা।
মোহাম্মদ নাঈম
অর্থনীতি বিভাগ, সেশন: ২০১৮-১৯
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এখনকার সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে এক আকর্ষণীয় এবং বহুল প্রচলিত লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সুযোগ-সুবিধা, গবেষণার সমৃদ্ধ পরিসর এবং নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেছে।
প্রথমত, বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে শিক্ষার মান এবং গবেষণার সুযোগ। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার ক্ষেত্রে যে ধরনের আর্থিক সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা রয়েছে, তা আমাদের দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত।
দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক শিক্ষা পরিবেশে নিজেকে গড়ে তুলতে সুবিধা হয়। বিভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি এবং ভাষার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশতে পারার অভিজ্ঞতা একজন শিক্ষার্থীকে বহুমুখী বিষয়ে চিন্তা করতে সহায়তা করে।
মো. সাকিব আহমেদ
টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট, সেশন: ২০১৮-১৯
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়
একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে বিশ্বমানের করে গড়ে তোলার জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষা বহুমুখী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর চিন্তাভাবনা অনেকটা নির্ভর করে তার ব্যক্তিগত লক্ষ্য, আগ্রহ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ওপর। উচ্চশিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যায়ন এবং গবেষণার সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষা এবং সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করায়। ফলস্বরূপ একজন শিক্ষার্থী মাল্টি-ডাইমেনশনাল ক্যারিয়ার গড়তে পারে।
বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি টেক্সটাইল সেক্টরের টেকসই এবং বহুমাত্রিক উন্নয়নের জন্য উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।
নাফিসা আমরীন পূর্ণতা
বিবিএ, তৃতীয় বর্ষ
নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা নিতে বরাবরের মতোই আমরা সব সময় উৎসাহিত থাকি। বিদেশের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ডিগ্রি নেওয়া প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। কিছু দিন আগেও আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বিদেশ পাড়ি জমাতো উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি সেখানে স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তোলার লক্ষ্যে। আমিও ঠিক এমনটি পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন এই দৃশ্যপটে খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন উচ্চশিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে নিজ দেশের জন্য কাজ করতে চায়। আমার নিজের অন্তত এমনটাই ইচ্ছে। মাতৃভূমির উন্নয়নের জন্যই দেশে ফিরে একসাথে কাজ করার আগ্রহ এখন আমাদের সবার মাঝে।
ফাইরুজ আনিকা
ইংরেজি বিভাগ, ব্যাচ : ৫৫
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
বর্তমানে শিক্ষার্থীরা বিদেশমুখী। দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের অন্যতম কারণ ভালো ক্যারিয়ার। বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান তেমন একটা ভালো পর্যায়ে নেই। আমাদের দেশের শিক্ষার থেকে বাইরের দেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আসাটাকে দেশের চাকরি বাজারে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। দেশে চাকরির বাজার শোচনীয় হলেও বাইরের দেশে উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি রয়েছে চাকরির সুযোগ। তাই শিক্ষার্থীদের বাইরে যাওয়ার ঝোঁকও বেশি। বাইরের দেশ গবেষণার দিক থেকে অনেক এগিয়ে। তাই উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি গবেষণার কাজেও থাকার জন্য সবাই বাইরে যেতে অগ্রসর হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পজিটিভ মনোভাব থাকে।
আব্দুল্লাহ আল নোমান
রসায়ন ডিসিপ্লিন, সেশন : ২০১৯-২০
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
আমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষের একজন শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমনে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী হওয়ার ব্যাপারে দেশে পর্যাপ্ত সুযোগের সংকীর্ণতাকেই দায়ী মনে করি। এক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবন বা থিসিসের কাজ চলমান রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ড পাওয়া যায় না। এর পাশাপাশি ল্যাবের ইনস্ট্রুমেন্টের ভয়াবহ অভাব রয়েছে। কোনো একটা থিসিসের কাজের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই অন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হতে হয় এবং এক্ষেত্রে কয়েক মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, যা সঠিক সময়ে কাজ সম্পন্নে ব্যাঘাত ঘটায়। এ ছাড়াও দেশে বেকারত্বের সমস্যা এবং বিদেশে পড়াশোনার পাশাপাশি ভালো মানের জীবনযাপন অনেক ক্ষেত্রে উৎসাহী করে ছাত্রদের।
মো. আলিফ
হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষাকে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের এক সোনালি সুযোগ হিসেবে দেখে। বিশ্বমানের শিক্ষা অর্জন, বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের দুয়ার খোলা এবং নিজেকে এক ভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে গড়ে তোলার চিন্তা তাদের মুগ্ধ করে। মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সম্ভাবনা তাদের অনুপ্রাণিত করে। যদিও খরচ, ভিসার জটিলতা এবং নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর চ্যালেঞ্জ আছে। শিক্ষার্থীরা এটিকে ভবিষ্যতের সফলতা এবং ব্যক্তিগত বিকাশের জন্য এক অনন্য বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করে। সব মিলিয়ে বিদেশে পড়াশোনা শিক্ষার্থীদের কাছে এক মূল্যবান বিনিয়োগ, যা তাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে অসীম সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দেয়।
মুশফিকুর রহমান যোবায়ের
হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগ, সেশন : ২০১৮-১৯
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা গবেষণা ও উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশে পিছিয়ে রয়েছে। ফলে স্নাতক শেষে শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে টিকে থাকতে দক্ষতার অভাবে সমস্যায় পড়েন। আদর্শগতভাবে, এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চিন্তা ও দক্ষতার মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার সক্ষমতা থাকা উচিত ছিল। এই দক্ষতার অভাব কাটিয়ে উঠতে বা দক্ষতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ না থাকায়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান তথ্য ব্যবস্থা বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেছি। বাংলাদেশে সিএ সম্পন্ন করে অস্ট্রেলিয়া বা কানাডায় সিপিএ করার ইচ্ছা রয়েছে।
কলি